গ্রেফতার হলেন বুধবার ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনে 'স্মোক বম্ব' হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ললিত ঝা। সংসদে হামলার ঘটনায় দিল্লি পুলিশ বুধবারই ৬ জনকে হেফাজতে নিলেও ললিত ঝা-কে ধরতে পারেনি।
হামলার দেড়দিন পর রাজধানী দিল্লি থেকেই ললিত ঝাকে গ্রেফতার করা হল।
বুধবার লোকসভার অধিবেশন চলাকালীন দর্শকদের বসার গ্যালারি থেকে আচমকাই নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন দুই যুবক-যুবতী। জুতোর ভিতর থেকে স্মোক ক্যানিস্টার বের করে হলুদ ধোঁয়ায় গোটা লোকসভা ভরিয়ে দিয়েছিলেন তারা।
সেই একই সময় অধিবেশন কক্ষের বাইরে থেকেও স্লোগান দিতে দিতে রঙিন গ্যাস স্প্রে করছিলেন আরও কয়েকজন। ললিত ছিলেন তাদের মধ্যেই একজন।
বাকিদের বুধবারই গ্রেফতার করা হলেও পলাতক ছিল ললিত। শুক্রবার দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হল তাকে।
বৃহস্পতিবার ১৪ ডিসেম্বর তদন্ত এগোলে ললিতের কলকাতা যোগের কথা উঠে আসে। বুধবার যখন তার সহযোগীরা সংসদের ভিতরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তখন বাইরে থেকে সেই ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হালিশহরের বাসিন্দা নীলাক্ষ আইচ নামে একজনকে পাঠিয়েছিলেন ললিত।
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া এই নীলাক্ষ একটি এনজিও চালান। সেই এনজিও-র সূত্রেই তার সঙ্গে ললিতের আলাপ বলে জানতে পারে পুলিশ।
ললিত শুধু নীলাক্ষর এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই নয়, কলকাতার ব্যস্ত অঞ্চল বড়বাজারে বেশ কিছুদিন ভাড়াও ছিলেন তিনি। সেই সময় প্রতিবেশী কয়েকজন বাচ্চাকে ললিত টিউশন পড়াতেন বলে তদন্তে জানা গেছে।
তবে রাতে তাকে কখনও বাড়িতে থাকতে দেখা যায়নি। সেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছু দিন আগেই তিনি চলে যান।
এই ঘটনার সূত্রেই তদন্তকারীদের নজরে উঠে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের নীলাক্ষ আইচ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের একটি দল তার হালিশহরের বাড়িতে পৌঁছে যায়।
নীলাক্ষর সঙ্গে ললিতের আলাপের সূত্র কী, সংসদে হামলার ব্যাপারে তিনি কতটা জানতেন, কেনই বা তাকে ঘটনার ভিডিও পাঠালেন ললিত, এই সমস্ত কিছুই খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী দল। তার মধ্যেই গ্রেফতার হলেন ললিত ঝা।
হামলাকারীদের দাবি তারা 'শিক্ষিত বেকার'
বুধবার ১৩ ডিসেম্বর সংসদে 'স্মোক বম্ব' হামলার ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের (ইউএপিএ) ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত চলছে।
পুলিশ অভিযুক্তদের জেরা করে জানতে পারে, বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা। যেমন বেকারত্ব, কৃষকদের সমস্যা, মণিপুরে চলতে থাকা সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো।
পুলিশের কাছে তারা বারবার একই দাবি করছেন। ধরা পড়ার পর থেকেই অভিযুক্তরা দাবি করেছেন, তারা হামলাকারী নন। সন্ত্রাসমূলক হামলার কোনও পরিকল্পনা তাদের ছিল না। তারা 'শিক্ষিত বেকার'।
বুধবারের ঘটনার তদন্তে নেমে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। দফায় দফায় ধৃতদের জেরা করে উঠে আসা তথ্য থেকে তারা জানতে পেরেছেন, বহুদিন ধরে এই 'হামলা'-র ছক কষা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল সংসদ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তাই তারা রঙিন স্মোক বম্ব ব্যবহার করেছেন।
তদন্তকারী দল জানিয়েছে, "সরকারকে বার্তা দেওয়ার জন্য এই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে ধৃতরা দাবি করেছে। তাদের সকলের উদ্দেশ্যই একই ছিল। তবে তারা কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।"
ধৃতরা পুলিশকে জানিয়েছেন তারা কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। তারা পড়ুয়া ও বেকার। তাদের বাবা-মায়েরা শ্রমিক, কৃষক।
তাদের জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, বহুদিন ধরে অভিযুক্তরা বিভিন্নভাবে এই হামলার ছক কষেছিলেন। কীভাবে এমন হামলা করা হবে তার জন্য রেইকিও করা হয়েছিল। গত বাদল অধিবেশনের সময় তারা সংসদ চত্বরে এসেছিলেন।
ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব
তদন্তে উঠে এসেছে, যে ৬ জনকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তারা সকলেই সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ভগৎ সিং ফ্যানক্লাব'-এর সদস্য৷ পরিচয় খুঁজতে গিয়ে হামলার নেপথ্যের যোগসূত্রও পেয়েছে পুলিশ।
সংসদ ভবনের এই ঘটনার সাদৃশ্য রয়েছে পরাধীন ভারতে ১৯২৯ সালের এক ঘটনার সঙ্গে।
তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অভিনব এক পন্থা বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং। নিজেদের দাবিদাওয়া ব্রিটিশ শাসকদের কানে তুলতে এক উপায় বের করেছিলেন তারা।
সে সময়ে অবিভক্ত বাংলার বটুকেশ্বর দত্ত তৈরি করেছিলেন এমন এক বোমা, যা দিয়ে বিস্ফোরণ হত বিশাল কিন্তু প্রাণহানি হত না। ভগৎ সিং ও তার সহযোদ্ধারা ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সংসদে অধিবেশন চলাকালীন দর্শকের আসন থেকে পরপর এমনই দুটি বোমা ছুড়েছিলেন।
সঙ্গে স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’৷ দাবিদাওয়া লেখা লিফলেটের কাগজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সংসদ কক্ষের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন দু’জনে।
বুধবারের ঘটনার নেপথ্যে এই যোগসূত্রই খুঁজে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ জানিয়েছে, ভগৎ সিংয়ের ভক্ত ধৃত ছ’জন তার থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে স্থির করেছিলেন, নিজেদের দাবিদাওয়া, মতামত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে ভগৎ সিং-এর পদ্ধতিই অনুসরণ করবেন তারা।
ঠিক যেভাবে, সংসদে বোমা ফেলে, প্রায় স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেদের কথা জানাতে চেয়েছিলেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তেরা, ঠিক সেই ভাবেই এগোবেন তারা৷
হলুদ রং বোমা বা স্মোক ক্র্যাকার বেছে নেওয়ার পেছনেও সেই ভগৎ সিংয়ের পরিকল্পনা অনুকরণের ইচ্ছা রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। কারণ ‘কেশরী’ বা হলুদ স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং-এর প্রিয় রং।
বুধবার সংসদে স্মোক বম্ব নিয়ে হামলার পরই তদন্তের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তৈরি হয় পাঁচ সদস্যের টিম।
সেই তদন্তকারী দলের সূত্রেই জানা গিয়েছে, হামলার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল দেড় বছর আগে। পরিকল্পনায় যাতে কোনও খামতি না থাকে, তার জন্য গত বাদল অধিবেশনেও নতুন সংসদ ভবনে ভিজিটর হিসাবে ঢুকেছিলেন অভিযুক্তরা। গোটা সংসদ ভবন ঘুরে রেইকি করা হয়েছিল।
সংসদ কক্ষের ভেতরে রং বোমা ছুড়ে গ্রেফতার হয়েছেন দু’জন সাগর শর্মা ও ডি মনোরঞ্জন। ভবনের বাইরে স্লোগান তুলে ধরা পড়েন ৪২ বছরের নীলম আজাদ ও ২৫ বছরের অমল শিণ্ডে।
বাকি দু’জন যারা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ছিলেন ও চার জনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তারা হলেন বিক্রম ও ললিত ঝাঁ। নীলম হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা।
অমল মহারাষ্ট্রের লাতুরের বাসিন্দা। সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি কর্ণাটকের বাসিন্দা৷ তবে তারা আলাদা শহরে থাকেন। চার জনেরই যোগাযোগ ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব থেকে।
আলাদা আলাদা শহর থেকে তারা গুরুগ্রামে এসে দেখা করেন দেড় বছর আগে। সেখানেই এই গোটা ঘটনার ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়৷ চারজনকে আশ্রয় দেন বিশাল ও ললিত।
ছ' জনের প্রথম গোপন বৈঠক হয় দেড় বছর আগে মহীশূরে। বেকারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মণিপুর বিষয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত বলে নিজেদের মতামত বিনিময় করেন তারা। কী করে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন।
ন'মাস আগে চণ্ডীগড় বিমানবন্দরের কাছে কৃষক আন্দোলনের সময় আরও একটি বৈঠক হয় এই ছ'জনের। যেখানে পুরো পরিকল্পনাটির ছক কষা হয়।
এর মাস চারেক পর সাগর শর্মা লখনউ থেকে দিল্লি আসেন সংসদ ভবনের রেইকি করতে। সেই সময় সাগর ভবনে ঢুকতে পারেননি, কিন্তু আশপাশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে যান তিনি।
গত ১০ ডিসেম্বর সকলে দিল্লি এসে পৌঁছন। তারা ওঠেন ভিকি শর্মা নামে একজনের বাড়িতে। গতকাল তারা ইন্ডিয়া গেটের কাছে দেখা করেন।
অমল শিণ্ডে সেখানে সকলের হাতে রং বোমার কৌটোগুলি তুলে দেন। সেই স্মোক ক্র্যাকারগুলো আনা হয়েছিল মহারাষ্ট্র থেকে। তারপর বিজেপি সংসদের পাস জোগাড় করে দুজন ঢোকেন ভেতরে।
বাকিরা বাইরে থাকেন। ঘটনার পরে স্বেচ্ছায় ধরা দেন তারা।