ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পার্শ্ববর্তী এক শহরতলির বাঙালি মধ্যবিত্ত এক বাড়িতে ছুটির দিনের দুপুর। মানসী (নাম পরিবর্তিত) ভাতের পাতে আনলেন কচি পাঁঠার ঝোল।খাওয়া সেরে তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বামী বলে ওঠেন — “মাংসের স্বাদ ভালোই হয়েছে। তবে, মা যেমন রাঁধতো তেমন আর হয় না!” গত ২০-২৫ বছর ধরে, রান্না নিয়ে এমন খোঁটাই শুনতে হচ্ছে।একবারই মাত্র মানসী রেগে বলে উঠেছিলেন, “না পোষালে কাল থেকে নুন মেখে ভাত খেয়ো এর চেয়ে বেশি আমি আর পারব না।”
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রান্তে বছর আঠাশের আকাশ (নাম পরিবর্তিত) ছুটির দিনে নিজেই রান্না করে ফেলে কষা মাংস। তাঁর মতে, মা নাকি ততটা ভালো রান্না করতে পারে না। তাই, ইন্টারনেটে রেসিপি দেখে সে রান্না শিখেছে। অবশ্য তাঁকে নুন-ঝালের পরিমাণ বুঝতে, খুন্তি নাড়াতে শিখিয়েছেন তাঁর মা-ই। সেই রান্না খেয়ে এক আত্মীয় একবার যখন তার মাকে একটু বাঁকা সুরে বলেন, “ছেলেকে কি রান্না শেখাচ্ছিস?” জবাবে, আকাশের মা লক্ষী ঘোষ বলে দিয়েছিলেন, “আমাদের যুগ গেছে দিদি। এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের কাজ নিজেরাই বুঝে নিতে পারে।”
ওপরের দুটি ঘটনা ঘটেছে দুটি ভিন্ন অঞ্চলের, ভিন্ন বয়সী পুরুষকে কেন্দ্র করে। এবং তাঁদের স্ত্রী বা মায়ের অর্থাৎ একজন মহিলার কাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। এ প্রসঙ্গে, কলকাতার এক বেসরকারী স্কুলের শিক্ষিকা এবং দুই পুত্র সন্তানের মা কৃষ্ণকলি মুখার্জী জানাচ্ছেন, “একটি ছেলের ক্ষেত্রে বাইরের জগৎ, নিজস্ব চেতনা, তার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য যতটা দায়ী, বাড়ির ভেতরের পরিবেশও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি যে বাড়ির পরিবেশের কথা বলছেন সেখানে প্রাথমিকভাবে থাকেন মা-বাবারাই। আর, ঠিক সেখানেই মা’র ভূমিকা কি হতে পারে সেই নিয়ে কৃষ্ণকলি বলছেন, “আমার ছেলেরা যখন দেখে মা কাজ সেরে বাড়ি এলে বাবা সামনে এক গ্লাস জল তুলে ধরছে, তখন তাকে বোঝাতে পারি যে কেউ বাড়ি এলে তাকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেওয়ার কাজটা কোনও একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের মানুষের জন্য বরাদ্দ নয়।রান্নাঘরের কিছু কাজও সচেতনভাবে ওদের করতে দিই।” কৃষ্ণকলি মুখার্জীর মতো তরুণ প্রজন্মের অনেক মা-ই পথ দেখাচ্ছেন কীভাবে গৃহশ্রমে অংশগ্রহণ করা, পুত্র সন্তানদের মধ্যে লিঙ্গ সচেতনতা তৈরির একটা বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
আদতে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বাসিন্দা, কলকাতায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন পিংকি দাস। পিংকির দুই সন্তান — এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কীভাবে বৈষম্য দূর করার মানসিকতা তৈরি হতে পারে, তিনি জোর গলায় জানান, “আমি একজন মেয়ে; রোজগারও করি। অথচ, বাড়ির কাজও আমাকেই করতে হয়। আবার বেশি রাতে শুনশান রাস্তাতেও ভয় থাকে আমারই। চুরি ছিনতাই তো দূরে থাক। তার থেকে বেশি পুরুষের যৌনশিকার হওয়ার ভয় থাকে। তাই, আমার ছেলেকে আমি শেখাবো এমন মানুষ হতে যার জন্য কোন মেয়েকে ভয় পেতে না হয়।”
কলকাতা শহরে থাকেন পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, সুদেষ্ণা সেন। তিনি জানাচ্ছেন, “আমার ছেলে যদি এমন কোনও কথা বলে যেখানে ছেলেদের বেশি শক্তিশালী আর মেয়েদের বেশি দুর্বল বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা থাকে, ছেলেকে ভুল শুধরে দিই। ছেলের ক্লাসের বান্ধবীদের উদাহরণ তুলে এনে দেখাই যে এমন কোনও কাজ নেই যেখানে মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারে না।”
অন্যদিকে, এ বিষয়ে একটু অন্য সুরে কথা বলছেন কলকাতারই বাসিন্দা ষাটোর্দ্ধ হোম মেকার সুতপা ভট্টাচার্য। তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় ও শ্রম পরিবারেই দিয়ে এসেছেন। তাঁর কথায়, “আমি নিজে যখন বড় হয়েছি তখন মিডিয়ায় লিঙ্গ সচেতনতা নিয়ে এত কিছু জানার সুযোগ ছিল না। সেভাবে লিঙ্গ সচেতনতা নিয়ে আলাদা করে কিছু পড়াও হয়নি। সাধারণ কিছু বই, খবরের কাগজে পড়া, আত্মীয়-পরিবারের মধ্যে আড্ডা— সেখান থেকেই যতটুকু বোধ তৈরি হওয়ার হয়েছিল। অল্প বয়স থেকে বাড়ির কাজ করার কোন দক্ষতাই ছিল না। তাই, বিয়ের পর, নতুন একটি বাড়িতে যখন বাড়ির কাজের দায়িত্ব এল তখন বেশ কষ্ট হয়েছিল। না পারার জন্য যথেষ্ট গঞ্জনাও জুটেছিল। দুর্দিনে ভরসা ছিল স্বামীর সহমর্মিতা। তিনি কীভাবে এই শিক্ষাটুকু পেয়েছিলেন, আমি জানি না। তখন তো ছেলেদের কীভাবে মানুষ করতে হবে তা নিয়ে এমন আলাদা আলোচনাও হত না। যাইহোক, ঠিক এই কারণেই, মা হিসেবে আমি ছেলেকে বরাবরই বাড়ির যাবতীয় কাজে অংশ নিতেই উৎসাহ দিয়েছি।আমি চাইতাম জীবনে বেঁচে থাকার জন্য দৈনন্দিন যা দরকার তা সে স্বাধীনভাবে করুক।তাছাড়া, আলাদা করে তাকে ছেলে বা মেয়ে এই খোপের মধ্যে পৃথিবীটাকে দেখতে শেখাইনি। সেজন্য পুরুষ, মহিলা কিংবা যে কোন লিঙ্গের মানুষকে সে একই রকম ভাবে দেখবে ও বুঝবে - এই বিশ্বাস ছিল। আজ ছেলেকে দেখে বুঝি সময়ের সঙ্গে তা ঘটেছে।”
লিঙ্গ চেতনার সঙ্গে শিশুর কিংবা কিশোর মনের যোগাযোগও অবিচ্ছিন্ন। এই বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে মনোবিদ সুচেতনা সেনগুপ্ত-র সঙ্গে।সুচেতনা বর্তমানে ভারতের ‘বান্দ্রাবালা ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।তাঁর কথায়, “একজন মা-র তাঁর সন্তানকে লিঙ্গ সচেতন করে তোলার আগে তাঁর নিজের লিঙ্গ সচেতনতা থাকা দরকার। তাই, মা হিসেবে নিজে লিঙ্গ-সচেতন হওয়া এবং নিজের ভালো-খারাপের গণ্ডি তৈরি করতে হবে।” কীভাবে মায়েরা পুত্র সন্তানদের শেখাতে পারেন জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভাঙতে? সুচেতনা জানাচ্ছেন, “মা তাঁর ছেলেকে সেই সব কাজে উৎসাহিত করতে পারেন যেগুলোকে তথাকথিত মেয়েদের কাজ বলা হয়।” পাশাপাশি তিনি এও জানান একজন শিশুর সচেতন, সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে বড় হয়ে ওঠার জন্য, “বাড়িতে মা-বাবার আচরণ সুস্থ হওয়া প্রয়োজন। বাড়ির পরিবেশ একটি বাচ্চার চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারে; সে যখন দেখে বাড়ির পুরুষেরা মহিলাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দেয় না তখন কিন্তু সে তাই শেখে। তার মধ্যে এটাই ঢুকে যায় একজন পুরুষ চাইলেই যা খুশি করতে পারে।ছেলেটি বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে যদি এটা শেখে যে কেবল লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য এই পৃথিবীতে সে যা চায় তাই পেতে পারে তবে তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে, মা এমন কিছু ডিসিপ্লিন-এর মধ্যে দিয়ে তাকে বড়ো করতে পারেন যেখানে সে বুঝবে যে শুধু লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য সে যা চায় তাই পেতে পারে না। বাচ্চাকে এটাও শেখানো জরুরি যে একজন মানুষ হিসেবে উল্টোদিকের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছের মর্যাদা দিতে হয় এবং সে বিষয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হওয়া জরুরি।”