গত ১৭ ডিসেম্বর যশোর সদরের রামনগর ইউনিয়নে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন মানুষ, যাদের মধ্যে দুজনের মুখমণ্ডল কালো কাপড় এবং আরেকজনের মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা।
কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা দুজনের হাতে ছিল অস্ত্র সদৃশ বস্তু। মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকা ব্যক্তি আরবিতে কিছুক্ষণ কথা বলেন।
পরবর্তীতে জানা যায়, ভিডিওটি ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া একদল প্রতিযোগীর। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের বরাতে ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে সাংবাদিক আবু তাহের রিপন লিখেছেন, “‘যেমন খুশি তেমন সাজো’-তে ১৩-১৪ বছরের ছেলেরা হামাসযোদ্ধা সেজেছে।অস্ত্রগুলো ককশিটের বানানো যার উপরে কালো টেপ পেঁচানো। আর বক্তব্যটি অডিও ক্লিপ বেজেছে।”
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৭ সালে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসরাইল, মিশর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানও হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে।
ডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকেই এই ভিডিও শেয়ার দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এদিকে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে ঘটনা তদন্ত করে স্থানীয় পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেই মাদরাসায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই ছাত্ররা এমন পোশাকে স্টেজে উঠেছিল।
যশোর জেলার পুলিশ সুপার জিয়া উদ্দিন আহমেদ জানান, ছাত্রদের হাতে থাকা অস্ত্র ছিল কাঠ ও শোলা দিয়ে তৈরি এবং তারা 'কোনোকিছু না বুঝেই' কাজটা করে ফেলেছে।
ঘটনার দিন রাতেই মাদরাসা পরিদর্শন করে ডামি অস্ত্র এবং অন্যান্য উপকরণ নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ।
এদিকে মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী দাবী করেছেন, ছাত্ররা এই অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনয় করেছে এবং শিক্ষকদের না জানিয়েই তারা কাজটা করেছে। তবে এমন কাজ করা ঠিক হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে এমন কাজ আর কখনো করা হবে না, এই মর্মে থানায় মুচলেকা দিয়েছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী ফেসবুক ভিডিওতেও তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। ভিডিওতে তিনি জানান, বিভ্রান্তি ছড়ায় এমন সকল কাজ থেকে তারা ভবিষ্যতে বিরত থাকবেন।
এদিকে রিউমার স্ক্যানার এবং ডিসমিসল্যাব সহ একাধিক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার যাচাই করা তথ্য মতে, আসলেই এটি মাদরাসার অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপ ছিল এবং এর সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার সম্পর্ক নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সংঘটিত জঙ্গি হামলায় মারা যায় ২২ জন। সেই ঘটনার রাতেই হামলার সঙ্গে জড়িত কালো কাপড় পরা জঙ্গিদের ছবি প্রকাশ করেছিল সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস।
তাই মাদরাসার ছাত্রদের কালো কাপড় পরা এই বেশভূষার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে, তেমনি এসব আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলেও দাবী করেছেন কেউ কেউ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক ও এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে ভিডিও ক্লিপটি শেয়ার করে লেখেন, আইএস-এর বেশে দেশে উগ্রবাদের প্রচার চলছে।
তিনি লিখেছেন, “Flanked by masked and armed body guards, styled after IS, another militant leader with his face covered, can be seen offering sermons to indoctrinate audience into the path of intolerance and extremism.”
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের পোস্টটি শেয়ার করা হয়।
সশস্ত্র এই বেশভূষার সম্পূর্ণ পক্ষে না হলেও কিছুটা প্রশ্রয় দেয়ার সুরে সাংবাদিক রনি রেজা লিখেছেন, “প্রতিনিয়ত আমরা সবাই-ই যেমন খুশি তেমনই সাজি। যার মনমতো হয় সে দেয় হাততালি। আর মতের অমিল হলেই গালি।”
এদিকে লেখক ও একটিভিস্ট পারভেজ আলম লিখেছেন, “যারা খেলনা বন্দুকের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাদের উচিৎ কালো পোশাক পরে ও মুখ ডেকে হাতে বন্দুক নিয়ে প্রোফাইল পিকচার তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা। দেশে এসব ফ্যাশন নর্মালাইজ করবেন, গরীব ও কম শিক্ষিত মানুষের সন্তানদের ঠেলে দেবেন জিওপলিটিকাল এবং আন্তর্জাতিক কালচার ওয়ারের ময়দানে, আর নিজে কোন দায় না নিয়ে মধ্যবিত্ত্ব ভন্ডামি অব্যাহত রাখবেন, তা তো হতে পারে না।”
সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক শেখ আহমাদ শাহ তার পোস্টের একাংশে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কেন বিবেচনা করা যাবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেহেতু মাদরাসা কর্তৃপক্ষসহ অনেকের মতেই ছাত্ররা পরিধান করেছিল হামাস কর্মীদের বেশভূষা। তিনি লিখেছেন, “সেই সাজকে সন্ত্রাসীদের সাজ বলতে যাদের আপত্তি, তাদের জন্য প্রশ্ন, ৮১৫ জন সিভিলিয়ানকে হত্যা করার পরও আপনার সন্ত্রাসী বলতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে। তাহলে কতজন সিভিলিয়ানকে মারলে তারপর আপনি সন্ত্রাসী বলতে পারতেন?”
সংবাদকর্মী নূর উদ্দিন মুরাদ ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের এমন বেশভূষার উৎস ও সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা এ ড্রেসে ভাবভঙ্গিতে বক্তব্য দিতে কখনো দেখা গেছে? তারা মুখকে কখনো এভাবে লুকিয়ে ছিল? আমার মতে এ ভিডিও ওই মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের কুৎসিত ভাবে উপস্থাপন হয়েছে।”
সাংবাদিক মাহবুবুর আলম সোহাগ এই ঘটনা থেকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, “যেমন খুশি তেমন ইচ্ছে করলেই সাজা যায় না, সাজতে হয় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি অনেক কিছু বুঝতে হয়। দেশ ভালো সময় অতিক্রম করছে না। আসুন সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হই। সমাজে যেকোনো ম্যাসেজ ছড়ানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি।”
উদ্যোক্তা রিজওয়ান হোসেন ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, “এই ধরনের নাটক করতে গেলে উচিৎ বাংলাতে করা। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষই আরবী জানেনা। তখন তথ্য মিসলিড হয়। আর এমন সেন্সেটিভ বিষয়ে নাটক করার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকতে ব্যানারের পিছনেও ছোট করে সতর্কতা দেয়া যেতে পারে।”
ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশী লেখক তসলিমা নাসরিনও ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরে এর সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে দাবী করেছিলেন। পরবর্তী এক পোস্টে তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে নিলেও এমন অভিনয় ও বেশভূষার সমালোচনা করে লিখেছেন, “যেহেতু বন্দুকে লেখা ছিল না খেলনা বন্দুক, যেহেতু সন্ত্রাসীদের পোশাকে লেখা ছিল না অভিনয়ের পোশাক, তাই অনেকেই বুঝতে পারেনি যে অভিনয় চলছে। আমিও বুঝতে পারিনি।”
ঘটনাটির বিচার দাবী করেছেন অ্যাকটিভিস্ট ফুয়াদ সাকী। তিনি লিখেছেন, “আমার মনে হয়েছে এটা পরিকল্পিতভাবে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর বিচার হওয়া আবশ্যক।”
আহসানুল মাহবুব জুবায়ের লিখেছেন, “শিক্ষার্থীরা ছোটো, তাদের বুঝাপড়ার ঘাটতি থাকতেই পারে। কিন্তু মাদ্রাসা কতৃপক্ষের যথেষ্ট গাফেলতি হয়েছে এমন ছবি/ভিডিও প্রমোট করায়। এসব এখন জগাখিচুরি মিশিয়ে দেশ বিরোধীরা যা ইচ্ছে গল্প বানাচ্ছে।”