৭৩ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন বিশ্বখ্যাত তবলাশিল্পী জাকির হুসেন। সোমবার তার পরিবার নিশ্চিত করেছে, সান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালে ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিসে ভুগে তার মৃত্যু হয়েছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া এই শিল্পীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সঙ্গীত জগৎ।
জাকির হুসেনের জন্ম ১৯৫১ সালের ৯ মার্চ, মুম্বইতে। তাঁর বাবা ছিলেন কিংবদন্তি তবলাশিল্পী আল্লা রাখা। প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন আল্লা রাখা। এক সাক্ষাৎকারে জাকির জানিয়েছিলেন, তাঁর জন্মের পর প্রথমবার বাবা তাঁকে কোলে নিয়ে প্রার্থনার বদলে তবলার তালে তালে মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন।
জাকির হুসেনের প্রয়াণের পরে আবার নতুন করে সামনে এসেছে, কয়েক বছর আগের সেই সাক্ষাৎকার। তাতে জাকির হুসেনকে বলতে শোনা গেছে, “আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে বাবা কোলে নিলেন। আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য ছিল শিশুর কানে প্রার্থনা শোনানো। কিন্তু বাবা আমার কানে তবলার বোল বলেছিলেন। মা খুব রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি কী করছো? প্রার্থনা করতে বলছি, আর তুমি তবলার তাল শোনাচ্ছো!”
বাবা আল্লা রাখা তখন বলেছিলেন, “এটাই আমার প্রার্থনা। আমি মা সরস্বতী ও ভগবান গণেশের পূজারী। আমার শিক্ষকরা আমাকে যা দিয়েছেন, তা-ই আমি আমার সন্তানের মধ্যে পৌঁছে দিতে চাই।”
জাকিরের প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
মুম্বাইয়ের সেন্ট মাইকেলস স্কুল থেকে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন জাকির হুসেন। এরপর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক হন। শুরুর দিনগুলো সহজ ছিল না জাকিরের। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ট্রেনে যাতায়াত করার সময় বসার জায়গা না পেলে খবরের কাগজ পেতে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তেন তিনি।
তবে তবলার প্রতি তার ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বলতেন, “তবলায় কারও পা লেগে যাক, আমি তা মেনে নিতে পারতাম না। তাই তবলাকে কোলে নিয়েই ঘুমোতাম।”
মায়ের ইচ্ছা ও তবলার পথে যাত্রা
এক সাক্ষাৎকারে উস্তাদ বলেছিলেন, তার মা চাননি তিনি তবলা বাজিয়ে জীবনযাপন করুন। সঙ্গীত তখনও সামাজিকভাবে সম্মানজনক পেশা হিসাবে গণ্য হত না। তিনি বলেছিলেন, অনেক সময় অনুষ্ঠান শেষে তাকে খাবার দিয়েই সম্মান জানানো হত। তবে তার পিতা, তবলার কিংবদন্তি উস্তাদ আল্লারাখা, তার জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন।
সঙ্গীত জীবনের সূচনা ও অর্জন
মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে প্রথম মঞ্চে ওঠেন জাকির সেখানেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খান, বিসমিল্লাহ খান, পণ্ডিত শান্ত প্রসাদ ও পণ্ডিত কিষণ মহারাজের মতো কিংবদন্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে পারফরম্যান্সের জন্য তাঁকে পাঁচ টাকা সম্মানী দেওয়া হয়।
সেই স্মৃতি রোমন্থন করে জাকির বলেছিলেন, “আমি জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করেছি, কিন্তু সেই পাঁচ টাকার মূল্য আমার কাছে অসীম।”
জাকির হুসেন তবলাকে বিশ্বমঞ্চে নতুন পরিচিতি দেন তার অনন্য প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে। তার দক্ষতা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি জ্যাজ, ফিউশন-সহ নানা ধারার সঙ্গীতে সমাদৃত হয়েছিল।
জীবনের কঠিন সময় ও বিদেশে সংগ্রাম
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জিন্স পরা আর রকস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জাকির হুসেন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানকার কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। সপ্তাহে মাত্র ২৫ ডলারে দিন কাটানো, একটি সবজির ঝোল বারবার গরম করে খাওয়ার মতো কঠিন সময়ও তিনি দেখেছেন।
তবলার মর্যাদা বৃদ্ধিতে অবদান
গানের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য তবলার যে ভূমিকা, তা থেকে এই বাদ্যযন্ত্রকে স্বাধীন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উস্তাদ জাকির হুসেনের ভূমিকা অসামান্য। তিনি বলেছিলেন, "আমার এই সাফল্যের পেছনে অন্তত দুই প্রজন্মের কঠোর পরিশ্রম রয়েছে। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন তবলা নিয়ে আর অবহেলার জায়গাই ছিল না।"
পুরস্কার ও সম্মান
জাকির হুসেনের কাজ সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। অবদানের স্বীকৃতিতে তাঁকে একাধিক মর্যাদাপূর্ণ সম্মানে ভূষিত করা হয়:
- ১৯৮৮ সালে পদ্মশ্রী
- ২০০২ সালে পদ্মভূষণ
- ২০২৩ সালে পদ্মবিভূষণ
- চারবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
সঙ্গীত জগতে শোকের ছায়া
তার প্রয়াণে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে সঙ্গীত জগৎ। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেছেন। চলচ্চিত্র থেকে সঙ্গীত মহল— সব জায়গাতেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সঙ্গীতের পূজারি ছিলেন।