অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মালদ্বীপের চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু দিল্লি গিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্ক 'রিসেট' করলেন


সম্পর্ক রিসেটঃ নয়া দিল্লির হায়দেরাবাদ হাউসে বৈঠকের আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুইজ্জু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করমর্দন করেন। ফটোঃ ৭ অক্টোবর, ২০২৪।
সম্পর্ক রিসেটঃ নয়া দিল্লির হায়দেরাবাদ হাউসে বৈঠকের আগে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুইজ্জু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করমর্দন করেন। ফটোঃ ৭ অক্টোবর, ২০২৪।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুইজ্জু এক বছর আগে দায়িত্ব গ্রহণ করে চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সোমবার ভারত এবং মালদ্বীপ তাদের সম্পর্ক 'রিসেট' করে নতুন করে উন্নত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভারতেরে সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দিল্লি সফর এসেছে এমন সময়ে, যখন ভারতীয় মহাসাগরের এই দীপপুঞ্জ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

মুইজ্জু ক্ষমতায় এসে তাঁর দেশে ভারতের প্রভাব কমিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করার এক বছর পর এই সফর দু’দেশের সম্পর্কে মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

“মালদ্বীপের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার এবং তারা সব সময় মালদ্বীপের প্রয়োজনে আমাদের পাশে ছিল” মুইজ্জু সোমবার সাংবাদিকদের নয়া দিল্লিতে বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মুইজ্জু ভারতে আসেন যখন তাঁর ছোট দেশ অর্থনৈতিক মন্দার সাথে লড়াই করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে মালদ্বীপ ঋণ খেলাপি হবার ঝুঁকিতে আছে।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলেন তিনি আর্থিক সাহায্য চাইছেন।

India's Prime Minister Narendra Modi (R) and Maldives President Mohamed Muizzu virtually inaugurate the new runway at Maldives' Hanimadhoo International Airport, during a joint media briefing at the Hyderabad House in New Delhi on October 7, 2024.
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুইজ্জু দিল্লির হায়দেরাবাদ হাউস থেকে অনলাইনে মালদ্বীপের হানিমান্ধু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নতুন রানওয়ের উদ্বোধন করেন। ফটোঃ ৭ অক্টোবর, ২০২৪।

ভারত একটি আর্থিক সাহায্য প্যাকেজ-এ সম্মত হয়েছে, যার মধ্যে ৪০ কোটি ডলারের মুদ্রা বিনিময় চুক্তি অন্তর্ভুক্ত। সহযোগিতা জোরদার করতে নয়া দিল্লি যেসব চুক্তির কথা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মালদ্বীপে একটি নতুন বন্দর নির্মাণ এবং প্রধান দ্বীপগুলোর মধ্যে আধুনিক পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে কাজ ত্বরান্বিত করা।

দু’দেশ শুল্ক-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করার পরিকল্পনাও করছে।

মালদ্বীপকে “একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু” হিসেবে বর্ণনা করে মোদী বলেন যে, “আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আমরা একটি সার্বিক অর্থনৈতিক এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা পার্টনারশিপ গ্রহণ করেছি।”

মুইজ্জুর পাঁচ দিনের ভারত সফর বৃহস্পতিবার শেষ হবার কথা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত করতে সক্ষম হয়েছে।

মুইজ্জুর চীনপন্থি অবস্থান তাঁর পূর্বসূরির নীতি উল্টে দিয়েছিল। তাঁর পূর্বসূরি বেইজিং-এর কাছে মালদ্বীপের ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু চীনে যান। বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল-এ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁকে স্বাগত জানান। ফাইল ফটোঃ ১০ জানুয়ারি, ২০২৪।
দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু চীনে যান। বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল-এ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁকে স্বাগত জানান। ফাইল ফটোঃ ১০ জানুয়ারি, ২০২৪।

প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতে আসার আগেই জানুয়ারিতে বেইজিং সফর করেন, যেটা ভারতে একটি কূটনৈতিক অপমান হিসেবে দেখা হয়েছিল। কারণ, মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফরে নয়া দিল্লি যাওয়ার যে দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ ছিল, মুইজ্জু সেটা ভঙ্গ করেন।

তাঁর প্রশাসন বেইজিং-এর সাথে একটি সামরিক সহায়তা চুক্তি সই করে এবং চীনের একটি গবেষণা জাহাজকে মালদ্বীপের বন্দরে নোঙ্গর ফেলতে দেয়। বছরের আগের দিকে, দুর্যোগ এবং মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য যে ৮০জন ভারতীয় সৈন্য মালদ্বীপে অবস্থান করছিল, মুইজ্জু তাদের চলে যেতে বলেন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর সরকারের ভারত-বিরোধী অবস্থান সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বদলেছে, এবং দু’দেশ তাদের সম্পর্ক মেরামত করতে সচেষ্ট হয়েছে।

তারা বলছেন, প্রায় ১,২০০ ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ খাদ্যদ্রব্যের মত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির জন্য তাদের বিশাল প্রতিবেশীর উপর নির্ভরশীল। শত শত মালদিভিয়ান ভারতে যায় স্বাস্থ্য সেবার জন্য।

প্রায় ১,২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভারতীয় মহাসাগরের দেশ মালদ্বীপ।ছবিতে পর্যটকদের সাদা বালুর বিচে আরাম করতে দেখা যাচ্ছে। ফাইল ফটোঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
প্রায় ১,২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভারতীয় মহাসাগরের দেশ মালদ্বীপ।ছবিতে পর্যটকদের সাদা বালুর বিচে আরাম করতে দেখা যাচ্ছে। ফাইল ফটোঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১২।

ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমানো সহজ কাজ হবে না।

“প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু যখন উপলব্ধি করলেন যে, ভারতকে চটিয়ে কোন কাজ হবে না, বিশেষ করে এই অঞ্চলে ভারতের মত অর্থনৈতিক শক্তির কাছ থেকে যে ধরনের সমর্থন তাঁর প্রয়োজন হতে পারে, তখন হিসেব-নিকেশ বদলাতে থাকল,” বলছেন হার্শ পান্ত, যিনি নয়া দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে পররাষ্ট্র নীতির ভাইস প্রেসিডেন্ট।

“সে’কারণেই মুইজ্জু প্রশাসনে ভারত-বিরোধী মতামত ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারিয়েছে,” পান্ত ভিওএ-কে বলেন।

চীন সম্প্রতি ভারতীয় মহাসাগরে তার উপস্থিতি সম্প্রসারণ করছে। সেই পটভূমিতে মালদ্বীপ চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার ফলে আঞ্চলিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে ভারতে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, মুইজ্জু নয়া দিল্লিতে সে প্রসঙ্গে কথা বলেন।

“আমরা নিশ্চিত যে, অন্য দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করবে না,” মুইজ্জু টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

ভারত আশ্বস্ত

কালিঙ্গা ইন্সটিটিউট অফ ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ-এর চিন্তামণি মহাপাত্র’র মতে, এই বক্তব্য নয়া দিল্লিতে ভারতের জন্য কৌশলগত বিপত্তি নিয়ে উদ্বেগ কমিয়ে আনবে।

“যে লোক ভারতের সামরিক লোকজনকে মালদ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে, তাঁর কাছ থেকে এই কথা বেশ আশ্বস্ত করার মত,” মহাপাত্র ভিওএ-কে বলেন।

মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক পুনরায় চালু করা ভারতের জন্য সহায়ক হবে এই সময়ে, যখন তার সামনে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ আসছে। যেমন বাংলাদেশ, যেখানে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগাস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন।

বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, হাসিনাকে সমর্থন করার জন্য অনেকে নয়া দিল্লিকে দোষারোপ করে।

“এটা ভারতকে একটা সুযোগ দিবে এই অঞ্চলে নিজের মর্যাদা তুলে ধরার। তারা বলতে পারবে, আমরা এই অঞ্চলে বিপদে পড়া ছোট দেশগুলোকে তাদের সঙ্কটের সময় সাহায্য করতে ইচ্ছুক। একই সাথে, মালদ্বীপের অর্থনীতি যাতে বিপদে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করাও ভারতের স্বার্থে,” পান্ত বলেন। “অর্থনৈতিক ভাবে এই অঞ্চলে অনেক অস্থিরতা রয়েছে।”

গত দু’দশকে মালদ্বীপ নিয়ে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি চীন এবং ভারতের মধ্যে ভু-রাজনৈতিক টানা-হেঁচড়া দেখা গেছে। মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে অবস্থিত, যেখান থেকে সামুদ্রিক পথগুলোর উপর নজর রাখা যায়।

বিশ্লেষক মহাপাত্রর মতে, বৈশ্বিক অশান্তির সময় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।

“দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটা ভাল একটি ঘটনা। এই জটিল সময়ে দুটো যুদ্ধ চলছে, ইউরোপে একটা এবং পশ্চিম এশিয়াতে আরেকটা, যার ফলে জ্বালানী সরবরাহে অনেক জটিলতা এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে,” মহাপাত্র বলেন।

XS
SM
MD
LG