গাজায় ইরান-সমর্থিত হামাস গোষ্ঠীর সাথে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের এই মিত্রকে লেবাননের হিজবুল্লাহসহ তেহরানের অন্যান্য সহযোগী গোষ্ঠী এবং ইরানের বিরুদ্ধে সংঘাত ছড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন সেই সময় এসে গেছে।
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১০ দিনে ইসরায়েল লেবাননে একটি ব্যাপক বিমান অভিযান চালিয়ে হিজবুল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট ৩,৬০০ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে, তাদের ভাষায়, “সীমিত আকারে” স্থল অভিযান শুরু করে।
গত মঙ্গলবার তেহরান ইসরায়েলের উপর ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও পাল্টা হামলা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে, সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে দামেস্কে মঙ্গলবার ইসরায়েলি হামলায় তিনজন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। বুধবারে সিরিয়ার রাজধানীতে আরও হামলা হয়েছে।
বাইডেন বলেছেন তাঁর প্রশাসন ইসরায়েলকে “পরামর্শ” দিচ্ছে এবং পাল্টা জবাব যেন সমানুপাতিক হয়। তিনি বুধবার সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি বিষয়টি নিয়ে জি-সেভেন (সাতটি উন্নত পশ্চিমা দেশের গ্রুপ)-এর নেতাদের সাথে আলাপ করেছেন এবং তিনি “শীঘ্রই” নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলতে পারেন।
“আমরা ইসরায়েলিদের সাথে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলবো, কিন্তু আমরা সাতজনই (জি-সেভেন নেতা) একমত যে ইসরায়েলের জবাব দেয়ার অধিকার আছে, কিন্তু তাদের উচিত আনুপাতিক হারে জবাব দেয়া,” বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন।
নেতানিয়াহু ইরানের বাইরেও পাল্টা আঘাত হানার হুমকি দিয়েছেন, যেসব দেশে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী রয়েছে।
“আমরা এই অশুভ অক্ষর বিরুদ্ধে সব জায়গাতেই লড়াই করি,” তিনি মঙ্গলবার বলেন। “এটা জুডিয়া এবং সামারিয়ার (পশ্চিম তীর) বেলায় সত্য। এটা গাজা, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়ার ক্ষেত্রে সত্য। এবং এটা ইরানের ক্ষেত্রেও সত্য।”
ইরান অনেক বছর ধরে ইসরায়েলে আক্রমণ করতে তার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করেছে – গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুথি।
ইরান এপ্রিল মাসে প্রথমবারের মত ইসরায়েল সরাসরি হামলা চালায় – যখন তারা এক রাশ ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন নিক্ষেপ করে। এই হামলা আসে সিরিয়াতে ইরানের কূটনৈতিক ভবনে ইসরায়েলের মারাত্মক হামলার দুই সপ্তাহ পর।
সেই সময়, ইসরায়েলের পাল্টা হামলা ছিল সীমিত এবং অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এমন ভাবে করা যাতে উত্তেজনা কমে আসে। তারা বলছেন, ইসরায়েল এবার আরও শক্তভাবে জবাব দেবে, হয়তো ইরানের পারমাণবিক বা জ্বালানী স্থাপনা লক্ষ্য করে।
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, বাইডেন বলেন তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় কোনও ইসরায়েলি আক্রমণ সমর্থন করবেন না। তিনি বলেন ইরানের উপর জি-সেভেন আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
তেহরান বলেছে তাদের মঙ্গলবারের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সাম্প্রতিক সময়ে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে বৈরুতে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহকে তেহরানে এবং একজন ইরানি সামরিক কমান্ডারকে হত্যা করার জবাবে করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা
ওয়াশিংটন আশঙ্কা করছে, উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেলে এবং ইরান যদি আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে ইরান যদি আমেরিকান স্বার্থ আঘাত করে।
“সেটা হতে পারে সৌদি আরবে তেল-উৎপাদনকারী স্থাপনার উপর হামলা,” বলছেন কারনেজি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর ডেভিড মিলার, যিনি এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। “সেটার মানে হতে পারে সিরিয়া এবং ইরাকে ইরান-সমর্থিত গ্রুপদের আমেরিকান বাহিনীকে আক্রমণ করার সক্ষমতা দেয়া।”
“এবং হ্যাঁ, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার একটি রাস্তা তৈরি হতে পারে,” তিনি ভিওএ-কে বলেন।
অন্যান্য বিদেশি শক্তির তুলনায়, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রর সামরিক উপস্থিতি সবচেয়ে বড়, এবং তারা ইতোমধ্যে পরোক্ষভাবে জড়িত।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের দুটো নৌজাহাজ মঙ্গলবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার লক্ষ্যে এক ডজন ইন্টারসেপ্টার রকেট নিক্ষেপ করে, জানান পেন্টাগন মুখপাত্র মেজর জেনেরাল প্যাট রাইডার।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে দোষারোপ করেন।
“এই অঞ্চল থেকে যদি তারা বিতাড়িত হয়, কোন সন্দেহ নেই এইসব সংঘাত, যুদ্ধ এবং সহিংসতা পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে,” খামেনেই বলেন।
হোয়াইট হাউস মন্তব্যের জন্য ভিওএ-র অনুরোধের কোন জবাব দেয়নি।
বাইডেন প্রশাসন 'দর্শক'
বাইডেন ইরানের উপর সরাসরি হামলা করবেন কি না, সেটা পরিষ্কার না। তবে যেটা পরিষ্কার, তা হল, গাজা এবং লেবাননে যুদ্ধ বিরতির জন্য বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও, ওয়াশিংটন সংঘাত নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় নাই।
“আজ মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তারা, যারা এইসব সামরিক কর্মকাণ্ডে জড়িত,” বলছেন মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট-এর সিনিয়র ফেলো ব্রায়ান কাটুলিস।
কাটুলিস বলছেন, ওয়াশিংটন মূলত “দর্শক”-এর ভূমিকা পালন করছে এবং সবচেয়ে খারাপ পরিণতি যাতে না হয়, সেই চেষ্টা করছে। বাইডেন প্রশাসনের পন্থা হচ্ছে “মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, সঙ্কট সামলানোর কাজ”, তিনি যোগ করেন।
এ’পর্যন্ত বাইডেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির সাথে সামরিক সাহায্যকে যুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন - সামরিক সাহায্য ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে তাঁর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তিনি এবং তাঁর প্রশাসন প্রায়ই জোর দিয়ে বলেন যে, তারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করেন।
মিলার বলছেন, বাইডেন ইসরায়েলের জন্য সামরিক সাহায্য কমিয়ে দেবেন, এ’কথা “এখন প্রায় চিন্তার বাইরে।” তাছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না, তিনি বলেন।
গত কয়েক সপ্তাহে, একটি সামরিক শক্তি হিসেবে হিজবুল্লাহর সক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়েছে। এবং ইসরায়েলি অভিযানে প্রায় এক বছর আক্রান্ত হবার পর হামাসের আর কোনও সুশৃঙ্খল সামরিক কাঠামো নেই।
ইসরায়েলকে তাদের মিত্র গোষ্ঠী দিয়ে ঘিরে রাখতে ইরানের কৌশলের দিকে ইঙ্গিত করে মিলার বলেন, “ইরানিরা আর প্রতিরোধের অক্ষ যাকে আগুনের বলয় বলে থাকে, সেটা ভেঙ্গে দিতে ইসরায়েল এখন বদ্ধপরিকর।”
তবে ইসরায়েল যদি সফল হয়ও, মিলার বলেন তারা সামরিক বিজয়কে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় পরিণত করতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান।
মিলার মনে করছেন, ইসরায়েলের সাথে হামাস, হিজবুল্লাহ আর ইরানের চলমান তিনটি যুদ্ধ চলতে থাকবে, তবে তীব্রতা হবে তুলনামুলকভাবে কম।
নাতাশা মযগোভায়া এই রিপোর্টে অবদান রেখেছেন।