শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন সমন্বয়করা, এমন একটি ভিডিও সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ভিডিওতে নবনিযুক্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. ইসমাইল হোসেনকে শপথ গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) এই দুই শিক্ষক নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সেদিন বিকেলে নতুন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। বৈঠকের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন দায়ত্বশীলদের শপথবাক্য পাঠ করানো হয়, যেই ঘটনার ভিডিও প্রকাশিত হলে সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
ভিডিওতে দেখা যায়, এই শিক্ষকদের শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন শাবিপ্রবির ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পলাশ বখতিয়ার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে পলাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহ-সমন্বয়ক। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে প্রচারিত হয়েছে।
কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন নেটিজেনরা
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “স্বপ্নে দেখলাম, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সমন্বয়ক এথেন্সের এক বাজারে বসে সক্রেটিসরে শপথ পড়াচ্ছে।”
শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে সমালোচনা করেছেন আরো অনেকে।
সাংবাদিক মাহবুব হাসান রিপন শপথ গ্রহণের ভিডিও শেয়ার করে লেখেন, “সম্ভবত আমাদের দেশে সবচেয়ে অভিশপ্ত একটি পেশার নাম শিক্ষকতা। ছাত্রলীগের আমলে মান সম্মানের ভয়ে তাদেরকে তোয়াজ করে চলতে হতো। এখন সমন্বয়কদের তোয়াজ করে চলতে হচ্ছে।”
লেখক ও কলামিস্ট ফসিউল আলম ভুঁইয়া তার ফেসবুক পোস্টে ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “ছাত্র সমন্বয়করা তাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকদের সাথে এরূপ আচরণ করলো কেন?
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় না মগের মুল্লুক কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না!”
তবে ছাত্রদের পাশাপাশি অনেকে শিক্ষকদেরও সমালোচনা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘বল স্টেট ইউনিভার্সিটি’র শিক্ষক ও পরিসংখ্যানবিদ রহমতুল্লাহ ইমন লিখেছেন, “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কতটা মেরুদন্ডহীন আর লোভী হলে হাফ এডুকেটেড চ্যাংড়ারা তাদের শপথ বাক্য পড়াতে পারে।”
অনেকে এ ধরনের হঠকারিতার বিচার চেয়েছেন ও শিক্ষকদের পদত্যাগ দাবী করেছেন।
চিকিৎসক মাহবুব জামান বাবু তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “সমন্বয়ক দ্বারা শপথ নেওয়া শাবিপ্রবি মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকদের পদচ্যুত করা হোক। সংশ্লিষ্ট সমন্বয়কদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।”
লেখক ও শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র আমিনুল ইসলাম শপথ চলাকালীন উপস্থিত থাকা সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিবকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “শিক্ষকদের এই যে তোমরা এক রকম অপমান করলে। এখন এই শিক্ষকরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে? নাকি ভয়ে চুপ থাকবে?
এর মানে কি দাঁড়ালো? তোমাদের দাসত্ব স্বীকার করে নিতে হচ্ছে শিক্ষকদের।
তাহলে তো সেই একই সিস্টেম থেকে গেলো। এত বড় একটা অন্যায় করার পরও তোমরা এখন পর্যন্ত ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাও নি।”
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনি আসাদুজ্জামান লিখেছেন, “স্বাধীনতা ও নীতি নিয়ে চলতে না পারলে ভিসি, প্রো ভিসি, ট্রেজারার কেন রাষ্ট্রপতি পদও অর্থহীন।”
সাংবাদিক সাদিক মাহবুব ইসলাম এই ঘটনার সাথে সাম্প্রতিক কালে স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হয়রানির ঘটনার তুলনা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “সাস্টের ঘটনার পর এই প্রশ্ন ওঠা উচিত - আন্দোলন শেষে সমন্বয়কদের কাজটা আসলে কী? মাতবরি করে বেড়ানো? বিপ্লব শেষে পুনর্গঠনের সময় এক্সপার্ট লাগবে, অভিজ্ঞ লোক লাগবে৷ সবখানে অর্বাচীন পাঁঠা হয়ে নাক গলাইতে হবে কেন? স্কুল কলেজে পর্যন্ত সমন্বয়ক নামধারীরা তামাশা করছে। এসবের দায়টা কার?”
সমন্বয়কদের সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ লিখেছেন, “দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল সমন্বয়কদের প্রতি জেনারালাইজড করে আমি বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই ক্রমাগত বলেছি, আবারও বলছি— কোথায় থামতে হয়, সেটা জানা উচিৎ। স্বাধীনতা মানে শুধু অবিরাম যা খুশি তাই এক্সারসাইজ করা না। কোথায় কোথায় থামতে হবে, এটা জানাটাও স্বাধীনতা টিকায়ে রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট।”
সমালোচনার মুখে শাবিপ্রবি সমন্বয়করা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "এটি আনুষ্ঠানিক কোনো শপথ অনুষ্ঠান ছিল না। নতুন প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় ছিল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।"
সহ-সমন্বয়ক পলাশ বখতিয়ার বলেন, "শিক্ষকরা আমাদের শ্রদ্ধারপাত্র। তাদের অসম্মান হোক সেটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা স্যারদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।"
এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "এটার ভিডিও দেখেছি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, তারা ব্যাখ্যা দিয়েছে যে- জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধরে রাখতে এই শপথ পাঠ করিয়েছে। কিন্তু উপস্থাপনের ভুলের কারণে একটা নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি প্রচার হয়েছে। এই জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে।"
তিনি বলেন, "আমাদের অবস্থান থেকে যেটা সব সময় বলে আসছি যে, শুধু সমন্বয়ক নয়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ এমন কোনো কাজ করা উচিত না। যেটা আইন বিরোধী। আমরা আইনের শাসন চাই। ফলে, যার যে কাজ তার সেটা করা উচিত।"
"সেই জায়গা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শপথ পাঠ করিয়ে তারা অন্যায় করেছে। আমাদের জায়গা থেকে তাদেরকে সর্তক করেছি। এটা নিয়ে আমাদের পরবর্তী ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে" বলেও উল্লেখ করেন কেন্দ্রীয় এই সমন্বয়ক।
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন আদিত্য রিমন।)