অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

তুরস্কের বিশাল গুহা নগরীর প্রাচীন রহস্য উন্মোচন


তুরস্কের মারডিন প্রদেশের মিদিয়াত শহরের নিচে ভূগর্ভস্থ শহর মেটিয়েট-এ কাজ করছেন একজন মিউনিসিপাল কর্মী। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।
তুরস্কের মারডিন প্রদেশের মিদিয়াত শহরের নিচে ভূগর্ভস্থ শহর মেটিয়েট-এ কাজ করছেন একজন মিউনিসিপাল কর্মী। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একটি বাড়ির নীচতলার দরজা দিয়েই আবিষ্কৃত হলো সম্ভবত দেশের সবচাইতে বড় বিস্তৃর্ণ একটি কেইভ বা গুহা শহর। একজন ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন যে যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে নবম শতাব্দীতে গুহার ভেতরে একটি শহর তৈরি করা হয়েছিল।

সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি মিদিয়াতে ২০২০ সালে একটি বাড়িতে ওয়াইন সেলারগুলিতে খনন কাজ করার সময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা “প্রায় অনভিপ্রতভাবেই” একটি শহরের-নিচে-শহর আবিষ্কার করেন। তারা গোলকধাঁধামত বিশাল কেইভ সিটি বা গুহা-শহর আবিষ্কার করেন।

এরই মাঝে মাটির গভীর তলদেশে গুহা খোদাইকারী কর্মীরা ৫০টিরও বেশি গোপন কক্ষ আবিষ্কার করেন। ঘরগুলো ১২০ মিটার সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে সংযুক্ত, যা পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল।

তবে এটাই সব নয়, অনুমানিক প্রায় ৯ লক্ষ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে যে ভূগর্ভস্থ শহর অবিস্কৃত হয়েছে, এটা হচ্ছে তারই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। অর্থাৎ, এটাই তুরস্কের দক্ষিণে আনাতোলিয়ার বৃহত্তম গুহা-শহর।

“সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় হতে পারে,” বলেন মেরভান ইয়াভুয যিনি মিদিয়াতের সংরক্ষণ পরিচালক এবং প্রত্নতাত্বিতক কাজের তত্বাবধানে নিয়োজিত।

The conservation director of the town of Midyat Mervan Yavuz poses during an interview inside the Matiate archaeological site underneath the town in Midyat in Mardin province, southeastern Turkey, on July 1, 2024.
মিদিয়াতের সংরক্ষণ পরিচালক মেরভান ইয়াভুয মেটিয়েটে সুরঙ্গপথে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

ইয়াভুয আরও বলেন, “আবহাওয়া, শত্রু, হত্যাকারী এবং রোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মানুষ ঐ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং তাকে তারা সত্যিকারের একটি শহরে পরিণত করেছিল।”

দ্বিতীয় অসুরনাসিরপাল-এর রাজ্য

এই ইতিহাসবিদ প্রাচীন শহরের শুরুটা চিহ্নিত করেন রাজা দ্বিতীয় অসুরনাসিরপাল-এর সময় থেকে, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৮৮৩ থেকে ৮৫৯ সাল পর্যন্ত নব্য-আসিরিয়ান সাম্রাজ্য শাসন করেন।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, সাম্রাজ্যটি পূর্বে উপসাগর থেকে পশ্চিমে মিশর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল।

প্রাচীন আসিরিয়ান ভাষায় মেটিয়েট (গুহার শহর) নামক শহরটিতে প্রবেশের জন্য মানুষকে নিচের দিকে ঝুঁকে পুরো বাঁকা হয়ে গোলাকৃতির দরজা দিয়ে নিজেকে ঠেলে ঢুকাতে হতো

মিদিয়াত পৌরসভা এই প্রবেশদ্বারটি থেকেই প্রথম তাদের ঐ ভূগর্ভস্থ শহরের অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিল।

অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই “আমরা সন্দেহ করেছিলাম যে এখানে প্রবেশদ্বারের অস্তিত্ব নিশ্চিয় রয়েছে," ইয়াভুয বলেন।

"উনিশ'শ সত্তরের দশকে মেঝে ধসে পড়লে একটি নির্মাণ যন্ত্র পড়ে যায়। কিন্তু সেই সময় আমরা আর কিছু জানার চেষ্টা করিনি, আমরা কেবল গর্তটি শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম।"

This aerial view shows municipal employees working outside the Matiate archaeological site underneath the town in Midyat in Mardin province, southeastern Turkey, on July 1, 2024.
উপর থেকে তোলা ছবিতে মিদিয়াতের নিচে মেটিয়েটে পৌর কর্মীদের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

মাটির নিচে গোপন স্থান

গুহা শহরটি যে অঞ্চলে অবস্থিত তা একসময় মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত ছিল যা বিশ্বের প্রাচীনতম কিছু সভ্যতার ব্যুৎপত্তি হিসাবে স্বীকৃত।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য এই অঞ্চল জয় করেছে বা এর ভেতর দিয়ে গিয়েছে। ফলে মেটিয়েট-এর আশেপাশের অধিবাসীদের হয়তো গুহায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

"আরবদের আগমনের আগে এই এলাকাটি নিয়ে আসিরিয়ান, পার্শিয়ান , রোমান এবং তারপরে বাইজেন্টাইনদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল," বলছেন একরেম আকমান, স্থানীয় মারদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ।

ইয়াভুয উল্লেখ করেছেন যে “হাতায় অঞ্চলের খ্রিস্টানরা রোমান সাম্রাজ্যের নিপীড়ন থেকে পালিয়ে তাদের আক্রমণ এড়াতে পাহাড়ে মঠ তৈরি করেছিল।”

তিনি সন্দেহ করেন যে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাদের সে সময়ে নিষিদ্ধ ধর্ম চর্চার জন্য গোপন জায়গা হিসেবে মেটিয়েটকে ব্যবহার করতেন।

তিনি দেয়ালে বিশেষ আকৃতিতে খোদাই করা জিনিসগুলির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, যেমন একটি ঘোড়া, একটি আট-কোণাকৃতির তারা, একটি হাত, গাছ – আবার আরেকটি ঘরের মেঝেতে একটি পাথরের খন্ড রাখা যা আনুষ্ঠানিক কোন কাজে জন্তু বলি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।

A municipal employee walks inside the Matiate archaeological site underneath the town in Midyat in Mardin province, southeastern Turkey, on July 1, 2024.
মেটিয়েটের সুরঙ্গপথ দিয়ে একজন পৌর কর্মী হেঁটে যাচ্ছেন। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

শহরটির একটানা দীর্ঘকাল দখলদারিত্বে থাকার ফলে, তিনি বলেন, “সঠিকভাবে বলা কঠিন" যে সেখানকার কোন জিনিস কোন যুগ বা গোষ্ঠীর কর্ম বলে নির্ধারণ করা যাবে।

তবে "পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম, এই সব ধর্মবিশ্বাসীরা মেটিয়েটের ভূগর্ভস্থ শহরে অবদান রেখেছে," বলেন ইয়াভুয।

শত শত বছরের দখলদারিত্ব

কিউরেটর গণি তারকান বলেন, শত শত বছরের আক্রমণের হুমকি কেটে যাওয়ার পরেও গুহাগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি মারডিন যাদুঘরে পরিচালক হিসাবে কাজ করতেন। গুহা থেকে উদ্ধার করা গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, ব্রোঞ্জ এবং মৃৎশিল্প যাদুঘরে রাখা হয়েছে।

“মানুষ ঐ জায়গাটিকে বসবাসের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে,” তারকান বলেন।

তিনি বলেন, “কয়েকটি ঘর কবর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কয়েকটি ঘর জিনিষপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।"

খননকাজের পরিচালক ইয়াভুয গুহার ভেতরের বিষণ্ণ ঠাণ্ডা জায়গাতে একের পর এক গোলাকার গর্তগুলির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যে ওগুলো করা হয়েছি ওয়াইন রাখার মৃৎপাত্রগুলো রাখার জন্য, গুহার বাইরে সূর্যালোক থেকে দূরে।

This photograph shows the inside of the Matiate archaeological site underneath the town in Midyat in Mardin province, southeastern Turkey, on July 1, 2024.
মেদিয়াতের নিচে মেটিয়েট - শহরের নিচে শহরের একাংশ। ফটোঃ ১ জুলাই, ২০২৪।

আজ অবধি, মারডিন অঞ্চলের অর্থোডক্স খ্রিস্টান সম্প্রদায় ওয়াইন উত্পাদনের সেই পুরানো ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।

তুরস্কের মধ্যাঞ্চল ক্যাপাডোসিয়ায় অবস্থিত প্রাচীন গুহা গ্রামের জন্যও দেশটি বিখ্যাত।

তারকান ব্যাখ্যা করেন, ক্যাপাডোসিয়ার ভূগর্ভস্থ শহরগুলিতে কক্ষগুলো একটির উপরে আরেকটি অর্থাৎ উল্লম্বভাবে নির্মান করা হয়েছিল, কিন্তু মেটিয়েটে পাথালেভাবে অর্থাৎ হরাইজন্টালী তৈরি করা হয়েছিল।

মিদিয়াত পৌরসভা এই কাজের জন্য অর্থায়ন করে এবং তারা কেইভটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না করা পর্যন্ত খনন চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

মিদিয়াত পৌরসভা আশা করছে যে এটা পর্যটন আকর্ষণ হিসাবে এই জায়গা একটি জনপ্রিয় স্থান হিসেবে প্রমাণিত হবে এবং দর্শনার্থীদের ১২০,০০০ বাসিন্দার শহরে আকর্ষণ করবে।

XS
SM
MD
LG