অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য 'অভিন্ন পারিবারিক আইন' প্রণয়ন করা জরুরী বলে মনে করেন বাংলাদেশের নারী অধিকার কর্মীরা


প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও (CEDAW) সনদে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। এই সনদে মোট ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে ধারা-২, ১৩(ক), ১৬.১ (গ) ও (চ) ধারাগুলোয় আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার তা সে সময় অনুমোদন করেনি। পরবর্তী সময়ে সরকার ধারা- ২, ও ১৬.১ (গ) বাদে বাকি দুটো অনুচ্ছেদ থেকে আপত্তি তুলে নেয়। সিডও সনদে স্বাক্ষরের ৩৯ বছর পার হয়ে যাবার পরও এই দুটি ধারায় আপত্তি রেখেই নিয়মানুসারে সিডও কমিটিতে জমা দেয়ার জন্য প্রতিবেদন তৈরি করছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালে অষ্টম প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় আর গত বছর মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে শুরু হয় নবম প্রতিবেদন তৈরির কাজ।

নারীর অধিকার কর্মীদের মতে এ দুটি ধারায় সরকারের আপত্তি রেখে দেয়া মানে হলো বাংলাদেশে সংবিধানে নারী, পুরুষের যে সমতার কথা বলা আছে তা অস্বীকার করা। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও লিঙ্গ সহিংসতা দূর করতে সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন চান নারী অধিকার কর্মীরা। তারা মনে করেন সরকার সচেষ্ট হলেই ধারাগুলোর আপত্তি সরিয়ে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব।

সিডও সনদের যে ধারাগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি রয়েছে

ধারা—২:(ক) পুরুষ ও নারীর সমতার নীতি তাদের জাতীয় সংবিধান অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত আইনে ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করা এবং আইনের মাধ্যমে ও অন্যান্য উপযুক্ত উপায়ে এই নীতির প্রকৃত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা;

(খ) নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করে, উপযুক্ত ক্ষেত্রে আইন মানতে বাধ্য করার ব্যবস্থা সহ,

যথোপযুক্ত আইনগত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

(গ) পুরুষের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে নারীর অধিকারসমূহের সুরক্ষা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং উপযুক্ত

জাতীয় আদালত ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে কোনো বৈষম্য থেকে নারীকে রক্ষা কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা;

(ঘ) নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক যে কোনো কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষ

ও প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে এই দায়িত্ব অনুসারে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা;

(ঙ) কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যাতে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সকল উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা;

(চ) প্রচলিত যেসব আইন, বিধি, প্রথা ও অভ্যাস নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলো পরিবর্তন অথবা বাতিল করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন সহ সকল উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা;

(ছ) যে সব জাতীয় দণ্ড বিধান নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলো বাতিল করা।

ধারা—১৬.১ (গ): বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ কালে নারী ও পুরুষের একই অধিকার ও দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের মতে সিডও সনদের ধারা-২ সংরক্ষণ করা মানে পুরো সিডও সনদটাকেই অস্বীকার করা। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “এটা আমাদের একটা বিরাট বড় প্রশ্নের জায়গা যে, এখনও পর্যন্ত সিডও-র যে ধারাগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে সেটা কেনো তুলে নেয়া হচ্ছে না। সিডও-র কথাই তো হলো সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা। সিডও সনদের ১৬.১ (গ) ধারায় যে সংরক্ষণ রেখে দেয়া হয়েছে সেটা নারীদের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করছে।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে অষ্টম প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকার ধারা সংরক্ষণের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে জানায়, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন তৈরি করা হয়েছে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য রয়েছে। পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনতে হলে সব ধর্মের নেতাদের সম্মতি প্রয়োজন। সমাজ এখনো এসব পরিবর্তন গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। নারী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে ২০২১ সালে মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদনে ওই বাক্যগুলো পরিমার্জন করে ‘সমাজ প্রস্তুত নয়’ বাক্যটি বাদ দেয়া হয়।

প্রসঙ্গটি স্মরণ করে সুলতানা কামাল বলেন, “সমাজকে তো তৈরি করতে হয়। রাজনীতি মানে হচ্ছে সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো আছে সেখানে মানুষকে ধীরে ধীরে প্রগতিশীল ধারায় তৈরি করা। এমন অনেক আইন পাশ করা হয় যেগুলো নিয়ে সমাজে লোকের প্রশ্ন থাকে, আপত্তি থাকে, মানতে চায় না। সরকার তাহলে সে আইনগুলো কিভাবে করে? শুধু নারীর ক্ষেত্রে যে আইনগুলো সেক্ষেত্রে সামাজিক বাধার অজুহাত দেখিয়ে ধারাগুলো পরিবর্তন করে না কিংবা নতুন আইন তৈরি করে না। এটা খুবই দুঃখজনক।”

সনদের নবম প্রতিবেদন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কী বলছে

জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) -এর নবম প্রতিবেদনের কাজের অগ্রগতি, কবে নাগাদ তা জমা দেওয়া সম্ভব হবে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকী ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “আপনারা জানেন সিডও সনদের দুইটি ধারায় আমাদের আপত্তি রয়েছে। তাছাড়া সনদের সকল ধারাই আমাদের ফুলফিল আছে। আমরা সবসময় চাই এখনই হয়ে যাক। কিন্তু আমাদের এ বিষয়গুলোর সঙ্গে ধর্মীয় কিছু চেতনার বিষয় জড়িত।”

তিনি জানান, “যে দুইটি ধারা আছে এগুলোর সাথে আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নানান ধরনের বিষয় সম্পৃক্ত থাকার কারণে আমরা এই জায়গায় পদক্ষেপ নিতে সময় নিচ্ছি, বা নিতে পারছি না। এরমধ্যে অন্যতম হলো সম্পদের সমান অধিকার। এক্ষেত্রে আমাদের যেই নারী উন্নয়ন নীতিমালা তৈরী করা হয়েছে সেটা অনুযায়ী যে সম্পদ একজন নারী লালন করবে সেখানে তার পূর্ণ অধিকার থাকবে। এটা আমরা সেখানে যুক্ত করেছি। কিন্তু আমাদের সমাজে বাপ, দাদার সম্পদের যে সমান অধিকারের বিষয় আছে সেটা যেহেতু আমাদের ধর্মীয় আলোকে হয়; একেক ধর্মের একেক নিয়ম সে জায়গায় আমরা এখনো ধর্মীয় নেতাদের সাথে বসতে পারি নি। কিন্তু আমরা আশা করি সবার সাথে বসার পরে এই বিষয় নিয়ে আমাদের যে ভুল ভ্রান্তি তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।”

তার মতে, “বাংলাদেশে কোনো ঘটনা হলেই ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে নানান জটিলতা সৃষ্টি করে। যেটা আমাদের অনেক কিছুতেই আঘাত হানে। তাই সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করানো ও আরো বেশি বিকশিত করতে দুটি ধারার ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। আশা করি সময় লাগলেও আমরা সমাধান করতে পারবো। শীঘ্রই হবে কিনা আমি বলতে পারবো না। এটা আলোচনার বিষয়।”

চুমকী বলেন, “এক্ষেত্রে আমি বলবো আমদের বর্তমান সরকার তৃতীয়বার সরকারের দায়িত্ব পালন করছে। এই সময়কালে নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে, এটা কিন্তু বিগত সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে। পাশাপাশি আমি এটাও বলবো যে আমরা কোনো জায়গায়ি ফিফটি ফিফটি হয়ে গেছি এটা বলবো না। এটা রাতারাতি সম্ভবও নয়' বলেন সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী।

সনদ ও দেশে নারীদের অবস্থান বিষয়ে বিরোধী দল বিএনপি-র অবস্থান

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সিডও সনদের দুইটি ধারা ২ এবং ১৬-১ (গ) সংরক্ষণ রাখায় আপত্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় গেলে এই ধারা দুইটি বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেবে জানতে চাইলে বিএনপি-র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “ধারা দুইটিতে সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট, দেশের আর্থ- সামাজিক এবং অনান্য যে মূল্যবোধ আছে সেগুলোর বিবেচনায় যতদূর সম্ভব আমরা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো।

নারীর অগ্রগতি শুধু সরকারের পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মানসিকতা এতোটাই পুরুষতান্ত্রিক এবং নারী বিদ্বেষী, যে যখন নারী হিসেবে আমি কোথা‌ও কাজ করতে যাই, যে কোন লোক এক্স, ওয়াই, জেড, আমার পোষাক, আমার চেহারা, আমার বয়স, আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা বলে। অথচ আমার একজন পুরুষ সহকর্মীকে আশেপাশে এসব কোন কিছু ফেইস করতে হয় না। আমরা নারীকে একজন মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করতে শিখি নাই। সুতরাং এটা হলে রাষ্ট্র কি করবে? আমাদের মানসিকতা যদি আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের হয়, তাহলে কোন সরকারের পক্ষে এখানে র‌্যাডিকেল চেঞ্জ আনা সম্ভব না। তবে আইনগত সুরক্ষার যে ব্যাপারগুলো রযেছে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও আমরা যদি মনে করি নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য বিলোপের জন্য নতুন কোন আইন করার প্রয়োজন আছে, আমরা তাই করবো।”

তিনি আরও বলেন, “বিএনপি ১৯৯১ সালে যখন ক্ষমতায় আসে তখন প্রথমবারের মতো মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকার এই নীতিমালায় নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। বিএনপি নারী উদ্যেক্তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের আইনী সুরক্ষার ব্যবস্থাও করে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন বিএনপি সরকারের আমলে হয়। নারী নির্যাতনের সকল মামলা এখনো এই আইন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইনটিও বিএনপি সময়েই করা হয়েছে। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে, আমাদের ঘোষিত ২৭ দফার আলোকে নারীও শিশু এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের আলোকে সকল নারীর সমান অংশগ্রহণ এবং সমান সুযোগ সৃষ্টি জন্য যা যা করা দরকার, যে সব পদক্ষেপ নেয়া দরকার আমরা তা নিব।”

বৈষম্যমূলক আচরণ ও লিঙ্গ সহিংসতা দূরীকরণ

বাংলাদেশের অষ্টম সাময়িক প্রতিবেদনের ওপর ২০১৬ সালে সিডও কমিটি যে সুপারিশ দিয়েছিলো তাতে কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এখনো বন্ধ হয়নি। সিডও কমিটি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, একই কাজের জন্য সমমজুরি, নারীর বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবনের সমতা, অভিবাসী নারী কর্মীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সহ ৩৪টি সাধারণ সুপারিশ গ্রহণ করে এছাড়াও সকল নারীদের জন্য বিচার প্রাপ্তির বাস্তবভিত্তিক অধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক-এর বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো সামগ্রিক গবেষণার কথা জানা নেই, তবে বিচ্ছিন্নভাবে নানাবিধ মানুষ, অর্গানাইজেশন ওরিয়েন্টেড গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকা-কে আরো বলেন, “সহিংসতার ধরনও পাল্টেছে। সেটা এখন নানাভাবে হচ্ছে। আগে অফলাইনে এক ধরণের সহিংসতা হতো, এখন অনলাইনেও হচ্ছে। নারী পুরুষকে, পুরুষ নারীকে এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নারীও নারীকে নির্যাতন করছে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী কোন মানুষই সহিংসতা থেকে বাদ পড়ছে না।” তিনি মনে করেন, এখানে মূল বিষয়টা সহিংসতা এবং সেটা অনেক বড় আকারে হচ্ছে। সহিংসতা কেনো ঘটছে তার উত্তরে ড. তানিয়া হক বলেন, “আমাদের অনেক ভালো ভালো আইন আছে, কিন্তু এর এক্সিকিউশন এবং ইমপ্লিমেন্টেশনের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে জানে না, অনেক সময় আইনের দ্বারস্থ হতে চায় না কারণ এগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ। অনেক আর্থিক ব্যাপারও এর সাথে জড়িত থাকে।” তিনি মনে করেন, লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য পারিবারিক শিক্ষা দায়ী। তাই যতই আইন তৈরি করা হোক না কেন পরিবারে যদি আমরা ছেলে-মেয়ের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করি তাহলে সহিংসতা তৈরি হবে। তিনি বলেন, “শিশুদের আমরা কি শেখাবো সেটাই যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে এই সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না। এটাই স্বাভাবিক যে একেক বাবা-মা একেক ভাবে সন্তানকে বড় করবেন কিন্তু সেখানে বেসিক কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে যেটাকে আমরা বলি জেন্ডার নিউট্রাল প্যারেন্টিং মডিউল।”

নারী অধিকার কর্মী ও প্রাগ্রসর-এর নির্বাহী পরিচালক ফৌজিয়া খন্দকার ইভা অনেকদিন থেকেই নারী আন্দোলনে সঙ্গে যুক্ত। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন “আমাদের নারী সংগঠনগুলোর দাবি একটাই, সেটা হলো সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন আমরা চেয়েছি। গত ৩৯ বছরে এই দুটি ধারায় আপত্তিগুলো থাকা সত্ত্বেও আইন-কানুন ও নীতিমালায় কিছুটা পরিমার্জন আমরা লক্ষ করি। তবে যেখানেই নারীর প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে, জানি না কেনো পরিবারগুলো মেয়েদের সেটা দিতে চায় না।” তিনি মনে করেন, যারা বিভিন্ন প্লাটফর্মে কাজ করছেন, ধর্মীয় নেতারা, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যারা আছেন, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, সরকারের দায়িত্বরত ব্যক্তি ও আইনজ্ঞরা সবাই মিলে যদি ওপেন ডায়লগ বা এক ধরনের মুক্ত সংলাপের পরিসর তৈরি করা যেতো তাহলে সেক্ষেত্রে সমাধান বেরিয়ে আসতো।

লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে তার মত, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমেছে। তিনি আরো বলেন, “আসলে নির্যাতনের ধরণ পাল্টাচ্ছে। এক সময় আমরা অ্যাসিড ভিক্টিম হতে অনেক দেখেছি, কিংবা যৌতুকের কারণে পারিবারিক নির্যাতন, হত্যা এগুলো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ হয়েছে এটা বলা যাবে না। তবে আমরা এখন সাইবার ক্রাইম দেখতে পাচ্ছি। নানাভাবে নারীদের উত্যক্ত করা হচ্ছে, যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। নির্যাতনের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে। ফৌজিয়ার মতে, নির্যাতনকে আমরা মনে করি এটা শারীরিক বা মানসিকভাবেই হতে পারে কিন্তু নির্যাতনের একটা বড় জায়গা হল নারীকে অসম জায়গায় রাখা, অমর্যাদা করা, তাকে তার যোগ্য সম্মান না দেয়া, তার কাজ বা তার গণ্ডিতে সংক্ষিপ্ত করে দেয়া। মানে তার স্বাধীন যে সত্তাকে সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং তাকে বাধ্য করছে কোন না কোন ভাবে সমাজে পছন্দ মত চলতে। ফতোয়া দিচ্ছে।” তিনি বলেন, “এটাকে আমরা মানসিক নির্যাতন বা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন বলতে পারি। এটাও আমাদের আলোচনা করা দরকার।“

বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন নিয়ে কী ভাবছেন আইনজীবীরা

মুসলিম পারিবারিক আইন

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট দিলরুবা শরমিন মনে করেন, সিডও সনদের দুটি ধারা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার ভুল করছে। তিনি বলেন, “আমাদের আইনে অনেক বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে। যেমন- একজন পুরুষ সাক্ষী সমান দুজন নারী সাক্ষী অর্থাৎ একজন নারীকে অর্ধেক মানুষ ভাবা হচ্ছে। এটা আমাদের মুসলিম আইনে আছে।” দিলরুবা শরমিন জানান, ইসলামী শরীয়া মোতাবেক বলা আছে একজন নারী তার বাবার সম্পত্তির দুই আনা, ভাইয়ের সম্পত্তির দুই আনা, স্বামীর সম্পত্তির দুই আনা এবং ছেলের সম্পত্তির দুই আনা পাবে। তার মানে আট আনা পাবে। এই ইসলামী শরিয়া আইন অর্থাৎ ফারায়েজ আইন বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বলেছে মুসলমানদের এই ফারায়েজ অনুযায়ী চলতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত এ সম্পত্তি ভোগ করতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়। তিনি মনে করেন, এই সনদের দুটি ধারায় সই না করার জন্য নারীরা সমাজের সর্বত্রই হয়রানির শিকার হচ্ছে।

নারীকে অভিভাবকত্ব প্রদান সম্পর্কে দিলরুবা শরমিন বলেন, “এই প্রধানমন্ত্রীর আমলে আমাদের এনআইডিতে মায়ের নাম যোগ হয়েছে। পাসপোর্টে , বিয়ের কাগজে এবং বিভিন্ন ডকুমেন্টে মায়ের নাম যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আরেকটা উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন সেটা হলো বাবার সম্পত্তিতে ছেলে মেয়ের সমান ভাগ কিন্তু তখন আমাদের ধর্মীয় নেতা এবং দলগুলোর কারণে সেটা সম্ভব হয় নাই তারপর তিনি চেয়েছিলেন, অন্তত মায়ের সম্পত্তিতে নারীরা সমান ভাগ পাক, তবে সেটাও এখনো প্রজ্ঞাপন আকারেই আছে।” শুধু এনআইডি বা স্কুলের ফর্মে মায়ের নাম লেখাটাই পর্যাপ্ত নয়, তিনি মনে করেন সরকারের উচিত মাকে অভিভাবকত্বের অধিকার পুরোপুরি দেয়া।

হিন্দু পারিবারিক আইন

সিডও সনদের ধারা ধারা—১৬.১ (গ) এর বিষয়বস্তু হলো বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদকালে নারী ও পুরুষের অধিকার ও দায়দায়িত্ব। এ বিষয়ে হিন্দু পারিবারিক আইনে কী আছে তা নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অ্যাডভোকেট দীপ্তি সিকদার। তিনি বলেন, “২০১২ সালে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন সংক্রান্ত যে আইন করা হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও অন্যান্য নারী সংগঠনের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখানে বিয়ের নিবন্ধন ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, এটাকে ম্যান্ডেটরি করা হয়নি। যার কারণে দেখা যাচ্ছে সব বিয়ে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন হয় না। তাই সেখানে প্রতারিত হওয়ার একটি সুযোগ থেকে যায়। বিয়ের কোন ডকুমেন্ট থাকে না। এরপর বিবাহবিচ্ছেদের প্রচলিত যে আইন আছে সেখানে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ নাই। সেখানে যেটা আছে সেটা হচ্ছে কিছু কারণে আলাদা বসবাস করতে পারবে। সেই আইনটাও যদি আমরা দেখি এই আইনটা অনেক পুরনো, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে করা। পৃথক বসবাস করতে পারবে কিন্তু এই আইনের সেপারেশন না থাকার কারণে নারী-পুরুষ দুজনেই কিন্তু এখানে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হচ্ছে সে নতুন করে জীবন যাপন করতে পারে, বিবাহ করতে পারে। কিন্তু একজন নারীর ক্ষেত্রে সেটা হয় না। তাকে পৃথক থাকার পরও স্বামীর নামের শাঁখা সিঁদুর পরতে হবে। গোত্রান্তর হয়ে যাওয়ার ফলে তাকে সেই গোত্রতেও থাকতে হবে। সেখানে কিন্তু একজন নারী তার ইচ্ছেমতো স্বাধীন জীবনযাপন করা কিংবা তা নতুন কোন বৈবাহিক সম্পর্কে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।”

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে পারিবারিক সম্পত্তিতে পুত্রের পূর্ণ অধিকার আছে কিন্তু কন্যা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। হিন্দু নারীরা বিয়ের সময় ‘স্ত্রী-ধন’ পান। দীপ্তি সিকদার বলেন, “বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে যে উপহার, উপঢৌকন নারী পায় সেটা স্ত্রী-ধন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এগুলো একভাবে যৌতুককে উৎসাহিত করছে আবার যেটা পাওয়া যায় সেটা একজন নারী তার নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে না।” দীপ্তি সিকদার মনে করেন, এগুলো মানবাধিকারের পুরোপুরি পরিপন্থী। তিনি বলেন, “আমরা যদি বলি সিডও সনদের যে মূল জায়গাটা বা সমতার জায়গাটা তৈরি করা সেখানে কিন্তু এ বিষয়গুলো পরিপন্থী। শুধু নারী-পুরুষ বিভেদ নয়, তৃতীয় লিঙ্গের যারা আছেন তারাও কিন্তু সামাজিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি বাবা-মায়ের সম্পদের অধিকারের জায়গাতেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।” ১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপালন আইন যেটা সব ধর্মের ক্ষেত্রে সমান সেখানেও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার রয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এমনকি সন্তান দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে ।

এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্দোলন করেছে। এ বছরের শুরুর দিকে ‘বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ’ প্রচলিত হিন্দু আইন সংশোধন করে নারী, প্রতিবন্ধী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে সম্পত্তিতে সম অধিকার দেওয়া, স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পুরুষের যথেচ্ছ বহুবিবাহের সুযোগ বাতিল করা ও বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের বিধান করাসহ ছয় দফা দাবি জানায়। বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ড. ময়না তালুকদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে তাদের এই দাবি সম্পর্কে বলেন, “আমাদের মধ্যেই একদল ব্যক্তি আছেন যারা এর বিরোধিতা করেন। যারা সংস্কার করতে চায় না, প্রগতিতে বিশ্বাস করে না তারাই বিরোধিতা করছেন। তাদের বিরোধিতার কারণে অনেক কাজই আমরা করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের যে দাবি সেটার জন্য আমরা লড়াই করে যাবো। প্রগতিশীল নারী-পুরুষ, কন্যা সন্তানের বাবা-মায়েরা এই লড়াইয়ে আমাদের সঙ্গে আছেন। তারাও চায় এই আইন পরিবর্তন করে নতুন একটা আইন আসুক যেখানে বাবার সম্পত্তিতে সব সন্তানের সমঅধিকার থাকবে। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো যেমন ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সব জায়গায় সম অধিকারের আইন পাশ হয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশেই সেটা করা হচ্ছে না। সরকার এ ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক, কিন্তু কিছু মানুষের বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্র এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।”

প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি গুরুত্ব পাচ্ছে

নারী অধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ বা ‘ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড’ আইনটি প্রণয়ন হলে সিডও সনদের বৈষম্যের জায়গাগুলো অনেকাংশে দূর হয়ে যায়। অ্যাডভোকেট দিলরুবা বলেন, এটা আমরা তৈরি করেছিলাম সিডওর আলোকেই।

অ্যাডভোকেট দীপ্তি জানালেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৮০ দশক থেকে ‘ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা অভিন্ন পারিবারিক আইন’-এর প্রস্তাবনা দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, গত বছর সিডো কমিটির যে রিকমেন্ডশনগুলো এসেছে সেখানেও কিন্তু অভিন্ন পারিবারিক আইন করার ব্যাপারে সুপারিশ এসেছে। আমরা আশির দশক থেকে এটি তৈরি করে বিভিন্ন আন্দোলন করেছি। আইন মন্ত্রণালয়, মহিলা শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা ধারাবাহিকভাবে এটা জমা দিয়ে যাচ্ছি এবং চেষ্টা করছি। সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা অভিন্ন পারিবারিক আইনের জন্য বারবার করে বলেছি।” ফৌজিয়া খন্দকার বলেন, “বিভিন্ন সংগঠন যেমন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারীপক্ষ এ ধরণের আরো সংগঠনের উদ্যোগে আমরা সবাই একত্রিতভাবে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা অভিন্ন পারিবারিক আইনের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাও আসলে এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এ আইনটি পাশ করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।”

এই প্রতিবেদন তৈরী করেছেন আফরিন শাহনাজ, পাভেল হায়দার চৌধুরী এবং গোলাম সামদানী।

XS
SM
MD
LG