কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা শেষেই চাঁদে অবতরণ শুরু করবে ভারতের চন্দ্রযান-৩। এই ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। আশার কথা, যতই সমস্যা হোক, ত্রুটি হোক, এমনকি যদি কোনও ভুলও হয়ে যায়, তবুও নাকি নিরাপদেই সফল অবতরণ করবে চন্দ্রযান-৩। চন্দ্রযানের বিক্রম ল্যান্ডার-এ যে অভ্যন্তরীণ ‘স্যালভেজ মোড’ রয়েছে, তা এতটাই শক্তিশালী বলে জানালেন, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর মহাকাশ বিজ্ঞানী, প্রফেসর রাধাকান্ত পাঢি। তিনি উল্লেখ করেন, দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ব্যর্থতার পরে অনেক উন্নতি করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবার নিরাপদ অবতরণ হবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
দু’বছর আগে চন্দ্রযান-২-র ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল, ল্যান্ডার বিক্রম তার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং এটি ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল চাঁদের মাটিতে। এটি একটি ‘অ্যালগরিদম ত্রুটি’ ছিল বলে ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানী পাঢি জানান, সেই ত্রুটি এখন সংশোধন করা হয়েছে। বিক্রম ল্যান্ডার-এর পা এখন আরও মজবুত।
চন্দ্রযান ২ এবং ৩, এই দুই অভিযানের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর রাধাকান্ত পাঢি। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র চন্দ্র মিশনে তিনি-সহ আরও অনেক বিজ্ঞানীই অবদান রেখেছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স থেকে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই প্রফেসর পাঢি বলেন, "ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান ২ নিয়ে ‘ওভার কনফিডেন্ট’ ছিলেন। সেই শিক্ষা থেকেই চন্দ্রযান ৩-এর এমন নকশা করেছেন, যাতে সবকিছু ভুল হয়ে গেলেও এটি অবতরণ করবেই।"
তার কথায়, "চন্দ্রযান ৩ আরও অনেক শক্তিশালী, তার স্ট্রেস পরীক্ষা করা হয়েছে আরও খুঁটিয়ে, সমস্ত জানা-অজানা, সব রকম বিষয়ের যত্ন নিয়েছে ইসরো। যেমন, এইবারে বিক্রম ল্যান্ডারে দুটি অন-বোর্ড কম্পিউটার ছিল, চন্দ্রযান ২-এর ক্ষেত্রে কেবল একটি ছিল।"
ইতিমধ্যেই ইসরো ঘোষণা করেছে, ২৩ অগস্ট ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদে নামবে সন্ধে ৬টা বেজে ৪ মিনিটে। এর আগে ঘোষণা করা হয়েছিল ২৩ অগস্ট সন্ধ্যা ৫টা ৪৭ মিনিটে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। পরে তা ১৭ মিনিট পিছোনো হয়। এই অবতরণের লাইভ টেলিকাস্ট দেখানো শুরু হবে ইসরো-র সোশ্যাল মিডিয়া পেজে, বুধবার বিকেল ৫টা ২০ থেকে।
সব মিলিয়ে, এখন অবতরণের আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে চন্দ্রযান। এর মধ্যেই চাঁদের যে দিক পৃথিবীর সামনে থাকে, তার উল্টো দিকের এলাকায় তোলা কয়েকটি ছবি পাঠিয়েছে চন্দ্রযান। তাতে লাগানো ‘ল্যান্ডার হ্যাজার্ড ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যাভয়েডেন্স ক্যামেরা’য় তোলা হয়েছে ছবিগুলি।
ওই অত্যাধুনিক ক্যামেরার কাজই হল, চাঁদে অবতরণের জন্য একটি সুরক্ষিত জায়গা খুঁজতে সাহায্য করা অর্থাৎ চাঁদের যেখানে অবতরণ করবে ল্যান্ডার বিক্রম, সেখানে যাতে কোনওরকম বোল্ডার বা গভীর কোনও গর্ত না থাকে, তা নিশ্চিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই ক্যামেরা।
পাশাপাশি, ইসরো-র বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি গতিবেগে কোনও গোলমাল হয় বা চাঁদের পিঠে নামতে দেরি হয়, তাহলেও যাতে পর্যাপ্ত জ্বালানি থাকে সেই জন্য অতিরিক্ত জ্বালানি ভরে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বিকল্প কোনও জায়গাতেও নামতে পারে ল্যান্ডার বিক্রম। সেই সঙ্গেই থাকছে নতুন সেন্সর যার নাম লেসার ডপলার ভেলোসিটি মিটার। তিনটি ভেলোসিটি ভেক্টরও থাকছে ল্যান্ডার-এ। এবারের চন্দ্রযানে মোট ১৩টি ‘থ্রাস্টার’ রয়েছে, যা সফট ল্যান্ডিং করতে সাহায্য করবে।
তবে ইসরো আগেই ঘোষণা করেছিল, কোনওভাবেই ব্যর্থ হবে না ভারতের তৃতীয় চন্দ্রযাত্রা। চেয়ারম্যান এস সোমনাথ বলেছিলেন, "আগের বার চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিং করার সময় গতিবেগের হেরফেরে মুখ থুবড়ে পড়ে ল্যান্ডার বিক্রম। তবে সেই ভুল আর হবে না। কারণ, ‘প্ল্যান বি’ তৈরি আছে। চাঁদকে পাঁচ বার চক্কর কাটার পরে চাঁদের দক্ষিণ পিঠে ৭০ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় সফট ল্যান্ড করার সময় যদি বিক্রমের কলকব্জায় কোনও গন্ডগোল হয়, যদি ইঞ্জিন বা সেন্সর বিকলও হয়ে যায়, তাহলেও চাঁদের বুকে ল্যান্ডারকে নামানো যাবে।"
চন্দ্রযান-২ অভিযানের তিনটি অংশ ছিল, অরবিটার (যা কক্ষপথে পাক খায়), ল্যান্ডার (যা মাটিতে অবতরণ করে এবং এক জায়গায় থিতু হয়) এবং রোভার (যন্ত্রচালিত গাড়ি)। সূত্রের খবর, চন্দ্রযান-৩ অভিযানে অরবিটার থাকছে না। শুধু ল্যান্ডার এবং রোভার থাকবে। এবারের ল্যান্ডার বিক্রম গতবারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তপোক্ত।
বিক্রম-এর পা অনেক বেশি মজবুত করা হয়েছে যাতে ল্যান্ডিংয়ের সময় যে ধাক্কা লাগবে তার অভিঘাত সহজেই সইতে পারে। ল্যান্ডিংয়ের বেগ প্রতি সেকেন্ডে দু’মিটার থেকে বাড়িয়ে তিন মিটার করা হয়েছে। অর্থাৎ বেশি বেগে অবতরণের সময়ও ল্যান্ডারের ‘পা’ ভাঙবে না।
রোভার-ও অনেক উন্নত। এতে থাকছে আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার এবং লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপ।
এবার চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করার জন্য যে জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটার পরিধি আগেরবারের থেকে বেশি রাখা হয়েছে। গতবার চাঁদে অবতরণের জন্য ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর কাছে মাত্র ৫০০ মিটারX৫০০ মিটার জায়গা ছিল। এবার সেটা বাড়িয়ে ৪ কিলোমিটারX২.৪ কিলোমিটার করা হয়েছে।