বড়দিন, বর্ষবরণ উৎসব উদযাপনের পরে এ বার গঙ্গাসাগর মেলা। ভারতে কোভিড পরিস্থিতি যে দিকেই যাক না কেন, সংক্রমণের হার যতই উর্ধ্বমুখী হোক না কেন, কোনও জনসমাগম বা ধর্মীয় জমায়েত দেশে স্বাভাবিক ভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের বারংবার সতর্কবাণীও উপেক্ষা করা হচ্ছে।
গোটা দেশে উদ্বেগজনক কোভিড পরিস্থতির মধ্যে অবস্থার যাতে আরও অবনতি না হয় তার জন্য গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধ করতে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক চিকিৎসক অভিনন্দন মণ্ডল এবং পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের পাঁচটি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ডক্টর্স ফোরাম। কয়েক দিনের শুনানির পরে ৭ অক্টোবর কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি কেসাং ডোমা ভুটিয়ার ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, গঙ্গাসাগর মেলা হবে, তবে তা হবে বেশ কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে।
এই নজরদারির জন্য তিন সদস্যের কমিটিও গড়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিধিনিষেধ ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখার পাশাপাশি সেই বিধিনিষেধ ঠিকমতো পালিত না হলে তারা রাজ্য সরকারকে গঙ্গাসাগর মেলায় পুণ্যার্থীদের ঢোকা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশও দিতে পারবে এই কমিটি। এই নজরদারি কমিটিতে থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বা তার কোনও প্রতিনিধি, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা এবং রাজ্য সরকারের একজন প্রতিনিধি। এর সঙ্গেই গত বছর সাগর-স্নান নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট যে সব নির্দেশ দিয়েছিল, সে সব এ বারেও মানতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই বিরাট জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কী ভাবে? রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছেন, এ বছর মেলায় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের সমাগম হবে বলে সরকার মনে করছে। তবে, কোভিড বিধি মেনে কী ভাবে সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা সবিস্তার আদালতে জানিয়েছেন এজি। কিন্তু এরই মধ্যে গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে গত কয়েক দিনে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
বিতর্কটা কোথায়? গত বছরের গঙ্গাসাগর মেলা সংক্রান্ত মামলায় সাগরমেলা এলাকা ‘নোটিফায়েড এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। কিন্তু সেই নির্দেশ পালিত হয়নি। এ বার হাইকোর্ট সেই নির্দেশ মানতে বলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, করোনা-বিধি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত ২ জানুয়ারি যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে তাতে সর্বাধিক ৫০ জনকে নিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের কথা বলা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে সাগরমেলা করতে হাইকোর্টও নির্দেশ দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সাগরমেলায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন প্রয়োগ করেও মাত্র ৫০ জনকে নিয়ে মেলা করা সম্ভব কি, যেখানে রাজ্যই পাঁচ লক্ষ মানুষের সমাগমের কথা জানিয়েছে।
এখানেই প্রশ্ন তুলছেন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের আহ্বায়ক (কনভেনর) পুণ্যব্রত গুণ। ভয়েস অফ আমেরিকা-কে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি গঙ্গাসাগর মেলা সংক্রমণের ‘সুপার স্প্রেডার’ হবে। গঙ্গাসাগর এলাকা নোটিফাই করে মেলা হলে তা কিন্তু আদালত অবমাননার সামিল হবে। কারণ, মাত্র ৫০ জনে মেলা করা কী ভাবে সম্ভব? গঙ্গাসাগরের সংক্রমণ পশ্চিমবঙ্গের বাইরের অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। এবং এর দায়িত্ব সম্পূর্ণই বর্তাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপর।’’
জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর পক্ষ থেকে মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে কয়েক দিন আগে রাজ্য সরকারকে একটি মেল-ও করা হয়। কিন্তু পুণ্যব্রত অভিযোগ, "সেই চিঠির কোনও উত্তর দেওয়ার সৌজন্য সরকার দেখায়নি।" চিকিৎসকদের একটি অংশ মনে করেন, যে কারণে কয়েক মাস আগে কুম্ভমেলা বন্ধ না করায় উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার এবং উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিংহ রাওয়ত-এর সরকারকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল, সেই একই দোষে দুষ্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারও।
পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে তীব্র উৎকণ্ঠা রয়েছে চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসেরও। দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। কোভিড-কালের একেবারে প্রথম দিক থেকেই তিনি জনসচেতনতা বাড়ানোয় উদ্যোগী হয়েছেন। ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বিশ্বাস বললেন, ‘‘এই সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে গেলে জনসমাগম বন্ধ করতেই হবে। সব কিছু আদালত দিয়ে হয় না। এই মুহূর্তে ডাক্তার-পুলিশ-প্রশাসনিক কর্তা সবাই আক্রান্ত। গঙ্গাসাগরে জনসমাগম হবেই। এই পরিস্থিতিতে ওখানে মেলা না হওয়াই কাঙ্খিত ছিল। জনস্বার্থেই প্রশাসনকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’’
কী ঘটেছিল গত বছরের কুম্ভমেলা ঘিরে?
দেশজুড়ে কোভিড সংক্রমণের মধ্যেও ভারত সরকার কুম্ভমেলা বন্ধ করতে রাজি হয়নি। বলা হয়েছিল, "দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন কুম্ভস্নানে আসেন। তাদের কী ভাবে বারণ করা যাবে? তা ছাড়া, কুম্ভস্নানে ‘করোনার পাপ’ ধুয়ে যায়!" বাস্তবে কী ঘটেছিল? ২০২১-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত উত্তরাখণ্ডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৬৩। কিন্তু কুম্ভমেলায় লোক যত বাড়তে থাকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে করোনা রোগীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও একশোর গণ্ডি পার হয়ে যায়। বেশ কয়েক জন সাধুরও মৃত্যু হয়। শুধু উত্তরাখণ্ডই নয়, কুম্ভমেলার পরে উত্তরপ্রদেশ সমেত নানা রাজ্যেও সংক্রমণ তীব্র আকারে বেড়ে যায়। কারণ, বিভিন্ন রাজ্য থেকেই পুণ্যার্থীরা সেখানে গিয়েছিলেন। তীব্র সমালোচনার মুখে চারধাম, অর্থাৎ বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, যমুনোত্রী এবং গঙ্গোত্রী যাত্রা বাতিল করে দেয় উত্তরাখণ্ড সরকার।
দুর্গাপূজায় কী হয়েছিল?
২০২০ সালে, করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই কলকাতা হাইকোর্ট পূজার ভিড় নিয়্ন্ত্রণ করতে বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ২০২১-এও হাইকোর্ট সে সব বিধিনিষেধ বহাল রাখে। কোর্টের নির্দেশেই মণ্ডপ ফাঁকা রাখতে হয়। স্বেচ্ছাসেবী-সহ কারা কারা মণ্ডপের ভিতরে থাকবেন, তাদের নামের তালিকাও ঝোলাতে বলে হাইকোর্ট। এ ছাড়া অনেক আগে থেকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকও কোভিড নিয়ে বেশ কিছু সতর্কবাণী শোনায়।
চিকিৎসক বিশ্বাস বলেন, "দুর্গাপূজা নিয়ে মানুষের ধৈর্য কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ সারা বছর এই উৎসবের প্রতীক্ষায় থাকেন। কিন্তু তাদের বোঝাতে হবে, সচেতন করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশে মানুষ মণ্ডপের ভিতরে ভিড় না জমালেও বাইরে পর্যন্ত তো এসেছে। গাড়িতে গাদাগাদি করেও বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে। ফলে সেখান থেকেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর পরেও কালীপুজো, ছটপুজো হয়েছে¸ এর আগে নির্বাচন হয়েছে— সব মিলিয়ে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়াও যে হারে পরীক্ষা হওয়ার দরকার ছিল, সেই হারে হয়নি। এ ব্যাপারেও প্রশাসনের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল।’’