সর্বশেষ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেল নেত্রকোনায়। এক সময় এই জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ২০টি। গত সপ্তাহে হিরামন হল বন্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হলো নেত্রকোনায় সিনেমা হলের ব্যবসা। শুধু নেত্রকোনা নয়, সারা দেশে চলচ্চিত্র ব্যবসা গুটিয়ে আসছে। দেশে ১৯৯৪ সালে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। বর্তমানে চালু ৬০টি সিনেমা হল। যে কোনো সময়ে আরও ১০টি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কেন এমন হচ্ছে, প্রশ্নের জবাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফিরোজ রশীদ, যিনি সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ও সিনিয়র নেতা, তিনি বলেন, নতুন ছবি নেই, দর্শক নেই, বিদেশি ছবি চালানোতে বাঁধা বিপত্তি, আয় নেই, কর্মচারীদের বেতনের টাকা উঠে আসে না তাই মালিকরা বন্ধ করে দিচ্ছেন দীর্ঘদিনের এ ব্যবসা। অনেকে সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করছেন বাণিজ্যিক ভবন। সিনেপ্লেক্সে টিকিটের দাম বেশি। তাই যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেন মধুমিতা হলের কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতা ইফতেখার উদ্দিন। তিনি বলেন, ছবি ছাড়া এত বড় হল রেখে লাভ কি? বিদেশি সিনেমা আনতে গেলে সবাই বাধা দেয়। দর্শক মানহীন সিনেমা দেখতে আসে না। করোনাকাল হলগুলোকে বাকিটা শেষ করে দিয়ে গেছে।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হলগুলোর মধ্যে গুলিস্তান ভাঙা হয় ১৯৯৬ সালের পর। ১২তলা ভবনের বাণিজ্যিক স্থাপনায় শপিংমলের সঙ্গে হল করারও কথা ছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। ঢাকার রূপমহল, তাজমহল, বিউটি, মুন, মল্লিকা, জ্যোতি, লায়ন, শাবিস্তান, গ্যারিসন, পর্বত, সাগরিকা, মেঘনা, যমুনা, ডায়না, আগমন, অতিথি, পূর্ণিমা, রাজমণি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঢাকা সিটিতে সিনেমা হল ছিল ৪৪টি। এখন আছে ২২টি। ঢাকা জেলার মফস্বল এলাকার ১৭টি হলের এখন ৫টি আছে। নারায়ণগঞ্জ ৩৪টি সিনেমা হলের এখন আছে ১২টি। গাজীপুরের ১৯টি হলের মাত্র ৭টি আছে। মুন্সীগঞ্জের ১৬টি হলের ৪টি টিকে আছে। মানিকগঞ্জ জেলায় ১৭টি হলের ১টি মাত্র আছে। নরসিংদী জেলার মফস্বল এলাকায় এখন আর কোনো সিনেমা হল নেই। জেলা শহরের ২১টি সিনেমা হলের মধ্যে আছে ৪টি।
ময়মনসিংহকে এক সময় বলা হতো সংস্কৃতির শহর। সেই জেলার ৪১টি হলের ১০টি টিকে আছে। কিশোরগঞ্জের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ২২ হলের একটি কোনমতে আছে। যেকোন সময়ে বন্ধ হতে পারে। টাঙ্গাইলের ৪৭টি হলের ১০টি টিকে আছে। শেরপুরের ১৭টি সিনেমা হলের আছে ৬টি। জামালপুর জেলায় ১৪টি হলের ৩টি আছে।
ফরিদপুর জেলার শহর ও মফস্বলের বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে ১৭টির মধ্যে আছে মাত্র ২টি।গোপালগঞ্জ ৬টি হলের ১টি টিকে আছে। রাজবাড়ী জেলার সবগুলো সিনেমা হল এখন বন্ধ। এক সময় এই জেলায় ছিল ৮টি হল। এখন একটিও নেই। এর চেয়েও খারাপ চিত্র শরীয়তপুরের। এখানে ৯টি হলের সবই বন্ধ। মাদারীপুর জেলায় ৯টির মধ্যে সবই বন্ধ। তবে ইউনাইটেড ও ইউনিভার্সেল টকিজ নামে দুটি হল অনিয়মিতভাবে চলে।
চট্টগ্রাম শহরে এক সময় সিনেমা হলের ঐতিহ্য ছিল। সিটি ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৬টি হল ছিল। আর এখন আছে মাত্র ৪টি। এই ৪টি হচ্ছে, আলমাস, দিনার, সিনেমা প্যলেস, সুগন্ধা। জেলা শহরের পর্যটন শহর কক্সবাজারের ৪টি হলের একটিও নেই। রাঙামাটির ৩টি হলের সবই বন্ধ। কাপ্তাইতে তিনটি হলও বন্ধ। রামগড় ৫টি হলের সব বন্ধ হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ি ৭টি হলের সবই বন্ধ। একই অবস্থা বান্দরবানের। ৩টির সবই বন্ধ।
কাজী নজরুল ও শচিন দেব বর্মণের স্মৃতির কুমিল্লা শহর ও জেলার মফস্বল ২৩টি হলের মাত্র ৩টি টিকে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৩টি হলের ২টি আছে। চাঁদপুর শহর ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১৬টি হলের ৪টি আছে। নোয়াখালী ১১টি হলের ২টি আছে চৌমহনী ও মাইজদীতে।
লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের দুটির একটিও নেই। জেলার অন্য এলাকার ৯টির মধ্যে চর আলেকজান্ডারে মাত্র ২টি আছে।
সিলেট শহরের ৮টি হলের একটি আছে। সারা জেলার ১৪টির একটিও নেই। হাছন রাজার স্মৃতির সুনামগঞ্জ শহরের ৩টির একটিও নেই। জেলার বাকি ৬টিও বন্ধ। মৌলভীবাজারের ১৮টির একটি আছে কোনমতে। হবিগঞ্জ ৯টি হলের তিনটি আছে। ফেনীর ৫টির ২টি আছে। খুলনা শহরের ১৪টির আছে ৫টি। সারা জেলায় ১৭টির একটিও নেই। বাগেরহাট এখন সিনেমা হলশূন্য জেলা। ১১ হলের সবই বন্ধ। সাতক্ষীরা শহরের ৩টির দুটি আছে। শহরের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলের ১২টির সব বন্ধ। ঐতিহ্যবাহী মনিহার সিনেমা হল ছাড়া যশোর শহরের বাকি ৫টি বন্ধ। সারা জেলার ১৮টির দুটি আছে। ঝিনাইদহের ১৩টির মধ্যে ১টি আছে। নড়াইল জেলার ৫টি হলই বন্ধ। মাগুরা জেলার ৬টি হলের আছে ২টি। কুষ্টিয়ার ২০টি হলের ২টি আছে। চুয়াডাঙ্গা ১১ হলের মধ্যে শহরের একটি কোনভাবে আছে। বাকি সব বন্ধ।
মেহেরপুর জেলা এখন সিনেমা হলবিহীন। ৭টির সবই বন্ধ। বরিশালের ১৬টি হলের একটি সিটিতে আছে। কিন্তু অবস্থা ভালো নয়। ঝালকাঠি জেলা শহরের ৩টি হলের সবই বন্ধ। পিরোজপুর জেলা ও জেলা শহরের ৭টি সিনেমা হলের সবই বন্ধ। ভোলার ১২টি হলের ৪টি আছে। রাজশাহী শহরের ৬টির একটিও নেই। জেলার অন্য এলাকার ২৫টির মধ্যে ৩টি আছে। নাটোরের ২৩টি হলের ১টি আছে। নওগাঁ শহরে আছে একটি, জেলায় ১৬টির ২টি আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৪টি হলের ১টি আছে। রংপুর জেলা শহরে ৯টি হলের একটি আছে। সারা জেলার ২৪টির মধ্যে ৩টি আছে। লালমনিরহাট জেলা শহরে ছিল ২টি, আছে ১টি। সারা জেলার ৫টির সবই বন্ধ। গাইবান্ধা শহরের ৩টি হলের সব বন্ধ। সারা জেলার ১১টির মধ্যে আছে ৩টি। কুড়িগ্রাম শহরের ৪টি, জেলার ১৫টির সবই বন্ধ। পাবনার ৪০টি হলের ৩টি আছে। দিনাজপুরের সারা জেলায় ২৮টি হলের ৪টি আছে। ঠাকুরগাঁও ৩০টি হলের ৩টি লড়াই করছে টিকে থাকতে। পঞ্চগড় এখন সিনেমা হলবিহীন জেলা। শহরে ২টিসহ জেলার বাকি ১১টি হলের সবই বন্ধ। বগুড়ার ৪৩ হলের মাত্র ৮টি আছে। জয়পুরহাটের ১৯টি হলের তিনটি আছে। সিরাজগঞ্জ জেলা শহরে ছিল ৭টির ২টি খোলা থাকলেও চলে না। সারা জেলায় ছিল ৩৩টি। আছে ৩টি। নীলফামারীর ১৫টি হলের দুটি আছে। বরগুনাতে এখন আর কোন হল নেই। পটুয়াখালির ৭টির ২টি আছে।