অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

"আই হ্যাভ আ ড্রিম"


ফাইল ছবি- রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ওয়াশিংটনে মার্চের সময় তার "আই হ্যাভ এ ড্রিম" বক্তৃতার জন্য লিংকন মেমোরিয়ালে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে হাত নাড়ছেন। ২৮ আগস্ট ১৯৬৩। (ছবি-এপি)
ফাইল ছবি- রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ওয়াশিংটনে মার্চের সময় তার "আই হ্যাভ এ ড্রিম" বক্তৃতার জন্য লিংকন মেমোরিয়ালে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে হাত নাড়ছেন। ২৮ আগস্ট ১৯৬৩। (ছবি-এপি)

আজ থেকে ৫৮ বছর আগে ৩৪ বছরের এক যুবক স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যের এবং বিভেদ ও শোষণহীন সমাজের। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ (আই হ্যাভ আ ড্রিম)। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এক অসামান্য ভাষণ দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং, যা সারা পৃথিবীতে ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ নামে খ্যাত। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম বলে বিবেচিত। এর ঠিক ১০০ বছর আগে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন। আর তার ১০০ বছর পরে লিংকনের স্মৃতিসৌধের সোপানে দাঁড়িয়ে কিং শোনান যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বপ্নের কথা। সেদিন সাদা-কালো সকল ধর্মবর্ণের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে এসে ওয়াশিংটনে সমবেত হয়েছিলেন। তাদের দাবি ছিল বর্ণবৈষম্যের অবসান। বিমান, গাড়ি, বাস, ট্রেন এবং পায়ে হেঁটে মানুষ সমবেত হন ন্যাশনাল মলে, লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে।


এই সমাবেশে ছিলেন মানবাধিকার কর্মী জন লুইস। বক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি স্মরণ করেন, "সেদিন ভীষণ গরম পড়েছিল। আমি আমার ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষ আর মানুষ - হাজার হাজার। আমার বাঁ দিকে দেখলাম আরও মানুষ। তাদের অনেকেই খুবই তরুণ। অনেকেই বক্তাদের দেখার জন্য গাছের ডালে চড়ে বসেছে। সামনের দিকে তাকালাম, সেদিকেও হাজার হাজার লোক। অনেকে লেকের জলে নেমেছে একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্যে। সবাই অপেক্ষা করছে, কখন অনুষ্ঠান শুরু হবে।...প্রতিবাদের জন্য মানুষ তৈরি হয়ে বেরিয়েছিল। অগাস্ট মাসের উত্তাপ কমাতে রেড ক্রস তাদের বরফের টুকরো দিয়ে সাহায্য করেছিল । কিন্তু ড. কিং যখন কথা বলতে শুরু করেন তখন ক্লান্ত মানুষ যেন বিদ্যুতায়িত হন। সশ্রদ্ধ নীরবতা বিরাজ করছিল। যখন তিনি তার স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করেন, তখন সবাই "আমিন" বলে চিৎকার করে ওঠে। কিংয়ের কাছে সবাই আরও স্বপ্নের কথা শুনতে চান।”


এর আগে আলাবামায় ঘটে যায় কিছু সহিংস ঘটনা। মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালের শুরুর দিকে সরকারের নেওয়া বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করেন। বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে অনুসারীদের নিয়ে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ বা নাগরিক অধিকার আন্দোলন শুরু করেন তিনি। দুই মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যান। দাবিগুলো ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের সমান অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে, কালোদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার থাকতে হবে, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে আলাবামার পুলিশ সমবেত জনতার ওপর দমনমূলক নিপীড়ন চালায়। কিংসহ আরও অনেকেই সে সময় গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনা ব্যাপক সাড়া জাগায় বিশ্বব্যাপী। তারই অংশ হিসেবে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ‘মার্চ অন ওয়াশিংটন ফর জবস অ্যান্ড ফ্রিডম’ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এর আহবায়ক ছিলেন শ্রমিক নেতা এ ফিলিপ র‌্যান্ডল্ফ। কর্মসূচিটি লিংকন মেমোরিয়ালে পৌঁছানোর পর বক্তারা সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। মার্টিন লুথার কিং ছাড়াও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ধর্মযাজক, চলচ্চিত্র তারকা ও শ্রমিক নেতারা। প্রত্যেক বক্তার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৫ মিনিট। কিন্তু দিনটি ছিল কিংবদন্তী নেতা কিংয়ের। তিনি ভাষণ দানকালে শোনান বৈষম্যমূলক সমাজে আফ্রিকান-আমেরিকানদের বঞ্চনার কথা। তিনি তার স্বপ্নের আমেরিকার কথা বলেন। তিনি বলেন কীভাবে বর্ণবৈষম্য শুধু কালো আমেরিকানদের জীবনকে নয়, গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারপর তিনি তুলে ধরেন ভবিষ্যতের আমেরিকা নিয়ে তার আশাবাদ, যেখানে সব আমেরিকান হবে সমান – এটাই হবে সত্যিকারের স্বপ্নের আমেরিকা।


কিংয়ের এ ভাষণ সারা আমেরিকা জুড়ে টেলিভিশনে প্রচার হয়। সে-সময়ের তিনটি প্রধান টিভি নেটওয়ার্ক (এবিসি, সিবিএস ও এনবিসি) কিংয়ের বক্তৃতা সম্প্রচার করে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক তার ভাষণ শুনেছেন। তাৎক্ষণিকভাবেই এটি ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই বিখ্যাত ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।

‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণটি সারা পৃথিবীর শন্তিকামী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মার্টিন লুথার কিং হয়ে ওঠেন বিশ্বের অহিংস ও সাম্যবাদ ধারণার প্রতিমূর্তি। একই আন্দোলনের আরেক কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা। দুজনেরই স্বপ্ন ছিলো এক, কালো আর সাদা মানুষের বৈষম্য দূর করা। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ম্যান্ডেলার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন কিংয়ের স্ত্রী কোরেটা স্কট কিং। অনুষ্ঠানে ভাষণ দানকালে নেলসন ম্যান্ডেলা আমেরিকার মানবাধিকার নেতা লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণ ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ থেকে উদ্ধৃত করেন,

“Free at last, Free at last, Thank God almighty we are free at last.”

“অবশেষে মুক্তি পেলাম, অবশেষে মুক্তি পেলাম,
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা অবশেষে মুক্তি পেলাম।”


যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চিন্তায়, বক্তৃতায় লুথার কিংয়ের প্রভাব দেখা যায়। ২০০৪ সালে তার ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের মূল ভাষণ, যা তাকে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দিয়েছিল, সেই ভাষণে তিনি কিংয়ের দৃষ্ঠিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখেই “together as one American family.” বা একসঙ্গে একটি পরিবার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ২০০৮ সালের বক্তৃতাতেও তিনি ড. কিংয়ের মতো একসঙ্গে সাম্যের পথে চলার আহবান জানান।


‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণের ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মার্টিন লুথারের উক্তি, ভাষণ ও আদর্শ মানুষকে সাহস যুগিয়ে চলেছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সোমবার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস পালন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় এ বছর ১৭ জানুয়ারি, সোমবার পালিত হচ্ছে মার্টিন লুথার কিং দিবস।

XS
SM
MD
LG