প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিনেই অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক নির্বাহী পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন যেগুলোকে তার কর্মকর্তারা “সাধারণ বুদ্ধি” সম্পন্ন অভিবাসন নীতি বলে বর্ণনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, রাজনৈতিক আশ্রয় সুবিধার অবসান এবং কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুর জন্মসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্ব অধিকার বাতিল করা।
প্রেসিডেন্ট তার অভিষেক অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে বলেন, “আমাদের এমন একটি সরকার রয়েছে যারা বিদেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার জন্য প্রচুর তহবিল দিয়েছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে অথবা আরও গুরুত্বপূর্ণ যে নিজের জনগণকে রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।”
এর আগে ট্রাম্পের নিয়োজিত কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে “জাতীয় নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা সংকট” মোকাবেলায় প্রশাসনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।
কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, যেসব অভিবাসী অপরাধী তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রশাসনের কিছু পরিকল্পনা
সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা
ট্রাম্প বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে তিনি সেনা মোতায়েন করবেন। সীমান্তে যে সব আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা রয়েছেন তাদেরকে সহায়তায় তিনি ন্যাশনাল গার্ড পাঠাবেন। কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেন যে, সীমান্ত নিরাপত্তা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা এবং ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে সীমান্ত সুরক্ষিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ঐ কর্মকর্তা বলেন, এই পদক্ষেপটি নেওয়ার ফলে যা হবে তা হলো, সেখানে এটি সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা [এবং] যাতে [প্রতিরক্ষা বিভাগ] এবং [হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের] মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়ে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ করা। … আমরা “মেক্সিকোতে থাকুন” নীতিটি পুনর্বহাল করতে যাচ্ছি।
ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে করা হয়েছিল ‘মেক্সিকোতে থাকুন’ নীতিটি। তার আওতায় দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তে কিছু আশ্রয়প্রার্থীকে ইউএস ইমিগ্রেশন আদালতের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত মেক্সিকোতেই অপেক্ষা করতে হবে।
মেক্সিকোর বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী হোয়ান রামোন দে লা ফুয়েন্তে সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “তারা যদি নীতিটি (মেক্সিকোতেই থাকুন) পুনর্বহাল করে তাহলে আমরা এর সঙ্গে একমত নই। আমাদের লক্ষ্য ভিন্ন। আমরা এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে নিতে চাই। ... এখনকার মতো একই নীতি বজায় থাকুক এটাই আমাদের ইচ্ছে।”
ট্রাম্প প্রশাসনের ঐ কর্মকর্তার কাছে সীমান্তে কতজন সেনা মোতায়েন করা হবে, জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রীই এবিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন।
গণ বহিষ্কার
আরেকটি ঘোষণা দেশজুড়ে অবৈধ অভিবাসীদেরকে কেন্দ্র করে করা। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় বারবারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় আসলে অবৈধ অভিবাসীদের গণহারে--- অন্তত ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাবেন।
ট্রাম্পের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, প্রশাসন অভিবাসন কর্মকর্তাদেরকে বিদ্যমান আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় “কর্তৃত্ব” দেবে।
করনেল ল’ স্কুলের অভিবাসন আইন বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্টিফেন ইয়েল-লেহার ভয়েস অফ আমেরিকাকে পাঠানো এক ইমেইলে লিখেছেন, গণ নির্বাসন প্রচেষ্টা এবং অভিযান সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, তবে রাতারাতি লোকজনদেরকে দ্রুতগতিতে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সংখ্যা বাড়বে না।
"যদি কোনও ব্যক্তিকে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য একটি আদেশ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে থাকে তবে সে ক্ষেত্রে তাকে দ্রুত দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে সেই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে নগণ্য। ধরা পড়া বেশির ভাগ লোককে অভিবাসন আদালতের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ঐ আদালতগুলোতে ইতিমধ্যেই ৩৮ লক্ষের বেশি মামলার ব্যাকলগ বা জট হয়ে আছে। এই জটের কারণে অনেকের ক্ষেত্রেই তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে, নাকি অ্যাসাইলাম সুবিধার আওতায় থেকে যেতে পারবে বা অন্য কোনও ধরণের সুরক্ষার ভিত্তিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে, তা জানতে কয়েক বছর সময় লাগবে,” তিনি লিখেছেন।
'ধরো আর ছাড়’
যে নিয়মের আওতায় অভিবাসীরা তাদের আবেদনের শুনানি চলাকালে মুক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারে, বর্তমান প্রশাসন সেই নিয়মটি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সাধারণভাবে এই প্রথাটি “ক্যাচ-এন্ড রিলিজ” বা 'ধরো আর ছাড়’ নামে পরিচিত।
ট্রাম্পের কর্মকর্তারা ক্রমবর্ধমানহারে বাড়তে থাকা আটক অবৈধ অভিবাসীদের কিভাবে সামাল দেবেন তা ব্যাখ্যা করেননি।
শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচী
ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচিও বন্ধ করে দিচ্ছেন। তার প্রথম শাসনামলে, ২০২১ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে তিনি শরণার্থী প্রবেশের বার্ষিক সীমা ঐতিহাসিক সর্বনিম্ন ১৫ হাজারের নামিয়ে এনেছিলেন।
ঐ সময় শরণার্থী বিষয়ক প্রবক্তারা বলেছিলেন, শরণার্থী সংখ্যা কমানো থেকে বোঝা যায় যে, বিশ্বব্যাপী শরণার্থী পুনর্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘদিনের ভূমিকা ছিল তা থেকে তাদের সরে আসছে।
চার্চ ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের প্রোগ্রাম বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এরোল কেকিচ সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক ইমেইলে লিখেছেন, তার গ্রুপ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছে। ফেডারেল সরকারের অনুমোদিত নয়টি সরকারী শরণার্থী পুনর্বাসন সংস্থার মধ্যে চার্চ ওয়ার্ল্ড সার্ভিস একটি যারা শরণার্থীদের নতুন করে জীবন শুরু করতে সহায়তা করে।
“এমনকি অত্যন্ত কমসময়ের জন্যও যদি এই কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয় তাহলেও তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে,” তিনি বলেন।
অ্যাসাইলাম সুবিধার অবসান
ট্রাম্পের একটি নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, যেসব অভিবাসী বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় কর্মকর্তার কাছে আবেদন করার সুযোগ না দিয়েই অবিলম্বে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন তাদের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ পোস্ট করেছে যে, সংস্থাটি আর সিবিপি ওয়ান অ্যাপটি ব্যবহার করছে না। এই অ্যাপে আবেদন করার মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ্য অভিবাসী, যাদের কাজ করার অধিকার আছে, আইনসম্মত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে।
ঐ অ্যাপের মাধ্যমে অভিবাসীরা সীমান্তে এসে মানবিক প্যারোল বা অন্যান্য ধরণের আইনি প্রক্রিয়ার অনুমতি জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্টের আবেদন করতে পারতেন। সিবিপি ওয়ান অ্যাপের নোটিশে তারা যে সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট আগে করা হয়েছিল তা বাতিল করার কথা নিশ্চিত করেছে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভ
সবশেষে আমেরিকার মাটিতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল করার আদেশে সই করলেন ট্রাম্প। আমেরিকার মাটিতে জন্মালেই নাগরিকত্ব দেয়া হবে, এই জন্মসূত্রে নাগরিকত্বর অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
তবে নতুন প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপগুলি ব্যাপক আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অভিবাসী অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলি এই নীতিগুলির প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।