বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং হালকা করে দেখছেন বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংগঠন নীলাচলের নেতা, প্রাণেশ হালদার বলেন, "ক্ষেত্র বিশেষে আড়াল ও বিকৃত করার চেষ্টা করছে। এই সহিংসতার মূল চরমপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীগুলো, যারা শুরু থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থন পেয়েছে। একটি সুষ্ঠু এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে এই অপরাধগুলো প্রকাশ এবং চরমপন্থীদের চেহারা উন্মোচন এই সময়ের দাবি," প্রাণেশ হালদার বলেন।
নীলাচলের এই নেতা আরো বলেন, "বাংলাদেশে সকল সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, ভীতির মধ্যে জীবনযাপন করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত পরিসংখ্যানের তুলনায় প্রকৃত পরিস্থিতি আরও গম্ভীর এবং 'গুরুতর'। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা ২০% থেকে ৮%-এ নেমে এসেছে।"
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তার সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে আগস্টের ৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশে ২০১০ টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৯ জন সংখ্যালঘু নিহত হয়েছেন। অভিযোগ আছে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় একটি 'ভয়ের পরিবেশে' বসবাস করছেন একধরণের ভীতির মধ্যেই তারা এবারের দুর্গাপূজা পালনে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে বলছেন বাংলাদেশে হয়তো এর আগেও এখনকার তুলনায় বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এখনকার মতো এরকম ভীতিকর পরিবেশে হিন্দুসহ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আগে কখনো দিন কাটাতে হয়নি।
এ প্রসঙ্গে গ্রেটার ওয়াশিংটন হিন্দু সোসাইটির নেত্রী মৌসুমী মিত্র চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "৫ অগাস্টের পর থেকে আমাদের পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনরা একটি বিভীষিকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা দিন তাদের কাটছে ভয় ও আতঙ্কের মাঝে। তাদের আশেপাশে যেসব ঘটনা ঘটছে - না বিচার হচ্ছে কোন ঘটনার, না কাউকে পারছে বলতে। প্রতিবাদ তো অনেক দূরে। আর কেউ যদি মুখ ফুটে বলেই ফেলে বা প্রতিবাদ করে তাহলে ওই ব্যক্তি ও তার পরিবার পরিজনকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ-এর মতে একাত্তরের পরে এরকম পরিস্থিতি কখনোই আসেনি।"
টিআইবির রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রান্তিক সম্প্রদায় ও ভিন্নমতালম্বীদের ওপর হওয়া সহিংসতার ঘটনার অভিযোগগুলোকে চিহ্নিত করা, ভেরিফাই করা ও তদন্ত করার ক্ষেত্রে ও এগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগের অভাব ছিল।
এ প্রসঙ্গে মৌসুমী মিত্র চৌধুরী মনে করেন, বর্তমানে দেশে সংখ্যালঘুরা যেভাবে, যে দুরাবয়স্থার মধ্যে দিনপাত করছে, তাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ । তিনি অভিযোগ করে বলেন, "হত্যা, রাহাজানি, হাজার হাজার ঘরবাড়ি মন্দির পোড়ানো ভাংচুর, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, চাকরি হারানো কি হয়নি বা হচ্ছেনা সংখ্যালঘুদের উপর, সরকার কোনোটারই বিচার তো করতে পারছেই না, উপরন্তু সংখ্যালঘুরা (তার দাবি অনুযায়ী) সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।"
বাংলাদেশে হিন্দু সহ সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো হচ্ছে তা প্রতিরোধে প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিন্দু ধর্মালম্বীরা নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। হোয়াইট হাউসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। আগামীতে এই ধরনের আরও সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
মৌসুমী মিত্র চৌধুরী জানান, তারা অন্যান্য স্টেটের অর্গানিজেশনগুলোর সাথেও যোগাযোগ করছেন সমন্বিতভাবে প্রতিবাদের আয়োজনের ব্যাপারে। তারা বেশ কয়েকজন কংগ্রেসম্যান ও সেনেটর-এর সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
সেইসাথে তারা সামাজিক মাধ্যম ও অন্যান্য ইন্টারনেট প্লাটফর্ম প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন তারা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঘিরে কী ঘটছে
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এ বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর জানায়, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এই ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে ৯ জনকে হত্যার ঘটনা আছে। ধর্ষণ/গণধর্ষণ করা হয়েছে ৪ জনকে, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে ; বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৯১৫টি; ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে ; বসতবাড়ি দখল হয়েছে একটি; এছাড়া , ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।
এ সপ্তাহে সামাজিক মাধ্যমে দেয়া পোস্টে, নেত্র নিউজ-এর রিপোর্টের বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম লেখেন যে নয়জন হিন্দুকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-সম্পর্কিত সহিংসতায় নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তাদের হত্যার পেছনে রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য কারণ ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গত ৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দেশে মোট ৮৮টি মামলা করা হয়েছে এবং ৭০ জন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।
সেইসাথে প্রেস সচিব ২২ অক্টোবরের পরের ঘটনাগুলোর আপডেট দ্রুতই দেওয়া হবে বলে জানান।
বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরে সমাবেশের আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
এ সমাবেশের বেশ কয়েকটিতে নেতৃত্ব দেন হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনের সাবেক নেতা ও সনাতন জাগরণের মঞ্চের মুখপাত্র, হিন্দু ধর্ম গুরু চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।
গত ২৫ নভেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করার পর ২৬ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া হয়। এ মামলায় তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হলে তার মুক্তির দাবিতে চট্টগ্রাম কোর্ট প্রাঙ্গনে বিক্ষোভরত সমর্থকদের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এ সময় চিন্ময় সমর্থকদের হাতে সাইফুল ইসলাম নামের একজন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিহত হন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সারাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনের শুনানিতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় শুনানির তারিখ এক মাস পিছিয়ে দেয় চট্টগ্রামের আদালত।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও পার্শ্ববর্তী ভারতের মিডিয়া অভিযোগ করছে যে চিন্ময় দাসের আইনজীবীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালতে আসতে দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ভয়েস অফ আমেরিকাকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রসঙ্গে বলেন, "অতীতে আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এর থেকে বেশি আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু এবার তারা যে পরিমাণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে, তা অতীতে কখনও হয়নি। এই বাস্তবতা আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে।"
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ও সহিংসতার যে ঘটনাগুলো প্রচার হচ্ছে তা অতিরঞ্জিত। এ বিষয়ে গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি উঠেছিল, যা আমাকে দুঃখ দিয়েছে।"
তিনি বলেন, "এখন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি আবারও উঠে এসেছে এবং বিদেশি গণমাধ্যম এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। বাস্তবতা ও বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মধ্যে তথ্যের ফারাক রয়েছে।"
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক এ ধরনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্যে ও এ ধরনের ঘটনা রোধে একটি পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যবস্থা নেয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক প্রতিকার নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার কী বলছে
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কথিত 'নিষ্ক্রিয়তা'র অভিযোগের ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখছে, ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার করা এ প্রশ্নের জবাবে এক ইমেইলে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, বাংলাদেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া অব্যাহত পদক্ষেপগুলো কে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
মুখপাত্র জানান, "আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপর সহিংসতা ও তাদের প্রতি অসহিষ্ণুতার যেকোন ঘটনার নিন্দা জানাই এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া অব্যাহত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানাই।"
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটছে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাইলে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে এ ইমেইল বার্তায় ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলাকে জানানো হয়, "যুক্তরাষ্ট্র ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন (করার স্বাধীনতাকে) মৌলিক স্বাধীনতা হিসেবে সমর্থন করে। আমরা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারসহ আমাদের সকল অংশীদারদের কাছে সেই সমর্থনের কথা জানাই।"
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল ৩ ডিসেম্বর বলেন, "যেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান একই রকম—মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট করে বলি।"
বেদান্ত প্যাটেল আরও বলেন, "যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হতে হবে। যেকোনো ধরনের ধরপাকড়ের ক্ষেত্রে সরকারকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে দেশগুলোর প্রতি জোর দিয়ে যাবে।"
চিন্ময় দাসের গ্রেফতার প্রসঙ্গে একই ব্রিফিংয়ে আরেকটি প্রশ্নের জবাবে প্যাটেল বলেন, "এ বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই। তবে আবারও বলছি, আমরা এ ব্যাপারে বরাবরই জোর দিয়ে আসছি যে যারা আটক থাকবেন, তাদের পক্ষ থেকেও যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। এবং তাদের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।"
বাংলাদেশে ইসকনকে "সন্ত্রাসী সংগঠন" হিসেবে ঘোষণা করার দাবি ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন না পাওয়া প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাওয়া হলে, ভয়েস অফ আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র জানান, "বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ও সংবিধানে (নাগরিকদের) যে অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তার আলোকে এ ইস্যুগুলো সমাধান করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। আমরা বাংলাদেশসহ সকল দেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য আহ্বান জানাই।"
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচানের প্রচারণার সময়, ডনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম এক্স ও ট্রুথ সোশ্যাল-এ অক্টোবর ৩১-এ এক পোস্টে লেখেন, "আমি হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।"
তিনি পোস্টে হিন্দুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ২৬ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এক বিরতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
ঐ সাক্ষাৎ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, দুর্নীতি রোধ, শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
২০ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্র সেনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটি। চিঠিতে আইনপ্রণেতারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ 'দুর্বল' সম্প্রদায়ের উপর হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সেনেটররা তাদের চিঠিতে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে উল্লেখ করে, উদযাপনের সময়টাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সহিংসতার ব্যাপারে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যেখানে পুলিশ, সংখ্যালঘু হিন্দু এবং যাদেরকে শেখ হাসিনার সরকারের সমর্থক বলে ধরে নেয়া হয় তাদেরকে সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।
ভারত ও যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
চিন্ময় দাসের গ্রেফতার ও পরবর্তী ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাজনিত বিষয় নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। দু'দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেয়া, ভারত ও বাংলাদেশে পরস্পরবিরোধী আগ্রাসী প্রচারণা, কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও ত্রিপুরাতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা সহ বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, রংপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে ভাংচুর ও হামলার হুমকির অভিযোগ উঠছে ব্যাপকভাবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশটির পার্লামেন্টে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ধর্মীয় স্থানগুলোতেও হামলার খবর তারা পেয়েছেন এবং এ ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ভারত। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানোর কথা তিনি জানান।
বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে ভারতের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিংহ ২৮ নভেম্বর ভারতের লোকসভা সদস্যদের বলেন, গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির এবং দেব-দেবীর অবমাননা ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকার তাঁতীবাজারে একটি পূজামণ্ডপে হামলা, ২০২৪ সালের দুর্গাপূজার সময় সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে চুরির ঘটনাসহ এ ধরনের ঘটনার বিষয়ে ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘুদের এবং তাদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এই চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে এ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। সচিব পর্যায়ে বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার রোধে জোর দিয়েছে ঢাকা, বলে জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে দেয়া এক প্রতিবেদনে, সেদেশের একটি আন্তদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপ, দ্য অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ফর দ্য কমনওয়েলথ (এপিপিজি) বিগত কয়েক মাসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিশানা করে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন। গত ২৬ নভেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক খবরে এ কথা জানা গেছে।
২ ডিসেম্বর, যুক্তরাজ্যের হাউস অফ কমন্সে লেবার এমপি ব্যারি গার্ডিনারের করা বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইন্দো-প্যাসিফিকের দায়িত্বে থাকা যুক্তরাজ্যের আন্ডার সেক্রেটারি ক্যাথরিন ওয়েস্ট জানান, গত মাসে তার বাংলাদেশ সফরের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, সেদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করা হয়।
ক্যাথরিন ওয়েস্ট বলেন, "হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে আমরা ওয়াকিবহাল। ঘটনার দিকে নজর রেখেছে ইংল্যান্ডের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস। ইংল্যান্ড সরকার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা জারি রাখবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কথা। বিশেষ করে সেটা যখন হিন্দু সম্প্রদায়কে আঘাত করছে।"
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা প্রসঙ্গে পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ এমপি ও ছায়া মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্র সচিব প্রীতি প্যাটেল বলেন, "সহিংসতার বৃদ্ধির মাত্রা গভীর থেকে গভীরতর উদ্বেগজনক।"
কনজারভেটিভ পার্টির আরেক এমপি, ও অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের (এপিপিজি) চেয়ারম্যান বব ব্ল্যাকম্যান উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, "হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করায় তারা কষ্ট পাচ্ছ। সংখ্যালঘুদের তাদের ধর্মের কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে।"
ব্রিটিশ শিখ লেবার এমপি গুরিন্দর সিং জোসানসহ আরও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।