অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আসাদ মস্কো পৌঁছেছেন বলে রাশিয়ার মিডিয়ায় খবর


হায়াত তাহরির আল-শাম এর প্রধান আবু মহম্মদ আল-জোলানি দামেস্কের ওম্যায়েদ মসজিদে বক্তব্য রাখছেন। ফটোঃ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।
হায়াত তাহরির আল-শাম এর প্রধান আবু মহম্মদ আল-জোলানি দামেস্কের ওম্যায়েদ মসজিদে বক্তব্য রাখছেন। ফটোঃ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থাগুলো জানাচ্ছে যে, সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ তার পরিবার নিয়ে মস্কো পৌঁছেছেন এবং তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে।

সংবাদ সংস্থা তাস এবং আরআইএ ক্রেমলিনের একটি সূত্রর বরাত দিয়ে খবরটি দেয়, তবে সূত্র’র পরিচয় দেয়া হয়নি। দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস তাৎক্ষনিক খবরটি যাচাই করতে পারেনি তবে তারা মন্তব্যের জন্য ক্রেমলিনের সাথে যোগাযোগ করেছে।

অজ্ঞাতনামা ক্রেমলিন সূত্রে বরাত দিয়ে আরআইএ আরও জানিয়েছে, সিরিয়ার‍ বিদ্রোহীরা সিরিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছে। খবরে বিস্তারিত কিছু বলা হয় নি।

রাজধানী দামেস্কে উল্লাস

সিরিয়রা রবিবার দামেস্কের রাস্তায় নেমে পড়ে আকাশে বন্দুক ছুঁড়ে উদযাপনে মেতে উঠে। তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের আকস্মিক উৎখাতে ও তার পরিবারের ৫০ বছরের লৌহ শাসনের অবসানে তারা উল্লসিত।

আসাদের পতন বেশ দ্রুত ও আকস্মিকভাবেই ঘটেছে। কয়েক দিনের মধ্যে বিদ্রোহীরা আলেপ্পো, হামা ও হোমস শহর দখল করে কেননা সিরিয়ার সৈন্যরা কোনও বাধা দেয়নি। বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছে হায়াত আল-শাম গোষ্ঠী (এইচটিএস)। আল কায়দায় এই গোষ্ঠীর উৎস এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ একে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে বিবেচনা করে।

সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যতু প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। ফাইল ফটো।
সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যতু প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। ফাইল ফটো।

সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া বলেছে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতার পর আসাদ দেশ ত্যাগ করেছেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন।

বাহরাইনে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক সিনিয়র কূটনীতিক আসাদ কোথায় রয়েছেন তা নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই আসাদের ভাবমূর্তি মেরামতের চেষ্টা করেছিল এবং গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে উৎখাত হওয়া অন্যান্য সরকারের উচ্চপদস্থ নির্বাসিত নেতাদের স্বাগত জানিয়েছে তারা।

আসাদের মিত্রদের জন্য ধাক্কা

আসাদের শেষ কয়েক বছর ২০১১ সাল থেকে তিক্ত ও রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত ছিল, যাতে প্রায় পাঁচ লক্ষের বেশি সিরিয়াবাসী নিহত হয়েছে এবং যুদ্ধের আগে সে দেশে যে জনসংখ্যা (২২ মিলিয়ন) ছিল তার অন্তত অর্ধেক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে সিরিয়ার ভাগ্যে কী রয়েছে তা অনিশ্চিত। আসাদের পতন তার অন্যতম প্রধান সমর্থক ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্রদের জন্য একটা বড় ধাক্কা।

এক বছরের বেশি সময় ধরে আসাদের এই মিত্ররা ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে মনোনিবেশ করেছে। সম্প্রতি হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে, তবে গাজা ভূখণ্ডে ইরানের সাহায্যপুষ্ট হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ চলমান রয়েছে।

এইচটিএসের নেতৃত্বে রয়েছেন আবু মহম্মদ আল-জোলানি। সিরিয়ার তাৎক্ষণিক দিকনির্দেশ কী হবে তা তিনি নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি আল কায়দার সাবেক কমান্ডার। কয়েক বছর আগে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং এখন বলছেন, তিনি বহুত্ববাদ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে গ্রহণ করেছেন।

তবে, সে দেশে নানা তিক্ত বিভাজন রয়েছে। তুরস্কের সাহায্যপুষ্ট বিরোধী যোদ্ধারা উত্তরাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে এবং কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় ইসলামি স্টেট গোষ্ঠী এখনও সক্রিয় রয়েছে।

দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে জনগণের উল্লাস। ফটোঃ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।
দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে জনগণের উল্লাস। ফটোঃ ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা

সিরিয়ার সরকারি টেলিভিশনে একটি ভিডিও-বার্তা সম্প্রচার করে একদল বিদ্রোহী বলেছে, “অপরাধী শাসনের পতন হয়েছে” এবং সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তারা “মুক্ত সিরিয়া”র প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করতে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে। পরে বিদ্রোহীরা দামেস্কে বিকাল ৪ট থেকে পরদিন সকাল ৫টা পর্যন্ত কার্ফ্যু জারী করেছে।

বিদ্রোহী কমান্ডার আনাস সালখাদি, যিনি বিকালে টিভিতে হাজির হয়েছিলেন, সিরিয়ার ধর্মীয় ও জনজাতিগত সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, “সিরিয়া সকলের, কোনও ব্যতিক্রম নেই। সিরিয়া দ্রুজ, সুন্নি, আলাউই ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আসাদ পরিবার যেভাবে মানুষের সঙ্গে আচরণ করেছে আমরা তেমনটা করব না।”

সিরিয়ার আল-ওয়াতান সংবাদপত্র, যারা ঐতিহাসিকভাবে সরকারপন্থী, লিখেছে, “সিরিয়াতে আমরা একটা নতুন অধ্যায়ের সম্মুখীন হয়েছি। খুব বেশি রক্তপাত হয়নি, তাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা বিশ্বাস করি ও আমাদের আস্থা রয়েছে যে, সিরিয়া হয়ে উঠবে সকল সিরিয়াবাসীর।”

এই সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, অতীতে সরকারের বিবৃতি প্রকাশের জন্য সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের দায়ী করা উচিত নয়। তারা আরও বলেছে, “আমরা শুধুমাত্র নির্দেশ পালন করেছি এবং তারা যে খবর আমাদের পাঠিয়েছে তা ছেপেছি।”

আলাউই সম্প্রদায় তরুণ সিরিয়াবাসীদের “শান্ত, বিবেচক, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী থাকার এবং আমাদের দেশের ঐক্যকে যা ছিন্নভিন্ন করতে পারে, সেখানে টেনে না নিয়ে যাওয়ার” আহ্বান জানিয়েছে। আসাদ আলাউই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তার সমর্থন ও ঘাঁটির কেন্দ্রে রয়েছে এই সম্প্রদায়।

বিদ্রোহীরা বেশিরভাগই সিরিয়ার সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলিম। সিরিয়ায় যথেষ্ঠ সংখ্যক দ্রুজ, খ্রিস্টান ও কুর্দও রয়েছে।

আসাদের বিরুদ্ধে দেশে গৃহযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়, যার মধ্যে রয়েছে২০১৩ সালে দামেস্কের উপকণ্ঠে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ।

আসাদের চিরকালীন সমর্থক ইরানের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। আপাতভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার পর দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলের সৈন্য প্রবেশ

জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন “সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক হস্তান্তর”কে সুনিশ্চিত করতে শনিবার জেনেভাতে জরুরিকালীন বৈঠক আহ্বান করেন।

সিরিয়ার সঙ্গে স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে এমন আটটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে শনিবার বিকালে জরুরিকালীন বৈঠক আয়োজন করে উপসাগরীয় দেশ ও অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী কাতার। অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে ছিল ইরান, সৌদি আরব, রাশিয়া ও তুরস্ক।

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ বিন মহম্মদ আল-আনসারি সংবাদদাতাদের বলেন, এইচটিএস-সহ “গ্রাউন্ডে থাকা সকল পক্ষকে যুক্ত” থাকার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তারা সহমত হয়েছেন এবং তাদের প্রধান চিন্তা হল, “স্থিতিশীলতা ও নিরাপদ ক্ষমতা হস্তান্তর।”

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী রবিবার বলেছে, বিদ্রোহীদের হামলার পর সিরিয়ার সঙ্গে তাদের উত্তর সীমান্তে একটি অসামরিক বাফার জোনে তারা বাহিনী মোতায়েন করেছে।

সামরিক বাহিনী বলেছে, ইসরায়েল-দখলকৃত গোলান হাইটসের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দিতেই বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্যযুদ্ধে এই ভূখণ্ড দখল করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী একে ইসরায়েলি অধিকৃত ভূখণ্ড বলে বিবেচনা করে।

XS
SM
MD
LG