পাকিস্তানে একটি সন্ত্রাস-বিরোধী আদালত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) কারাবন্দী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের সময় সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য সমর্থকদের উস্কে দিয়েছেন বলে অভিযোগ গঠন করেছে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ইসলামাবাদের কাছে আদিয়ালা কারাগারে শুনানির আয়োজন করে এবং সেখানে চার্জ গঠনের ঘোষণা দেয়। ইমরান খান গত এক বছরের বেশি সময় বিভিন্ন মামলায় এই কারাগারে বন্দী আছেন।
বৃহস্পতিবার ২০২৩ সালের ৯ মে’র সহিংস বিক্ষোভ কেন্দ্র করে যে অভিযোগ গঠন করা হয়, তাতে ৭২-বছর বয়সী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সহযোগীরা নিজেদের নির্দোষ ঘোষণা করেন।
খানের পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিক্ষোভ জ্বলে উঠে তাঁকে অল্প সময়ের জন্য দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হলে। দাঙ্গা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অন্তত ১০জন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
কর্তৃপক্ষ পিটিআই সমর্থকদের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক সদর দফতর সহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ভবন এবং সামরিক স্থাপনা ভাংচুর করার অভিযোগ তোলে।
স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, সরকারী কৌঁসুলি বৃহস্পতিবার আদালতকে জানায় যে, সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি “সন্ত্রাসের ক্যাটেগরিতে পড়ে” এবং সামরিক সদর দফতরে হামলা “সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহ করতে উস্কানি দেয়ার লক্ষ্যে করা হয়েছিল।”
খান এবং তাঁর দল সব সময় অভিযোগ করেছে যে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার গুপ্তচররা বিক্ষোভকারীদের সাথে মিশে গিয়ে সেনা স্থাপনার উপর ৯ মে’র সহিংসতায় মদদ দিয়েছে। তাদের অভিযোগ মতে, এই সহিংসতাকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে তারা মাসের পর মাস পিটিআই-এর উপর নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন চালিয়েছে এবং শত শত সমর্থক গ্রেফতার করেছে।
আটককৃত কর্মীদের আত্মীয়-স্বজনের তথ্য অনুযায়ী, দাঙ্গার সাথে সম্পৃক্ততার কারণে অনেক আটক ব্যক্তিকে সামরিক হেফাজতে দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে পিটিআই বলে এই অভিযোগ উপযুক্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে তাদের আইনজীবীরা সক্ষম বলে তাদের বিশ্বাস, এবং “আশা করি ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে।”
খান ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সংসদে বিরোধীদলের আনা এক অনাস্থা প্রস্তাবে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে তিনি কয়েক ডজন মামলা এবং তদন্তের বেড়াজালে আটকে আছেন।
তিনি বলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলা সব বানোয়াট, এবং এগুলো পাকিস্তানের ক্ষমতাবান সামরিক বাহিনীর আদেশে আনা হয়েছে যাতে তিনি রাজনীতিতে ফিরতে না পারেন। সরকার তাঁর অভিযোগ অস্বীকার করে।
এই প্রাক্তন ক্রিকেট তারকাকে ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে একটি দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত এবং গ্রেফতার করা হয়। খান এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বলে অভিহিত করেন। পরবর্তীতে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের আগে খান আরও কয়েকটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত এবং একাধিক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
আপিল আদালত সকল রায় এবং সাজা প্রমাণের অভাব এবং মামলায় স্বচ্ছতার অভাবে বাতিল বা স্থগিত করেছে। কিন্তু যখনই কোন আদালাত জামিনে তাঁর মুক্তির আদেশ দেয়, কর্তৃপক্ষ প্রতিবার নতুন অভিযোগ গঠন করে তাঁর কারামুক্তি আটকে দিয়েছে।
গত মাসে, পুলিশ ফেডেরাল হাই কোর্টকে জানায় যে, শুধু ইসলামাবাদেই খানের বিরুদ্ধে ৭০-এর বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ’বছর ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের আগে কিছু বিতর্কিত নিয়ম ব্যবহার করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পিটিআই-এর অংশগ্রহণ আটকে দেয়। খানের মনোনীত প্রার্থীরা অবশেষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। ইমরান খানের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে তারা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন লাভ করে। কিন্তু তাদের মোট আসন সংখ্যা সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পৌঁছাতে পারেনি।
পিটিআই বার বার, তাদের ভাষায়, “আইন-বহির্ভূত” আটকাবস্থা থেকে খানের মুক্তির দাবীতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করেছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের জোট সরকারের পদত্যাগেরও আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে, শরিফের সরকার পিটিআই-এর “ম্যান্ডেট চুরি” করে একটি জালিয়াতির নির্বাচনের ফসল।
বুশরা বিবি
গত মাসে, খানের স্ত্রী বুশরা বিবি তাদের দাবীর পক্ষে হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে ইসলামাবাদে বিক্ষোভ করেন। সরকার ২৬ নভেম্বর নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে পিটিআই-এর “শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ” সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পিটিআই নেতৃবৃন্দ’র ভাষ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন বিক্ষভকারী নিহত হয়। তারা বলে, নিহতদের বেশিরভাগ মারা যান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। কয়েক’শ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসছে এবং দাবী করছে কোন বিক্ষোভকারী মারা যায়নি। তারা বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি, তারা শুধু কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে।
“সরকার সংযত ছিল, এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শুধু জলকামান আর কাঁদানে গ্যাস ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র নয়,” পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক ডার বুধবার ইসলামাবাদে বিদেশী কূটনীতিকদের সাথে একটি ব্যতিক্রমী বৈঠকে বলেন।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিদেশী অতিথিদের প্রতি তার ভাষণের একাংশ সরাসরি সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ভিওএ’কে জানায়, একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে বৈঠক পাকিস্তানের কূটনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম।
সমালোচকরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তির উপর এই নিপীড়নের ফলে পাকিস্তান সরকার যে ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে আছে, বিদেশী কূটনীতিকদের জন্য এই ব্যতিক্রমী ব্রিফিং-এ তারই প্রতিফলন ঘটেছে।