অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

লেবাননের হিজবুল্লাহ যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী আধা-সামরিক বাহিনী হয়ে উঠলো


হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ১৯৯৪ সালের ২৪ জুলাই বৈরুতে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন। ফাইল ফটো।
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ১৯৯৪ সালের ২৪ জুলাই বৈরুতে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন। ফাইল ফটো।

প্রায় এক বছর ধরে গুলি বিনিময়ের পর ইসরায়েল এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এখন এক ভয়ানক সংঘাতে লিপ্ত, যা পূর্ণ যুদ্ধে পরিণত হবার আশংকা সৃষ্টি করছে।

ইসরায়েলের জন্য গাজার হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। অনেকে ইরান-সমর্থিত এই গ্রুপকে অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে গণ্য করে।

তবে লেবাননে হিজবুল্লাহর বেশ ক্ষমতাধর রাজনৈতিক এবং সামাজিক শাখাও আছে।

হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন তাঁর গোষ্ঠীর নতুন অস্ত্র এবং সক্ষমতা আছে। তারা উত্তর ইসরায়েলের গভীরে ড্রোন থেকে ফিল্ম করে ফুটেজ প্রকাশ করেছে, যেখানে হাইফা বন্দর লেবানন-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে অনেক দুরের অন্যান্য স্থাপনা দেখা যাচ্ছে।

গত কয়েক দিনে, তারা গত এক বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইসরায়েলের আরও গভীরে আঘাত হেনেছে।

ফাইল ফটোঃ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ১৯৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল বোমায় বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে হিজবুল্লাহর সমাবেশ।
ফাইল ফটোঃ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ১৯৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল বোমায় বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে হিজবুল্লাহর সমাবেশ।

হিজবুল্লাহ কী?

লেবাননের গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯৮২ সালে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে হয়েছিল এবং তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারিত্বর অবসান ঘটানো। নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দীর্ঘ যুদ্ধের পর হিজবুল্লাহ ২০০০ সালে তাদের লক্ষ্য অর্জন করে, যখন তারা ইসরায়েলকে সরে যেতে বাধ্য করে।

কিন্তু তারপর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে।

শিয়া মুসলমানদের সংগঠন হিজবুল্লাহ ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী এবং সরকারের অংশ, যারা ‘অ্যাক্সিস অফ রেসিস্ট্যান্স’ বা প্রতিরোধ চক্র বলে পরিচিত। হিজবুল্লাহ ছিল প্রথম গ্রুপ যাদের ইরান সমর্থন করে এবং তাদের রাজনৈতিক ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যবহার করে।

হিজবুল্লাহ শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়,তারা একটি রাজনৈতিক দল। লেবাননের সংসদে তাদের আইনপ্রনেতা আছে এবং কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন সরকারে তাদের প্রতিনিধি ছিল।

তাদের বিস্তীর্ণ সমাজসেবা মূলক কর্মকাণ্ডও রয়েছে। দক্ষিণ লেবানন এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তারা স্কুল এবং স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করে। সেসব এলাকায় তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে।

ফাইল ফটোঃ বৈরুত বিমান বন্দরের কাছে ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর ট্রাক বোমায় বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন ঘাঁটিতে আহত সৈনিকদের উদ্ধারে ব্রিটিশ সেনারা সহায়তা করছে।
ফাইল ফটোঃ বৈরুত বিমান বন্দরের কাছে ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর ট্রাক বোমায় বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন ঘাঁটিতে আহত সৈনিকদের উদ্ধারে ব্রিটিশ সেনারা সহায়তা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ট্রাক বোমা

শুরুর দিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে হামলা পরিচালনা করতো, যে কারণে ওয়াশিংটন তাদের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে।

এই হামলাগুলোর মধ্যে ছিল বৈরুতে আমেরিকান নাগরিক অপহরণ এবং ১৯৮৩ সালে বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন বাহিনীর ব্যারাকে ট্রাক বোমা হামলা, যেটায় ২৪১ জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়।

“ইরানের সমর্থন হিজবুল্লাহকে লেবাননের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক গ্রুপ হিসেবে তাদের অবস্থান জোরদার করতে সহায়তা করেছে। একই সাথে, তারা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সমর্থিত সামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমরাস্ত্রে সবচেয়ে সুসজ্জিত,” বলছেন লীনা খাতিব, লন্ডনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) এর মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট-এর পরিচালক।

হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ২০০৬ সালে সীমান্তের ওপারে হানা দিয়ে দু’জন ইসরায়েলি সৈন্য জিম্মি করে। এর ফলে ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে এক মাস ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে কোন হার-জিত হয়নি, কিন্তু লড়াই দক্ষিণ লেবাননে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আসে।

ফাইল ফটোঃ দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলকে বিতারিত করার ষষ্ঠ বার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৬ সালের ২৫ মে টায়ার শহরে হিজবুল্লাহর সমাবেশ।
ফাইল ফটোঃ দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলকে বিতারিত করার ষষ্ঠ বার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৬ সালের ২৫ মে টায়ার শহরে হিজবুল্লাহর সমাবেশ।

যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহকে নির্মূল করা। কিন্তু এই লেবানিজ গোষ্ঠী যুদ্ধ থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসে, এবং ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে একটি প্রধান সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।

অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ হিজবুল্লাহকে তার অস্ত্র ভাণ্ডার রাখার জন্য এবং সরকারে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য সমালোচনা করেছে।

হিজবুল্লাহর ভাবমূর্তি ২০০৮ সালের মে মাসে ক্ষুণ্ণ হয়, যখন তারা কিছু সময়ের জন্য বৈরুতের একটি অংশ দখল করে। লেবাননের সরকার হিজবুল্লাহর নিজস্ব টেলিকম নেটওয়ার্ক-এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পর হিজবুল্লাহ শহরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা কতটুকু?

হিজবুল্লাহ হচ্ছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আধা-সামরিক বাহিনী, যাদের একটি শক্ত সাংগঠনিক অবকাঠামো এবং বড় মাপের অস্ত্রাগার রয়েছে। তারা দাবী করে তাদের এক লক্ষ যোদ্ধা আছে।

হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে ভূমিকা পালন করেছে। তারা সিরিয়া এবং ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

ইসরায়েলের হিসেব মতে, হিজবুল্লাহর কাছে ১৫০,০০০ রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যার মধ্যে রয়েছে গাইডেড মিসাইল এবং দূর-পাল্লার অস্ত্র যা ইসরায়েলের যেকোনো অংশে আঘাত হানতে সক্ষম।

Rockets fired from southern Lebanon are intercepted by Israel's Iron Dome air defence system as seen from Haifa in northern Israel, on September 24, 2024.
উত্তর ইসরায়েলের বন্দর নগরী হাইফার আকাশে হিজবুল্লাহর রকেট প্রতিহত করার চেষ্টা করছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফটোঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

ইসরায়েলের সাথে বর্তমান লড়াইয়ের সময়, হিজবুল্লাহ পর্যায়ক্রমে তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারে নতুন অস্ত্র যোগ করেছে।

শুরুর দিকে হিজবুল্লাহ ট্যাংক-বিধ্বংসী রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতো। কিন্তু পরে তারা বিস্ফোরক-বাহী ড্রোন এবং প্রথমবারের মত ভূমি-থেকে-আকাশে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।

নাসরাল্লাহ বলেছেন ড্রোনগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয় এবং হিজবুল্লাহর কাছে অনেক রয়েছে।

সম্প্রতি তাদের উপর ভয়ানক এক আঘাত আসে, যখন তাদের সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার যোগাযোগ ডিভাইস লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ৩৯ জন নিহত এবং ৩,০০০ আহত হয় যাদের অধিকাংশ বেসামরিক লোক।

এই আক্রমণ হিজবুল্লাহর সরঞ্জাম সরবরাহ লাইনে নিরাপত্তার ঘাটতি প্রকাশ করে দেয়, যা ছিল তাদের জন্য অপমানজনক। এই আক্রমণের জন্য ইসরায়েলকে দোষারোপ করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার সহ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করেছে।

হাসান নাসরাল্লাহ অজ্ঞাতস্থান থেকে ভাষণ দেন। ফটোঃ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।
হাসান নাসরাল্লাহ অজ্ঞাতস্থান থেকে ভাষণ দেন। ফটোঃ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

হাসান নাসরাল্লাহ কে?

নাসরাল্লাহর জন্ম ১৯৬০ সালে বৈরুতের শহরতলী বুর্জ হামুদের একটি গরীব শিয়া পরিবারে। তারা পরবর্তীতে দক্ষিণ লেবাননে চলে যান। নাসরাল্লাহ ধর্মশাস্ত্রে পড়া-শোনা করার পর শিয়াদের রাজনৈতিক এবং আধা-সামরিক সংগঠন আমাল-এ যোগ দেন।

তিনি হিজবুল্লাহর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।

হিজবুল্লাহর তৎকালীন প্রধান ১৯৯২ সালে এক ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হবার পর নাসরাল্লাহ গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন।

দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলকে হটিয়ে দেবার জন্য এবং ২০০৬ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার জন্য নাসরাল্লাহর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। লেবানন, সিরিয়াসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশে তার ছবি বড় বিলবোর্ডে এবং সুভেনির দোকানের বিভিন্ন সামগ্রীতে শোভা পায়।

কিন্তু লেবাননে বিরোধীদের অনেক সমালোচনারও সম্মুখীন হন নাসরাল্লাহ, বিশেষ করে যারা অভিযোগ করেন তিনি দেশের ভাগ্য ইরানের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।

নাসরাল্লাহকে বাস্তববাদী বলেও গণ্য করা হয়, যিনি রাজনৈতিক ভাবে আপোষ করতে সক্ষম।

ইসরায়েল তাঁকে হত্যা করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি বহু বছর ধরে লুকিয়ে জীবন যাপন করছেন এবং তাঁর ভাষণ অজ্ঞাত স্থান থেকে রেকর্ড করে প্রচার করা হয়।

XS
SM
MD
LG