অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কমালা হ্যারিস ডেমোক্র্যাট পার্টির মনোনয়ন গ্রহণ করে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিলেন


যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস, শিকাগোতে ভাষণের এক মুহূর্তে। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস, শিকাগোতে ভাষণের এক মুহূর্তে। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) রাতে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন গ্রহণ করে বলেছেন, তিনি সকল আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

“আমি সকল আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি,” ৫৯ বছর বয়সী হ্যারিস শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনের সমাপ্তি ভাষণে বলেন। “আমি আমেরিকার সাংবিধানিক নীতি, মৌলিক নীতি, আইনের শাসন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পবিত্রতা রক্ষা করবো।”

হ্যারিস তাঁর ভাষণে নভেম্বরের নির্বাচনে তাঁর প্রতিপক্ষ, রিপাবলিকান পার্টির ডনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন আইন ভঙ্গ করতে ট্রাম্পের প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে, পুনরায় নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বেপরোয়া হতে পারেন।

“চিন্তা করুন, ডনাল্ড ট্রাম্পের উপর যদি কোন বাধা না থাকে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর বিশাল ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করবেন। আপনাদের জীবন মান উন্নত করার জন্য না, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য না, শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য,” হ্যারিস বলেন।

সমর্থকদের মাঝে কমালা হ্যারিস। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।
সমর্থকদের মাঝে কমালা হ্যারিস। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।

ভাষণে ইউক্রেন ও গাজা

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার পর থেকে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে গভীর মন্তব্য হ্যারিস তাঁর ভাষণে করেন। তিনি নেটোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন যে রাশিয়ার‍্ আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য ইউক্রেনকে সমর্থন করে যেতে হবে।

“আমেরিকার নিরাপত্তা এবং মূল্যবোধ রক্ষা করতে আমি কখনো পিছপা হবো না কারণ, গণতন্ত্র আর স্বৈরাচারের মধ্যে লড়াইয়ে আমি জানি আমার অবস্থান কোথায় এবং আমি জানি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়,” তিনি বলেন।

হ্যারিস হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ থামাতে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন ইরান এবং অন্যান্য প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করতে তিনি দ্বিধা করবেন না।

তিনি বলেন হামাসের ৭ অক্টোবর আক্রমণের পর “ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার সব সময় সমর্থন করবেন” এবং হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধ বিরতির জন্য কাজ করবেন।

তবে তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার কথাও তুলে ধরেন। “গাজায় গত ১০ মাসে জা হয়েছে তা ভয়ঙ্কর, কত নিষ্পাপ জীবন শেষ হয়ে গেছে,” হ্যারিস বলেন।

কমালা হ্যারিস এবং তাঁর স্বামী ডাগ এমহফ কনভেনশনে সমবেত ডেলেগেটদের অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।
কমালা হ্যারিস এবং তাঁর স্বামী ডাগ এমহফ কনভেনশনে সমবেত ডেলেগেটদের অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।

হ্যারিসের ভাষণ শেষে কনভেনশন হলে সমবেত ডেলিগেটদের করতালি এবং উল্লাস চলতেই থাকে। সেখানে উৎসবের আমেজ চলে আসে এবং হ্যারিসের ‘রানিং মেট’ দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী টিম ওয়ালজকে নাচতে এবং গাইতে দেখা যায়।

মিডিয়ার বিশ্লেষকরা হ্যারিসের ভাষণকে “শক্তিশালী” হিসেবে বর্ণনা করে ২০০৮ সালের কনভেনশনে আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামার ভাষণের সাথে তুলনা করেন।

হ্যারিস হচ্ছেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং প্রথম দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূত যিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়ন গ্রহণ করেলেন।

ভাষণের শুরুতে হ্যারিস তাঁর ভারতীয় মা এবং জামাইকা বংশোদ্ভূত বাবা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন এবং বলেন কীভাবে তাঁরা তার জীবন প্রভাবিত করেছে।

“আমার মা বলতেন, কাছে থাকো, কাছে থাকো,” তিনি বলেন। “কিন্তু আমার বাবা হাসতেন এবং বলতেন, ‘দৌড়াও কমালা! দৌড়াও! ভয় পেয় না। কোন কিছুকে নিজেকে থামাতে দিয়ো না।”

হ্যারিস বলেন তাঁর বাবা-মার পরিচয় হয় আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এবং তাঁরা তাকে সামাজিক ন্যায় বিচারের মূল্যবোধ দিয়ে বড় করেন।

“আমাদের মা আমাদেরকে শিখিয়েছেন, অবিচার নিয়ে কখনো অভিযোগ কোরো না, কিন্তু কিছু একটা করো,” তিনি বলেন।

কনভেনশন শেষে মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) ডাগ এমহফ, কমালা হ্যারিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম ওয়ালজ এবং তাঁর স্ত্রী গুয়েন ওয়ালজ। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।
কনভেনশন শেষে মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) ডাগ এমহফ, কমালা হ্যারিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম ওয়ালজ এবং তাঁর স্ত্রী গুয়েন ওয়ালজ। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।

শিকাগোতে ডেমোল্ক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে কমালা হ্যারিসের ভাষণ আমেরিকান রাজনীতিতে টাল-মাটাল ৮ সপ্তাহের সমাপ্তি টানে, যে সময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনী ভাগ্যে চোখ-ধাঁধানো পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

দলের সিনিয়র নেতারা জুন মাসে রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের টেলিভিশন বিতর্কে বিপর্যয়ের কারণে জনসমক্ষেই হা-হুতাশ করছিলেন। তারাই এখন হ্যারিসের প্রার্থিতার ঐতিহাসিক চরিত্র এবং নভেম্বরের নির্বাচনে দলের আশা চাঙ্গা হওয়ায় উল্লাস করছেন।

হ্যারিস তাঁর ভাষণে বলেন ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার কিম জং আনের মত বিশ্বের স্বৈরশাসকদের সাথে নমনীয়, কারণ “তিনি নিজেই একনায়ক হতে চান।” হ্যারিস বলেন নির্বাচিত হলে তিনি রাশিয়ার‍্ আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য ইউক্রেনকে সমর্থন করে যাবেন।

Balloons fall as US Vice President and Democratic presidential candidate Kamala Harris concludes her remarks at the end of the fourth and last day of the Democratic National Convention (DNC) at the United Center in Chicago, Illinois, on August 22, 2024.
কনভেনশন হলে শত শত বেলুন ছাড়া হয়। ফটোঃ ২২ অগাস্ট, ২০২৪।

বাইডেনের গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২১ জুলাই ২০২৪ সালে হোয়াইট হাউসের জন্য প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হবার প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটান।

তার ৩০ মিনিট পর, বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন।

“আজ আমি কমলাকে আমাদের দলের প্রার্থী হিসেবে আমার পূর্ণ সমর্থন এবং অনুমোদন দিতে চাই,” বাইডেন সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ লেখেন।

তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কমালা হ্যারিস দেশের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাইডেনের সিদ্ধান্ত আসে নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তাঁর বিপর্যস্ত টেলিভিশন বিতর্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করার পর।

নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বাইডেনের উপর ডেমোক্র্যাট দলের মিত্রদের ক্রমাগত চাপ ২৭ জুনের বিতর্ক অনুষ্ঠানের পর থেকে বৃদ্ধি পাবার পর এই সিদ্ধান্ত আসে।

বিতর্ক অনুষ্ঠানে ৮১-বছর বয়স্ক প্রেসিডেন্ট তাঁর চিন্তা ধারার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন, প্রায়ই প্রশ্নের উদ্ভট উত্তর দিচ্ছিলেন এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নানা মিথ্যাচারের জবাব দিতে ব্যর্থ হন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কনভেনশনের প্রথম দিনে মঞ্চে কমালা হ্যারিসের সাথে। ফটোঃ ১৯ অগাস্ট, ২০২৪।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কনভেনশনের প্রথম দিনে মঞ্চে কমালা হ্যারিসের সাথে। ফটোঃ ১৯ অগাস্ট, ২০২৪।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২৪ জুলাই ওভাল অফিস থেকে দেয়া এক ভাষণে ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে সমর্থন করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তাঁর প্রথম ভাষণে ৮১-বছর বয়স্ক বাইডেন জোর দিয়ে বলেন “গণতন্ত্র রক্ষা করা যে কোন উপাধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সামনে অগ্রসর হওয়ার সবচেয়ে ভাল পথ হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব দেয়া। আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সেটাই সব চেয়ে ভাল পথ,” বাইডেন তাঁর ভাষণে বলেন।

প্রথম নারী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত

জয়ী হলে হ্যারিস হবেন আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, বারাক ওবামার পর দেশটির দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এবং দেশের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেতা।

ডেমোক্র্যাটদের কাছে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কয়েকটি জাতীয় জরিপে দেখা যাচ্ছে যে হ্যারিস বর্তমানে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতেও এগিয়ে আছেন, যেগুলো জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে।

অপরিচিত কমালা হ্যারিস

ডেমোক্র্যাটিক দলের যারা দীর্ঘদিন ধরে ধারণা পোষণ করে আসছেন যে, এবারের নির্বাচনে পুনঃপ্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য এবং হোয়াইট হাউসে আরও চার বছর দায়িত্ব পালনের জন্য বাইডেনের বয়স অনেক বেশি, তারা দ্রুত হ্যারিসকে ঘিরে একত্রিত হন। তবে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়।

হ্যারিস যদিও দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর এবং সম্প্রতি সাড়ে তিন বছর ধরে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি আমেরিকান জনগণের কাছে তেমন সুপরিচিত ছিলেন না।

অনেক ভোটারই প্রথমবারের মতো তার কাছ থেকে দীর্ঘ বক্তব্য শুনতে পান, যখন তিনি মনোনয়ন গ্রহণের সময় ভাষণ দেন।

হ্যারিসের জাতিগত পরিচয় নিয়ে ট্রাম্পের প্রশ্ন

ডনাল্ড ট্রাম্প শিকাগোতে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্ল্যাক জার্নালিস্টের এক অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার আগে কমালা হ্যারিসের জাতি-পরিচয় নিয়ে মিথ্যা প্রশ্ন তোলেন। এ নিয়ে দ্রুত বিরোধিতার ঝড় বয়ে যায়।

রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প দাবি করেন, অতীতে হ্যারিস শুধুমাত্র তার ভারতীয় হেরিটেজের প্রচার করেছেন।

এই গোষ্ঠীর বার্ষিক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেন, “কয়েক বছর আগে তার (হ্যারিস) কৃষ্ণাঙ্গে রূপান্তরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না যে, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ এবং এখন তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচিত হতে চাইছেন। তাই, আমি জানি না, তিনি ভারতীয় নাকি কৃষ্ণাঙ্গ?”

হ্যারিস হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিকভাবে নাম করা ‘ব্ল্যাক’ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমিতি ‘আলফা কাপ্পা আলফা’তে তিনি যুক্ত ছিলেন। সেনেটর হিসেবে হ্যারিস কংগ্রেসের কৃষ্ণাঙ্গ ককাসের সদস্য ছিলেন

XS
SM
MD
LG