উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আসঞ্জ বুধবার জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের কৌঁসুলিদের সাথে এক সমঝোতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গোপন তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য দোষ স্বীকার করার কয়েক ঘণ্টা পরে একটি ভাড়া করা বিমানে তার জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেছেন।
আন্তর্জাতিক রহস্যে ঘেরা এবং বহু বছর ধরে চলা এই ফৌজদারি মামলা একটি বিরল পটভূমিতে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সমাপ্ত হয়। আসঞ্জ নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যন্ডসের সাইপানে ডিস্ট্রিক্ট আদালতে তাঁর সওয়াল পেশ করেন।
প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতাধীন এবং আসঞ্জের মাতৃভূমি অস্ট্রেলিয়ার কাছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে চান নি বলে শুনানী সাইপানে অনুষ্ঠিত হয়।
আসঞ্জ-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ সামরিক এবং কূটনৈতিক নথি, যার মধ্যে ইরাক এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অপরাধ্মুলক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত ছিল, তা গ্রহণ এবং প্রকাশ করার অভিযোগ আনা হয়।
উইকিলিক্স-এর প্রকাশ করা নথির মধ্যে ছিল ২০০৭ সালের একটি ভিডিও, যেখানে দেখা গেল বাগদাদে একটি আমেরিকান আপাচে হেলিকপ্টার আক্রমণে ১১ জন নিহত হবার ঘটনা, যার মধ্যে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক ছিলেন।
তাঁর কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রবক্তাদের কাছ থেকে জোরাল সমর্থন পায়। যে সব সামরিক কর্মকাণ্ড অন্যথায় গোপন রয়ে যেত, সেগলো জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য তারা আসঞ্জের ভুমিকার প্রশংসা করেন। তারা এই সাংবাদিকদের উপর এই ঘটনার মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেন।
ক্যানবেরায় সমর্থকদের উল্লাস
বিমান থেকে নামার সময় আসঞ্জ তার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ওপরে তোলেন। ক্যানবেরা বিমানবন্দরে তার সমর্থকরা দূর থেকে উল্লাস করে ওঠে। এর আগে আদালতে হাজিরা দেয়ার সময় তিনি যে স্যুট-টাই পরেছিলেন, সেই একই স্যুট ও টাই পরিহিত অবস্থায় তিনি তার স্ত্রী স্টেলা আসঞ্জ এবং বাবা জন শিপটনকে জড়িয়ে ধরেন। তারা টারম্যাকে আসঞ্জের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ফ্লাইটগুলোতে আসঞ্জের সাথে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত কেভিন রাড এবং যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হাইকমিশনার স্টিফেন স্মিথ। তারা দুজনই লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের সাথে আসঞ্জের মুক্তির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ পার্লামেন্টে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটিশ কারাগারে পাঁচ বছর কাটানোর পর আসঞ্জের মুক্তি তার সরকারের ‘সতর্ক, ধৈর্যশীল ও দৃঢ়সংকল্প কাজের’ ফল।
আলবানিজ বলেন, “আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই বছরে আমার সরকার এর সমাধানে নেতা পর্যায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছে ও পরামর্শ দিয়েছে। আমরা সমস্ত উপযুক্ত চ্যানেল ব্যবহার করেছি।”
সাইপান আদালতের বাইরে আসঞ্জের আইনজীবী জেনিফার রবিনসন আলবানিজকে “তার রাষ্ট্রনায়কত্ব, নীতিগত নেতৃত্ব এবং কূটনীতি যা এই ফলাফলকে সম্ভব করেছে,” তার জন্য ধন্যবাদ জানান।
ক্যানবেরা থেকে আসঞ্জ কোথায় যাবেন এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী তা এখনো স্পষ্ট নয়। তার দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী স্ত্রী ও দুই সন্তানের মা স্টেলা আসঞ্জ স্বামীর মুক্তির অপেক্ষায় কয়েকদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন।
জুলিয়ান আসঞ্জের আরেক আইনজীবী ব্যারি পোলাক ধারনা করছেন, তার মক্কেল সোচ্চার প্রচারণা চালিয়ে যাবেন।
সাইপান আদালতের বাইরে পোলাক সাংবাদিকদের বলেন, “উইকিলিকসের কাজ অব্যাহত থাকবে। মিস্টার আসঞ্জ যে বাকস্বাধীনতা ও সরকারের স্বচ্ছতার জন্য অব্যাহত শক্তি হিসেবে কাজ করবেন সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
সমঝোতা আর স্বীকারোক্তি
সোমবার জানা যায়, উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আসঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সাথে এক সমঝাতায় এসেছেন, যার ফলে তার কয়েক বছর ধরে চলা আইনগত সঙ্কটের সমাধান হবে এবং তিনি ব্রিটেনে কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন। সমঝোতার অংশ হিসেবে আসঞ্জ তাঁর বিরুদ্ধে আনা একটি ফৌজদারি অভিযোগ স্বীকার করবেন বলে আদালতে পেশ করা নথিপত্রে জানা গেছে।
এই আইনগত লড়াই একাধিক মহাদেশে বিস্তৃত ছিল, এবং তার মূল বিষয় ছিল উইকিলিক্সে এক রাশ গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করা।
আসঞ্জ বুধবার (২৬ জুন) পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের আওতাভুক্ত মারিয়ানা আইল্যন্ডস-এর ফেডেরাল আদালতে হাজিরা দেন। সেখানে তিনি এস্পিওনেজ অ্যাকট-এর অধিনে, গোপনীয় জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য বেআইনি ভাবে সংগ্রহ এবং বিতরণ করার অভিযোগ স্বীকার করবেন। আদালতে পেশ করা চিঠিতে জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এ’তথ্য জানিয়েছে।
অভিযোগে স্বীকারোক্তি এই ফৌজদারি মামলা এবং এই প্রকাশকের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার হঠাৎ সমাপ্তি ঘটায়। আসঞ্জের ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় গোপন তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট তাঁকে অনেক স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রবক্তার কাছে প্রিয় করে তোলে।
অন্য দিকে, তদন্তকারীরা বারবার বলেছে, আসঞ্জ স্পর্শকাতর তথ্য রক্ষার আইন ভঙ্গ করেন এবং দেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেন।
স্বীকারোক্তি, তারপর অস্ট্রেলিয়া
এই সমঝোতার মূল দিক হচ্ছে আসঞ্জ অপরাধ স্বীকার করবেন, এবং একই সাথে কারাগারে আর কোন সময় কাটাতে হবে না। তিনি লন্ডনে একুয়েডর দূতাবাসে কয়েক বছর আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর পর তিনি পাঁচ বছর ব্রিটেনের বেলমারশ কারাগারে আটক ছিলেন, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ আটকাতে আদলতে লড়াই করে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীরা আসঞ্জের অপরাধের জন্য পাঁচ বছরের সাজায় একমত হয়েছেন, যে পাঁচ বছর তিনি ইতোমধ্যেই কারাগারে কাটিয়েছেন।
গত মাসে আসঞ্জ তাঁর প্রত্যর্পণ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি পান। তাঁর আইনজীবীরা যুক্তি দেখান যে, তিনি আমেরিকান আদালতে বাক স্বাধীনতা পাওয়ার যথেষ্ট নিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ হয়েছে।