নাগরিকত্ব যাচাই সম্পন্ন হওয়ার পর, স্বদেশে ফিরে এসেছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কারাগারে আটক বাংলাদেশের ৪৫ নাগরিক। একই সঙ্গে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী (বিজিপি) ও অন্য বাহিনীর ১৩৪ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
শনিবার (৮ জুন) সকালে মিয়ানমারের জাহাজ ইউএমএস শিন ডুইন ৪৫ বাংলাদেশিকে নিয়ে সিট্যুয়ে বন্দর থেকে রওনা হয়ে কক্সবাজার বিআইডাব্লিউটিএ ঘাটে পৌঁছে। পরে, রবিবার (৯ জুন) মিয়ানমারের ১৩৪ সেনা সদস্য ও অন্যদের নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সাম্প্রতিক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলো।
মিয়ানমার অনুবিভাগের সমন্বয়ে, ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সিট্যুয়ের বাংলাদেশ কনসুলেটের কর্মকর্তারা সশরীরে সিট্যুয়েতে অবস্থান করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়, সাক্ষাৎকার ও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শেষ করেন এবং ট্রাভেল পারমিট কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অণুবিভাগের মহাপরিচালক মাইনুল কবীর জানান, তার উইংয়ের একজন পরিচালক জাহাজে গিয়ে বাংলাদেশিদের গ্রহণ করেছেন
মাইনুল কবীর আরো জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রত্যাগত বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে। এছাড়া, মিয়ানমারের সেনাসহ সবাইকে ফেরত দেয়া হয়।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবির সার্বিক সহায়তায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের বিজিপি ও অন্য বিভাগের সদস্যদের দ্রুত শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। পরে, বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমার দূতাবাসের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাহাজে করে আসা বিজিপি কর্মকর্তাদের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরে তিন পর্যায়ে মিয়ানমারের বিজিপি ও অন্যান্য বিভাগের ৭৫২ জনকে মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় প্রদান ও প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আগে, ২৪ এপ্রিল মিয়ানমার থেকে ১৭৩ জনসহ এ বছর মোট ২১৮ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিজিপি সদস্যদের আশ্রয়
মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে।
চলতি বছরের ফেব্রয়ারির শুরুর দিক থেকে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে, দেশটির সরকারি বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।
গত ১৯ এপ্রিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, সেই সময় মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ২৭৪ জন আশ্রয় গ্রহণ করে।
এর আগে, ফেব্রুয়ারিতে বিজিপি, সেনা সদস্য ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাসহ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৩০ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাদের মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
যা বলেছিলেন হাছান মাহমুদ
গত ৩ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, “আমাদের সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি, মিয়ানমারে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো, সেই প্রস্তাবে তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।”
এর আগে, গত ৫ ফেব্রয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠানো হবে।
আরাকান আর্মি
জাতিগত সংখ্যালঘু রাখাইন আন্দোলনের প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক শাখা হলো আরাকান আর্মি। তারা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন চায়।
এটি সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীর একটি জোটের সদস্য। এরা সম্প্রতি মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি কৌশলগত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সঙ্গে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একত্রে কাজ করে আরাকান আর্মি।
এই জোট, ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর চীন সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে একটি সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। গত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে এই অভিযান মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাখাইনে ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর নৃশংস বিদ্রোহ দমন অভিযানের ফলে, সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অন্তত ৭ লাখ ৪০ হাজার সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। রাখাইনের পুরোনো নাম আরাকান।