দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার (৩ জুন) জাতীয়তাবাদী মহিলা দল আয়োজিত আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
“সরকার গত ১৫ বছরে শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করেনি, দেশের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করেছে। এখন দ্রব্যমূল্যের অবস্থা কী? কোনো পরিবারে শান্তি নেই;” বলেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, শাকসবজি, চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমনভাবে বেড়েছে যে প্রয়োজনীয় খাবার জোগাড় করাও এখন অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
“মানুষ এখন বাচ্চাদের জন্য দুধ এবং ডিম কিনতে পারে না। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৮০০ টাকা এবং লাউ ১২০ টাকা। অবিশ্বাস্য অবস্থা;” যোগ করেন মির্জা ফখরুল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণার কথা উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন বলে মনে হচ্ছে।”
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, “মানুষ গরুর মাংস কিনতে পারছে না, ইলিশ মাছ তো দূরের কথা, এমনকি দাম বেশি হওয়ায় তারা ভালো মানের সবজি কিনতে পারছে না।”
ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে সয়াবিন তেল বা পাম তেলের দাম অনেক বেশি বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। আরো বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি এবং এক কঠিন সময় পার করছি।”
তিনি বলেন, পুলিশ, বিজিবি ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছর ধরে বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এখন সময় এসেছে নিজেদের সংগঠিত করার। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং নির্যাতন ও কারাবাসের শিকার হচ্ছি। আমাদের মা-বোনেরা বারবার জেলে যাচ্ছেন, কিন্তু আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারিনি।”
“চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে হলে আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নামতে হবে;” বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সিপিডির রিপোর্ট
বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন বিলাসী দ্রব্যে পরিণত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। তারা আরো বলেছে যে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরো দরিদ্র হয়েছে।
রোববার (২ জুন) ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৩-২৪: তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় সংস্থার গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ কথা বলেন।
সিপিডি বলেছে, বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন বিলাসীবহুল দ্রব্যে রূপান্তরিত হয়েছে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে খাদ্য ব্যয় বাড়ছে। আর এর শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “তুলনামূলকভাবে কম আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশে খাদ্য ব্যয় বেশি।”
“পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগ অপর্যাপ্ত। সামাজিক নিরাপত্তা কম। আমদানিতে শুল্ক কমানোর সুবিধা ভোক্তারা পাচ্ছেন না। সুবিধা চলে যাচ্ছে আমদানিকারকদের কাছে;” যোগ করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতি বড় রকমের ক্রান্তিকাল পার করছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাপে রয়েছে। নীতি দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, দুর্বল রাজস্ব আদায়, রাজস্ব স্পেস কমে আসা, সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ বৃদ্ধি, ব্যাংকের তারল্য কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্য, রিজার্ভের ক্রম অবনতিশীল পরিস্থিতি চলতি অর্থবছরের নতুন প্রবণতা নয়। এই পরিস্থিতি আগের অর্থবছরেও ছিলো। যে কারণে সরকার বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদহার-সহ আইএমএফের পরামর্শ মেনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক আরো বলেন, “বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি।”
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধান কিছু নিত্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, সামগ্রিকভাবে পাঁচ বছরে চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ। তবে, মোটাচালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। পাইজামের বেড়েছে ১৫ শতাংশ। “দরিদ্রদের চালের দাম বড়লোকদের চালের তুলনায় বেশি বেড়েছে। কারণ দরিদ্রদের চাল বেশি বিক্রি হয়;” যোগ করেন তিনি।
সিপিডি জানায়, গত পাঁচ বছরে মসুর ডালের দাম ৯৫ শতাংশ, আটা ৪০ শতাংশ, খোলা আটা ৫৪ শতাংশ, ময়দা ৬০ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল ৮৪ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন ৫৪ শতাংশ এবং পামঅয়েল দাম ১০৫ শতাংশ বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি বলে জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি আরো জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১০৫ টাকা। আর বাংলাদেশে সেই তেলের দাম প্রতি লিটার ১৬৩ টাকা।
দেশে উৎপাদিত মাছের দাম কম বেড়েছে বলে জানিয়েছে সিপিডি। বলেছে, তবে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ব্রয়লার মুরগির দাম ৬০ শতাংশ এবং স্থানীয় মুরগির দাম ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
সিপিডি জানিয়েছে, চিনির দাম বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। বলেছে, বাংলাদেশে এক কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়; আর ইউরোপের বাজারে এই মূল্য ৩৯ টাকা।
এছাড়া, গুড়ো দুধের দাম ৪৩ থেকে ৮০ শতাংশ, রসুনের দাম ২১০ শতাংশ, শুকনো মরিচের ১১০ শতাংশ এবং আদার দাম ২০৫ শতাংশ বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি।
অনুষ্ঠানে এমন তথ্য তুলে ধরে সিপিডির গবেষণা পরিচালক মোয়াজ্জেম বলেন, এখন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো; আসন্ন বাজেট উপস্থাপনায় যেন সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হয় এবং সাধারণ মানুষের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেন সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ থাকে।