বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকার পরও, বাংলাদেশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা কিভাবে দেশ ছাড়লেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফখরুল আরো বলেন, “সরকার শুধু বেনজীর ও আজিজ আহমেদ-কে (সাবেক সেনাপ্রধান) লালন-পালন করেনি, বরং অসংখ্য দুর্নীতিবাজ-কে প্রশ্রয় দিয়েছে।” শনিবার (১ জুন) এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
“এই ঘটনা, ‘অন্যায়কারীদের ছাড় দেয়া হবে না’ বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যকে নিছক লোকদেখানো ও প্রতারণা বলে প্রমাণ করে;” মির্জা ফখরুল যোগ করেন।
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, “আমি একটি গণমাধ্যমে দেখলাম, বেনজীর (সাবেক আইজিপি) ও তার পরিবার ৪ মে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে গেছেন। যাওয়ার আগে তিনি তার সব ব্যাংক হিসাব খালি করে প্রায় ৬০ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। টাকার পরিমাণ আরো বেশি কিনা জানি না।”
তিনি প্রশ্ন করেন বেনজীর কিভাবে দেশ ছাড়লেন? আরো বলেন, “তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য আদালতের আদেশ এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা দায়েরের পদক্ষেপের তাৎপর্য কী?”
“যখন বলা হলো তাকে কোথাও যেতে দেয়া হবে না, তখন তিনি কিভাবে সরকারের নাকের ডগার উপর দিয়ে সিঙ্গাপুর গেলেন;” আরো বলেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মন্তব্য করেছেন, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, “তারা (সরকার) কি মনে করেন সব মানুষই বোকা? বাংলাদেশের মানুষ অবিবেচক নয়, কারণ তারা বোঝে এগুলো আপনাদের লোক দেখানো মন্তব্য ও প্রতারণা। আপনারা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে দেশ শাসন করছেন।”
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে লুটপাটের নিরাপদ স্বর্গে পরিণত করেছে বলে উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব।বলেন, “আমাদের অবশ্যই এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে আমরা তাদের পরাজিত করবো, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবো।”
সিঙ্গাপুরে বেনজীর
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম শুক্রবার (৩১ মে) এবং শনিবার (১ জুন) সংবাদ প্রকাশ করেছে যে সাবেক আইজিপি বেনজীর গত ৪ মে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন।
গত ৪ মে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছেন এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর গেছেন, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকার সংবাদ মাধ্যমগুলো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
শনিবার (১ মে) দুপুরে, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সরকার নিশ্চিত নয়।
“তার দেশত্যাগের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই বেনজীর আহমেদের বিচার হবে;” আরো বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
ওবায়দুল কাদের: ‘বিব্রত নয় সরকার’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৮ মে বলেছেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। ঢাকার ধানমন্ডিতে, আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
“সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাবার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকার আপোষহীন;” যোগ করেন তিনি।
বেনজীরের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে বলে উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, দুদক স্বাধীন। সরকার দুদককে স্বাধীনতা দিয়েছেন। দুদক জানিয়েছে, বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্ত এখনো চলছে এবং আরো তদন্ত করা হবে।
“যেহেতু তদন্ত চলছে, সেহেতু তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তিনি যদি অপরাধী হন, তার বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে পারবে দুদক। অপরাধী হলে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে। তিনি যেই হোন;” যোগ করেন ওবায়দুল কাদের।
বেনজীরের বিদেশ যাত্রার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানেন না বলেও জানিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের।
এর আগে, ২৪ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অপরাধীদের বিষয়ে সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স। অপরাধীরা যত প্রভাবশালীই হোক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
কাদের আরো বলেন, ব্যক্তি যত প্রভাবশালী হোক, তারা কিছু অপরাধ-অপকর্ম করতে পারে। এখানে প্রশ্ন হলো, সরকার এ ব্যাপারে তাদের অপরাধ-অপকর্মের জন্য শাস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে সৎ সাহস দেখিয়েছে কিনা।
“শেখ হাসিনার সরকারের সে সৎ সাহস আছে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন। সেখানে যদি কেউ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয় আমরা কেনো প্রটেকশন দেবো;” যোগ করেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি আরো বলেন, হোক সে সাবেক আইজিপি কিংবা সাবেক সেনাপ্রধান। অপরাধ করলে দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, র্যাব ও বেনজীর আহমদ
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত।
এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।
বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে ‘উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির’ সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ‘ডেসিগনেট’ করেছে, বা তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
“আজিজ আহমেদ সরকারি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে লিপ্ত হন, এবং তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কাজের জন্য জবাবদিহিতা এড়াতে সহায়তা করেন,” সোমবার (২০ মে) এক বিবৃতিতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আজিজ অন্যায় ভাবে সামরিক কন্ট্রাক্ট প্রদানে তার ভাইয়ের সাথে কাজ করেন এবং নিজ সুবিধার জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেন।
“তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা দুর্বল করার জন্য অবদান রেখেছে,” বিবৃতিতে বলা হয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলে, আজিজের ‘ডেসিগনেশন’ বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার আবারো ব্যক্ত করছে।
“যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরকারি পরিষেবা আরো স্বচ্ছ, ব্যবসায়িক ও নিয়ন্ত্রক পরিবেশের উন্নয়ন এবং অর্থ পাচার সহ আর্থিক অপরাধ তদন্ত আর তার বিচারের মাধ্যমে দুর্নীতি-বিরোধী কার্যক্রম সমর্থন করে,” বিবৃতিতে বলা হয়।
এই ‘ডেসিগনেশন’ বা নিষেধাজ্ঞার ফলে, আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের অযোগ্য হবেন।
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে এ পাঁচজনের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশও দেওয়া হয়। চলমান এই পরিস্থিতি তৈরির আগেই গত ৪ মে সপরিবারে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন সদ্য অবসরে যাওয়া পুলিশের এই কর্মকর্তা। বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, গত ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনের একটি ফ্লাইটে তিন মেয়ে, স্ত্রীসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি। স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসাজনিত কারণে তারা সেদেশেই অবস্থান করছে।