অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ঘূর্ণিঝড় রিমাল: সুন্দরবনে ছিলো অস্বাভাবিক ৩৬ ঘটনার জোয়ার, মৃত প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে একশ’


ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী মৃত্যুর সংখ্যা একশ’তে পৌঁছেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী মৃত্যুর সংখ্যা একশ’তে পৌঁছেছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়েছে। শুক্রবার (৩১ মে) বিকাল পর্যন্ত বন থেকে ১১২টি হরিণ এবং ৪টি বন্য শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। নতুন করে ১১টি হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করায় মৃত প্রাণীর এই সংখ্যা দাড়িয়েছে।

বনবিভাগ জানিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সুন্দবনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিন সৃষ্টি হয়েছিলো। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতি ২৪ ঘন্টায় দুইবার ভাটা ও দুইবার জোয়ার হওয়ার কথা থাকলেও, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পূর্বক্ষণ থেকে পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টায় বনে কোনো ভাটা হয়নি।

সুন্দনবনের কটকা, কচিখালী, করমজল, পক্ষীর চর, ডিমের চর, শেলার চর ও নারিকেল বাড়িয়া এলাকা থেকে মৃত প্রাণীগুলো উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি ১৮টি হরিণ এবং একটি অজগর সাপ উদ্ধার করা হয় অসুস্থ অবস্থায়। এগুলোকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

বন বিভাগ বলছে, ঘূর্ণিঝড়ে বন বিভাগের বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। তবে, আর্থিক মূল্যে নিরূপণযোগ্য নয়, এমন ক্ষতি হয়েছে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে, বনের শতাধিক পুকুর প্লাবিত হয়ে নোনা পানি ঢুকে পড়া। এতে সুন্দরবেনের বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এছাড়া, ১১ কিলোমিটার গোলপাতা বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় রিমালে বনের প্রাণ ও প্রকৃতির কতটা ক্ষতি হয়েছে সেই হিসাব প্রস্তুত করতে আরো সময় প্রয়োজন বলে বন বিভাগ জানিয়েছে।

বন বিভাগ ও সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে এবার ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সুন্দরবন। স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় ২ বার ভাটা এবং ২ বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় বনের একটি অংশ। এবারই প্রথম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পূর্বক্ষণ থেকে পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টায় বনে কোনো ভাটা হয়নি।

এর অর্থ হলো, দীর্ঘ সময় ধরে পুরো বন পানিতে তলিয়ে ছিলো। আর জোয়ারে পানির উচ্চতা ছিলো স্বাভাবিকের চাইতে ৫/৬ ফুট বেশি। কিছু এলাকায় এর চেয়ে বেশি উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে। দীর্ঘ সময় এতো উুঁচ জোয়ারের কারণে মঙ্গলবার (২৮ মে) থেকে বণ্যপ্রাণীর বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা করছিলেন বন কর্মকর্তারা।

বন বিভাগ সূত্র আরো জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার পর বুধবার (২৯মে) সকালে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা সত্যি হতে থাকে। কটকা, কচিখালী, দুবলা, হিরণপয়েন্টের সৈকতে হরিণের মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

বৃহস্পতিবার (৩০ মে) বিকাল পর্যন্ত ৯৬টি মৃত হরিণ, ৪টি মৃত বন্যশুকর উদ্ধার করে বন বিভাগ মাটিচাপা দিয়েছে। পরে আরো মৃতপ্রাণী উদ্ধার করা হয়। তবে, বিশাল আয়তনের সুন্দরবনে প্রাণীদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো জানাতে পারছে না বনবিভাগ।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, “সুন্দরবন যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, আগে কখনো তা হয়নি। এর সঠিক তথ্য বের করতে আরো সময় প্রয়োজন।”

এখনো জলমগ্ন গ্রাম

রিমাল আঘাতের ৪ দিন পরও জলমগ্ন হয়ে আছে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রাম। এসব গ্রামের বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতে ৩ দিন ধরে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় মানুষ।

পরিস্থিতি এমন যে, সকালে মেরামত করার পর, দুপুরের জোয়ারের চাপে বিকল্প বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে আশপাশের গ্রাম।

রিমাল আঘাতের ৪ দিন পরও জলমগ্ন হয়ে আছে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রাম।
রিমাল আঘাতের ৪ দিন পরও জলমগ্ন হয়ে আছে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রাম।

পাউবো কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রিমালের আঘাতে খুলনার ৩ উপজেলার ৮ পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে যায়। এতে প্লাবিত হয় শত শত বাড়িঘর, মাছের ঘের ও ফসলি জমি।

বিরামহীন চেষ্টার পর ৫টি পয়েন্টে বাঁধ মেরামত সম্ভব হয়েছে। তবে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের দক্ষিণ কামিনীবাসিয়া এবং পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের পেড়িখালী গ্রামের ভাঙা বাঁধ দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে।

দাকোপের দক্ষিণ কামিনীবাসিয়া গ্রামে বাঁধ মেরামতের জন্য বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কাজ শুরু হয়। বাঁধের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হতেই জোয়ার চলে আসে। জোয়ারের চাপে এক পর্যায়ে পানিতে ভেসে যায় বিকল্প বাঁধ। এতে তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়নের ২০ থেকে ২২টি গ্রাম তলিয়ে যায়।

একই দৃশ্য দেখা গেছে কয়রার দশহালিয়া গ্রামে। বুধবার সকালে দুই শতাধিক মানুষ মূল ভাঙনস্থলে কাজ শুরু করেন। দুপুরের আগেই বাঁধটির ৮০ শতাংশ মেরামত কাজ শেষ করা হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে নদীতে পূর্ণ জোয়ারের সময় পানির চাপে তা ভেঙে যায়।

পাউবোর খুলনা নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ৮ স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকেছে। প্রথম দিন ৫ স্থানে বিকল্প বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়। তবে ৩টি স্থানে ৩ দিন চেষ্টা করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। “আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি;” যোগ করেন আশরাফুল আলম।

XS
SM
MD
LG