বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় রিমাল এখন স্থল নিন্মচাপে পরিণত হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, উপকূল অতিক্রম করার সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ছিলো ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উপকূলের ব্যাপক এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান সোমবার (২৭ মে) বিকেলে সচিবালয়ে জানিয়েছেন, ঝড়ে ১০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। তবে বিভিন্ন সূত্র ৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন, ১৯ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) ২ কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন।
ঝড়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে, আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয় ১০৯টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ১৯টির নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
অন্যদিকে এখনো রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বিভিন্ন আবহাওয়া ওয়েবসাইট বলছে, এই বৃষ্টিপাত আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ৬ জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। তিনি আরো জানান যে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে আংশিক এবং সম্পূর্ণ মিলে এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
সোমবার (২৭ মে) সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় রিমাল পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে মোট ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো; খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চাদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং যশোর। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭টি এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪টি জানান তিনি।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি।
ঘূর্ণিঝড় সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে, উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আট লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬টি; জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দুর্গত লোকজনকে চিকিৎসা সেবা দিতে মোট এক হাজার ৪৭১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে চালু আছে এক হাজার ৪০০ টি টিম।
নিহত ৭ জন
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো বাতাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং গাছপালা উপড়ে পড়েছে।
সোমবার (২৭ মে) পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রবিবার (২৬ মে) রাতে ও সোমবার পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা ও সাতক্ষীরায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
রবিবার রাতে বেশ কিছু এলাকার বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় শতাধিক চিংড়ি ঘের জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। এসব উপজেলার ৯টি স্থানে বাঁধ ভেঙে অন্তত ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ভোলা জেলার ঢালচর, চর কুকরি মুকরি ও মনপুরা ৪-৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ২৫ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। উপকূলীয় এলাকা থেকে আট লাখের বেশি মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন।
বিদ্যুৎহীন ২ কোটি ২২ লাখ মানুষ
রবিবার (২৬ মে) ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) ৩ কোটি ৫৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ২ কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ৮১টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পিবিএস) ৬১টি সমিতির অধীন এলাকায় এসব গ্রাহক বসবাস করছেন।
তিনি আরো জানান, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকে সোমবার পর্যন্ত যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিলো সেগুলো মূলত দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত।
“পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা পরীক্ষা করে সংযোগ চালু করা হবে;” জানান তিনি।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, “আমরা এখন ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি।”
মোবাইল টাওয়ার বন্ধ
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এর ফলে, দক্ষিণের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষ মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন না।বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং কয়েকটি জেলায় এ সমস্যা চলছে।
টেলিকম কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, একটি বিটিএসের ব্যাটারি ব্যাকআপ থাকে সাধারণত ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। এর বেশি সময় বিদ্যৎ বিচ্ছিন্ন থাকলে এ রূপ সমস্যা সৃষ্টি হয়।
ঢাকায় জলাবদ্ধতা
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মদিবসে এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন ও কাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে।
সোমবার (২৭ মে) বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৯ ঘণ্টায় ১১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
টানা বৃষ্টির কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে রাজধানীর উত্তরা ও বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কাকলী, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, রামপুরা, বাড্ডা, শ্যামলী, মানিক মিয়া এভিনিউ ও মৌচাক-সহ বিভিন্ন এলাকা।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) আবু সালেহ মোহাম্মদ রায়হান জানান, ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও শহরের সার্বিক যানচলাচল পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
পানির নিচে চট্টগ্রাম
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে চট্টগ্রাম নগরী এবং জেলার আশপাশের এলাকাগুলোতে রবিবার রাত থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম শহরে রবিবার (২৬ মে) রাত থেকে শুরু হয় দমকা হাওয়া এবং ভারি বৃষ্টি। এতে প্রথমে নগরীর নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যায়। কোনো এলাকায় হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর সমান পানি জমে।
নগরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় এবং প্রতিবন্ধকতার কারণে নিচু সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাকলিয়া, নতুন ব্রিজ, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, চকবাজার, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইট, ওয়াসার মোড়, তিন পোলের মাথা ও মেহেদীবাগ সিডিএ আবাসিক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এসব এলাকায় বেশিরভাগ রাস্তাঘাট জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে সোমবার (২৭ মে) জেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া সিটি করপোরেশন পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস জানায়, সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ২০৫ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা এমএইচএম মোসাদ্দেক জানান, রবিবার রাতে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এরপর সেটি সোমবার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করেছে। এর প্রভাবে এই প্রবল বৃষ্টিপাত।
১৭ ঘণ্টা পর বিমানবন্দর চালু
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বন্ধ করে দেয়ার ১৭ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রবিবার দুপুর ১২টা থেকে ফ্লাইট উঠা-নামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সোমবার (২৭ মে) সকাল থেকে পুনরায় রানওয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এ বিষয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল বলেন, “সোমবার ভোর ৫টা থেকে নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।”
উল্লেখ্য, বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হলে, ৭টি আন্তর্জাতিক ও ৯টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট মিলিয়ে মোট ১৬টি ফ্লাইট বাতিল হয়।
নির্বাচন স্থগিত ১৯ উপজেলায়
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির কারণে আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয় ১০৯টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ১৯টির নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সোমবার (২৭ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয়, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ১০৯টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও মাঠ প্রশাসন।
তবে নির্বাচনী এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের কারণে, কমিশন ১৯টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করেছে।
যে ১৯টি উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উপকূলীয় জেলা ১৮টি এবং রাঙামাটির একটি উপজেলা রয়েছে।
উপজেলাগুলো হলো; বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মংলা; খুলনা জেলার কয়রা, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া; বরিশাল জেলার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া; পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলা, মির্জাগঞ্জ ও দুমকি; পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া; ভোলার তজুমদ্দিন ও লালমোহন; ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া, বরগুনা জেলার বামনা ও পাথরঘাটা এবং রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি।
আগামী ২৯ মে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে মোট ৯০ টি উপজেলা পরিষদে ভোট গ্রহণ করা হবে বলে জানান ইসি সচিব।