অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরও জটিল হচ্ছে?


মিয়ানমারের যেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কক্সবাজারে জাহাজে তোলা হচ্ছে। ফটোঃ ২৫ এপ্রিল, ২০২৪।
মিয়ানমারের যেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কক্সবাজারে জাহাজে তোলা হচ্ছে। ফটোঃ ২৫ এপ্রিল, ২০২৪।

বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার কয়েক দিন দরকষাকষির পর এ’সপ্তাহে তাদের শত শত নাগরিককে একে অপরের দেশে হস্তান্তর করেছে। তবে রোহিঙ্গা সঙ্কটে অচলাবস্থার পটভূমিতে, মিয়ানমার নিয়ে গবেষণা করছেন এমন বিশ্লেষকরা এই বিনিময়কে ‘তাৎপর্যহীন’ বলে বর্ণনা করছেন।

বাংলাদেশ বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এবং অন্যান্য সংস্থার ২৮৮জন সদস্যকে ফেরত দিয়েছে। তার আগে বুধবার মিয়ানমার ১৭৩জন বাংলাদেশিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। তারা মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ চিন ডুইন দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছায়।

মিয়ানমারের সীমান্ত নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা গত মাসে রাখাইন প্রদেশে বার্মিজ সেনা বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির লড়াই থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ এবং কর্মকর্তাদের এটা ছিল দু’মাসে দ্বিতীয় দফা বাংলাদেশে পলায়ন।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি সদস্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এবার, কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের কারাগার থেকে বাংলাদেশিদের নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়।

তবে এই উদ্যোগের দৃশ্যমান সাফল্য থাকলেও, ঢাকায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন এখানে হয়তো একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মোহাম্মাদ এমদাদুল ইসলাম বলেন যে, বাংলাদেশি জেলেদের কোন না কোন সময় ছেড়ে দিতেই হত।

FILE - Myanmar junta military soldiers parade during a ceremony to mark the country's Armed Forces Day in Naypyidaw on March 27, 2024.
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিট-তে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সামরিক কুচকাওাজ। ফটোঃ ২৭ মার্চ, ২০২৪।

জেলেরা কারাগারে
“মিয়ানমার যদি তাদের কর্মকর্তাদের ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে ২০ হাজার রোহিঙ্গাকেও নিয়ে যেত, তাহলে আমি সেটা একটা ইতিবাচক ফল হিসেবে দেখতাম,” ইসলাম ভিওএ বাংলাকে বলেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর ইসলাম ১৯৯০ দশকের শেষে এবং ২০০০-এর শুরুতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিতওয়ে শহরে বাংলাদেশ কনসুলেটের মিশন প্রধান ছিলেন।

তিনি বলেন বাংলাদেশি জেলেরা সাধারণত জিপিএস না থাকায় বা ন্যাভিগেশন যন্ত্রপাতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ভুলক্রমে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়ে। মিয়ানমার নৌবাহিনী তাদের আটক করে স্থানীয় আদালতের হাতে তুলে দেয়।

দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত জেলেদের ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয় – বেআইনি ভাবে মাছ ধরার জন্য পাঁচ বছর আর বেআইনি প্রবেশের জন্য সাত বছর।

মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্ত লগ্ন প্রদেশ রাখাইনে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি আর বার্মিজ সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে।

আরাকান আর্মিতে আছে মূলত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় যাদের বেশির ভাগ মুসলিম।

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার একটি রোহিঙ্গা শিবির। ফাইল ফটোঃ ৯ মার্চ, ২০২৩।
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার একটি রোহিঙ্গা শিবির। ফাইল ফটোঃ ৯ মার্চ, ২০২৩।

জাতিগত নিধন বা জেনোসাইড

দশ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার আশ্রয় শিবিরে বাস করছেন, যাদের অধিকাংশ ২০১৭ সালের হত্যাযজ্ঞ থেকে পালিয়ে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের হত্যাযজ্ঞকে একটি জাতিগোষ্ঠীগত গণহত্যা বা জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির কাছে, মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের দ্রুত ফিরিয়ে দেয়ার বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত কিছুটা বিতর্কিত। এদের মধ্যে অন্যতম ফোরটিফাই রাইটস।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার সাথে সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা খোঁজার জন্য যাতে মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থী কর্মকর্তাদের তদন্ত করা হয়, সেজন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহবান জানায় ফোরটিফাই রাইটস।

সংস্থার প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথকে উদ্ধৃত করে ঢাকার নিউ এজ পত্রিকা জানায়, আশ্রয়প্রার্থী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেয়া এবং দেখা-শোনা করা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কিন্তু তারপরও তাদের অতীত কার্যক্রম তদন্ত করে দেখা উচিত।

“এইসব সীমান্ত রক্ষীর কাছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মিয়ানমারে অন্যান্য অপরাধ কারা করেছে, তাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে। তাদের ঠিকমত তদন্ত করা উচিত,” স্মিথকে উদ্ধৃত করে নিউ এজ জানায়।

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা মিয়ানমারের সাথে কোন সংঘাতে না গিয়ে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার উপর জোর দিচ্ছেন।

মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং আমরা কাজ করছি তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ

আন্তর্জাতিক চাপ

বিশ্লেষকরা একমত যে বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমারের সাথে সংঘাতে জড়ানো উচিত হবে না। তবে এমদাদুল ইসলাম বলছেন, এখানে অন্যান্য বিষয় আছে যেগুলো মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কঠিন করে তুলবে।

“রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিশেষ কয়েকটি ব্রিগেড,” ইসলাম বলেন। “সেই ব্রিগেডগুলো আর রাখাইনে মোতায়েন নেই। তাছাড়া, যে কর্মকর্তারা সীমান্ত পার হয়ে এসেছে, তারা নিয়মিত সেনাবাহিনীর অংশ না। তারা মূলত সীমান্ত পুলিশ, গোয়েন্দা, কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনে যা ঘটছে তা “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়”, যদিও সেটা মাঝে-মধ্যে সীমান্তের এপারেও প্রভাব ফেলে, যেমন লক্ষ্যভ্রষ্ট কামানের গোলা বা পলায়নরত কর্মকর্তা।

তিনি বলেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সাথে কাজ করছে।

তবে রাখাইনের ভেতরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রোহিঙ্গাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে বার্মিজ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করছে।

“বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা যখন রাখাইনে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে দেখবে, তখন তাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে? আর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষই বা কীভাবে সেই প্রতিক্রিয়া সামাল দেবে? বিষয়টা বড় একটা চ্যালেঞ্জ হবে,” তিনি বলেন।

XS
SM
MD
LG