তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে, যেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে – নর্থ ক্যারোলিনা, মিনেসোটা এবং মিশিগান – হাজার হাজার আমেরিকান ডেমক্র্যাট পার্টির প্রাইমারিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ভোট না দিয়ে ‘কাওকে না’ বক্সে টিক চিহ্ন দিয়েছেন।
গাজায় ইসরাইলি সামরিক অভিযানের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থনের প্রতিবাদে মিশিগানের আরব-আমেরিকানরা যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার অংশ হিসেবে এটা করা হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, অন্তত ৩০,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরাইলে গাজায় যে অস্ত্র এবং গোলা-বারুদ ব্যাবহার করছে, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এবং আমেরিকার অর্থে কেনা।
“তাঁর (বাইডেন) প্রতি আমার যে রাগ, সেটা একেবারে .. .. সেটা অপরিসীম। এর তুলনায় এমনকি আমি ট্রাম্প সম্পর্কে যা ভাবতাম তা কিছুই না,” বলছেন সামরা লোকমান, মিশিগানের ‘অ্যাবান্ডন বাইডেন’ (বাইডেনকে পরিত্যাগ করো) গ্রুপের যৌথ সভাপতি। তারা নভেম্বরের নির্বাচনে বাইডেনের পরাজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন।
“এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে, আগে যে ধারনা ছিল যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নৈতিকতায় বিশ্বাস করে, মানবাধিকার এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়ার পক্ষে, সেই ধারনা চলে গেছে।”
মিশিগানের আরব-আমেরিকানদের শুরু করা ‘কাওকে না’ প্রচারাভিযান যে ছড়িয়ে পড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মার্চ মাসের ৫ তারিখ সুপার টিউসডে প্রাইমারির দিন মিনেসোটায় ১৯ শতাংশ আর নর্থ ক্যারোলিনায় ১৩ শতাংশ ডেমক্র্যাট ভোটার ‘কাওকে না’ ভোট দেয়।
এই ‘কাওকে না’ আন্দোলন এখন তাদের দৃষ্টি ঘুরাচ্ছে ওয়াশিংটন রাজ্যের দিকে, যেখানে ১২ মার্চ প্রাইমারি অনুষ্ঠিত হবে।
বাইডেনের প্রতি বার্তা
গত ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখের প্রাইমারিতে, মিশিগানের এক লক্ষর বেশি মানুষ, যারা রাজ্যে ডেমক্র্যাট ভোটারদের ১৩ শতাংশ, “কাওকে না” ভোট দেন। আমেরিকার আরব বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর সিংহ ভাগ মিশিগানে বাস করেন।
তারা “কাওকে না” ভোট দিয়ে বাইডেনকে এই বার্তা দিচ্ছে যে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজ্যে আরব-আমেরিকানদের ভোট হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন। বাইডেনের পক্ষে মিশিগান ছাড়াই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার রাস্তা আছে, তবে সেটা অনেক বেশি কঠিন।
“বেশির ভাগ আরব-আমেরিকান ডেমক্র্যাট হিসেবে রেজিস্টার করেছেন, প্রতি একজন রিপাবলিকানের বিপরীতে দুজন ডেমক্র্যাট, কিন্তু তারা কিভাবে ভোট দেবে, তা বদলাতে পারে,” বলছেন অ্যামনি শুরায়দি, মিশিগান-ডিয়ারবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং আরব-আমেরিকান স্টাডিস-এ বিশেষজ্ঞ।
“আপনি আরব-আমেরিকান ভোটার পাবেন যারা খুব রক্ষণশীল, আর আপনি আরও পাবেন যারা খুব উদারপন্থী, অন্যান্য যেকোনো ভোটার গ্রুপের মতই। তবে, আরব-আমেরিকান এবং মুসলিম ভোটাররা ভোট দেয়ার সময় কীভাবে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি অবশ্যই একটা ভূমিকা রাখে।”
মিশিগানের ওপর মনোযোগ
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে মিশিগান ১১,০০০ এর কম ব্যবধানে জিতেছিলেন। বাইডেন ২০২০ সালে প্রায় ১২০,০০০ ভোটে মিশিগানে জয়ী হন। রাজ্যে দুই থেকে তিন লক্ষ আরব-আমেরিকান আছে বলে ধারনা করা হয়, তবে সবার ভোট দেয়ার অধিকার নেই।
“আমরা মিশিগানে আরব-আমেরিকানদের উপর মনোযোগ দিচ্ছি কারণ, নির্বাচনে ফলাফল পাল্টে দেয়ার জন্য যে সংখ্যক ভোট দরকার, তাদের প্রায় সেরকম সংখ্যা আছে,” বলছেন জেফ্রি গ্রিনাভিস্কি, ডেট্রয়েটের ওএইন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক।
মিশিগান প্রাইমারির পর, বাইডেন-এর একজন মুখপাত্র বলেন যে, প্রেসিডেন্ট “কাওকে না” প্রচারাভিযানে অংশ নেয়া ভোটারদের কথা শুনছেন, তিনিও ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি স্থায়ী এবং ন্যায্য শান্তির জন্য তাদের লক্ষ্যের সাথে একমত।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, বাইডেন প্রশাসন গাজায় সাময়িক যুদ্ধ বিরতি এবং আরও ত্রাণ সরবরাহের উপর জোর দিয়েছে। বাইডেনের প্রচারণা টিমের সদস্যরা আরব-আমেরিকান নেতাদের সাথে বৈঠকও করেছেন।
গাজা নিয়ে তরুণরা ‘বিতৃষ্ণ’
মিশিগানের মোট জনসংখ্যা এক কোটির বেশি। কাজেই, নির্বাচনের সার্বিক ফলাফলে শুধুমাত্র আরব-আমেরিকান ভোট উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারবে না, গ্রিনাভিস্কি বলেন। কিন্তু, তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্টের জন্য এখানে অন্য আরও দুশ্চিন্তার লক্ষণ আছে।
“আমি যদি বাইডেনের উপদেষ্টাদের একজন হতাম, তাহলে আমি শুধু আরব-আমেরিকান ভোট নিয়ে উদ্বিগ্ন হতাম না। এখানে তরুণদের কথা ভাবতে হবে। কারণ, তাদের সাথে আমার কথাবার্তায় দেখেছি, তারা যা দেখছে তাতে প্রায় সবাই একেবারে বিতৃষ্ণ,” গ্রিনাভিস্কি বলেন।
“আপনি যদি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অ্যান আরবর-এর ভোট দেখেন, সেখানে ভোটার উপস্থিতির হার খুব উঁচু ছিল, আর ‘কাওকে না’ ভোটও ছিল অনেক বেশি।”
কলেজ ছাত্র ইউসেফ আহমেদ, যিনি প্রাইমারিতে ‘কাওকে না’ ভোট দিয়েছেন, বলছেন যে নভেম্বরে তাঁর বাইডেনকে ভোট দেয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
“এমনকি তিনি যদি পুরোপুরি ভোল পাল্টেও ফেলেন, তিনি ইতোমধ্যে অনেক বেশি ক্ষতি করে ফেলেছেন,” আহমেদ বলেন।
ইসরাইলকে আর অস্ত্র নয়
আদম আবুসালাহ বলছেন তিনি ২০২০ সালে বাইডেনকে নির্বাচিত করার জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এমন কিছু আর করতে পারবেন না, যা তাঁকে ২০২৪ সালের জন্য ফিরে পাবেন।
“আমরা ভেবেছিলাম তিনি হবেন এমন ব্যক্তি যিনি এই দেশকে মানবতা আর সমবেদনা দিয়ে পরিচালনা করবেন। কিন্তু তা না করে তিনি ভণ্ডামি দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন,” আবুসালাহ বলেন।
“আমরা বলছি, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর না।’ আমার আর চাই না যে, আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য ইসরাইলকে আরও অস্ত্র কিনে দেয়া হোক। আমরা চাই টাকা আমাদের স্কুলের জন্য খরচ করা হবে।”
ডেমক্র্যাটদের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। মিশিগান সেনেট নির্বাচনে প্রগতিশীল আরব-আমেরিকানরা রিপাবলিকান প্রার্থী জাস্টিন এমাশ-এর দিকে ঝুঁকতে পারেন, যিনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত।
নভেম্বরে এমাশ-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন ডেমক্র্যাট দলের ইসরাইল-সমর্থক প্রার্থী এলিসা স্লটকিন।
“আমি আপনাকে বলতে পারি, আমি যদিও একজন প্রগতিশীল বামপন্থী, আমি স্লটকিন-এর বিরুদ্ধে এমাশ-এর পক্ষে ভোট দিব,” বলছেন লোকমান। “আর মিশিগান থেকে একটা রিপাবলিকান সেনেটর দেখাই যাক না কেন। ডেমক্র্যাট পার্টির হারানোর অনেক কিছু আছে, শুধু প্রেসিডেন্সিটা না।”
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তিনি কি মনে করেন রিপাবলিকান পার্টি মনোনীত ট্রাম্প আরব-আমেরিকানদের জন্য এবং ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির জন্য ভাল হবে?
জবাবে লোকমান বলেন, “আমি ট্রাম্পের ৪ বছর শাসন দেখেছি। কিন্তু ৩০,০০০ নিরীহ ফিলিস্তিনি জীবন চলে গেছে, এবং তারা আরও একটা জো বাইডেন প্রেসিডেন্সির মধ্য দিয়ে যেতে পারবে না।”