মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ ক্রমশ বেড়ে চলছে, বিশেষ করে লড়াই যখন সীমান্তের কাছে চলে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবিকে মিয়ানমারের সাথে ১৬৮-মাইল দীর্ঘ সীমান্তে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে নাফ নদী বরাবর, যে নদীর ওপারেই রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার বাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাখাইন – যার আদি নাম আরাকান – রাজ্য থেকেই ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানায়, কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় অস্থায়ী শিবির গোড়ে তুলে। কিন্তু প্রায় সাত বছর পর রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাংলাদেশ ভাল চোখে দেখছে না।
‘’মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ছোট একটি সীমান্ত, কিন্তু অনেক বড় একটি ইস্যু আছে,’’ তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব ভিওএকে বলেন।
সেই ‘বড় ইস্যু’ এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে, কারণ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অস্বীকার করে আসছে।
আরাকান আর্মির অভিযান
রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই অচলাবস্থার মধ্যে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গত বছর অক্টোবর মাসে আরাকান আর্মি সহ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এক যোগে অভিযান শুরু করে, যার ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কয়েকটি রাজ্যে পিছপা হতে বাধ্য হয়েছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, রাখাইনে গোলা-গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ তাদের বাসা ঘরের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে। বান্দারবানে সীমান্তবর্তী গ্রামে ছিটকে আসা গুলিতে বাংলাদেশি হতাহত হবার খবর পাওয়া গেছে।
সপ্তাহান্তে মায়ানমার সীমান্ত পুলিশ বাহিনীর প্রায় শ’খানেক সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশের বড় উদ্বেগ হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন এবং চিন রাজ্যের লড়াই সীমান্ত পেড়িয়ে বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসতে পারে। তবে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, সেরকম সম্ভাবনা কম।
''মিয়ানমারের লড়াই বাংলাদেশে চলে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে,’’ বললেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মাদ এমদাদুল ইসলাম, যিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত রাখাইনের রাজধানী সিতওয়েতে বাংলাদেশ কন্সুলেটে মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
‘’আরাকান আর্মিকে যদি ধাওয়া খেয়ে পিছু হটতে হয়, তাহলে তাদের উত্তরে চিন রাজ্য হয়ে কাচিনের দিকে যাবার সম্ভাবনা বেশি,’’ মেজর ইসলাম ভিওএ কে বলেন। ‘’তারা জানে বাংলাদেশে তাদের স্বাগত জানানো হবে না।’’
বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা
তৌহিদ হোসেন মনে করেন সীমান্তে স্থিতিশীলতা কয়েকভাবে ব্যাহত হতে পারে। যেমন, আরাকান আর্মি যদি ধাক্কা সামলাতে না পেরে আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পার হয়, বা মিয়ানমার সেনাবাহিনী যদি বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। তবে দুটার সম্ভাবনাই ক্ষীণ বলে তিনি মনে করেন।
‘’যেটা হতে পারে, হয়তো কিছু গোলা-গুলি সীমান্তের এপারে এসে পড়তে পারে, অথবা ‘হট পারসুট’ অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করতে গিয়ে কেউ হয়তো সীমান্ত পার হতে পারে,’’ হোসেন বলেন।‘’দুটার কোনটাই গ্রহণযোগ্য হবে না,’’ তিনি বলেন।
তবে শুধু সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলিই না, এমনকি বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করবে বলে মেজর ইসলাম মনে করেন না। তাঁর মতে, এবারের পরিস্থিতি ২০১৭ থেকে ভিন্ন।
‘’আগে তাদের বাড়িঘর, দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। এবার সেটা করা হচ্ছে না। এখন দুই বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে, রোহিঙ্গারা লক্ষবস্তু না, তারা দেশের ভেতরে বাস্তচ্যুত হতে পারে,’’ তিনি বলেন।
‘’তা ছাড়া, রোহিঙ্গারা এই বার্তাও পেয়ে গেছে যে বাংলাদেশ তাদের স্বাগত জানাবে না।’’
গৃহযুদ্ধের ‘ভাল’ দিক
পর্যবেক্ষকরা একমত যে আরাকান আর্মি সহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বর্তমান অভিযান মিয়ানমারের ভেতরের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। সেই পরিবর্তিত পটভূমি বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের বার্তা নিয়ে আসতে পারে?
‘’এখানে ভাল কিছু থাকতেও পারে,’’ তৌহিদ হোসেন বলেন।‘’গত ছয় বছর আমার আলোচনা করেছি, কিন্তু আগ্রগতি কিছুই হয় নি। এখন দেখা যাক পরিস্থিতি কতদূর গড়ায়।’’
তিনি মনে করেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্মুখ সমরে পরাজিত হবার সম্ভাবনা যেমন কম, তেমনি বিদ্রোহীদের বর্তমান অভিযান প্রমাণ করছে তাদেরকে পরাস্ত করাও হয়তো সম্ভব হবে না।
‘’গৃহযুদ্ধ এক সময় শেষ হবে, তবে সেটা হয়তো আলাপ-আলোচনার মধ্যে শেষ হবে,’’ তিনি বলেন।
হোসেন বলেন, ২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজি গঠন করেছে, যুদ্ধ-পরবর্তী মিয়ানমারে তাদের বড় ভূমিকা থাকবে। যেমন থাকবে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির।
‘’আশাবাদী হওয়ার একটা জায়গা হচ্ছে, এনইউজি তাদের তিনটা ঘোষণায় প্রথমবারের মত রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে সম্বোধন করেছে। এবং তাদের যে অধিকার আছে, তাদের যে নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে, সেটা স্বীকার করা হয়েছে,’’ তিনি বলেন।
নাগরিকত্ব আইন, ১৯৮২
হোসেন জানান, ১৯৮২ সালের যে নাগরিকত্ব আইনের কারণে রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার হারিয়েছে, সেটা পর্যালোচনা এবং পরিবর্তন করার কথাও এনইউজি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ঘোষণায় বলেছে।
‘’আরাকান আর্মি সাধারণত রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না, কিন্তু তারাও কিছুদিন আগে এক বিবৃতিতে বলেছে, আরাকানের ভবিষ্যৎ প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করা হবে,’’ হোসেন বলেন।
‘’আমার মতে, বাংলাদেশের উচিত হবে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে এনইউজি এবং আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা,’’ তিনি বলেন।
তবে, গৃহযুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, এমন সম্ভাবনা সবাই উড়িয়ে দিছেন না। মেজর ইসলাম যেমন স্মরণ করিয়ে দিলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ১৯৪৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করে আসছে।
‘’এটা বলা ঠিক হবে না যে, বর্তমান লড়াই মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে তাদের অবস্থান থেকে উৎখাত করে দিচ্ছে,’’ তিনি বলেন। ‘’তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, আরাকান আর্মির অস্তিত্ব আগে সবাই জানতো না, এখন অনেকে জেনে গেছে তারা ভাল লড়াই করছে।’’
বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত
তবে মেজর ইসলাম মনে করেন না যে, গৃহযুদ্ধের এই নতুন মোড় বাংলাদেশের পক্ষে যাবে।
‘’বাংলাদেশের জন্য কোনটাই সুখবর না,’’ তিনি বলেন, যেহেতু এই মুহূর্তে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।
‘’আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশের এমন কোন কথাবার্তা হয় নাই যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে রাখাইনে পুনর্বাসন করবে,’’ তিনি বলেন। ‘’আর মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরেকটা অজুহাত পেয়ে যাচ্ছে এই বলে যে, পরিস্থিতি টালমাটাল, যুদ্ধ চলছে, আমরা কিভাবে প্রত্যাবাসন করবো?’’
জানুয়ারী মাসের ২৮ তারিখ ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে দেখা করে জানান, ‘’এটা প্রত্যাবাসনের জন্য ভাল সময় না।’’ একই দিন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন যে, রাখাইনে ‘অস্ত্রবিরতি’ হলে প্রত্যাবাসনের পথ ‘’সুগম হব।’’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মন্তব্যকে মেজর ইসলাম ‘বিপর্যয়মূলক’ বলে বর্ণনা করেন।
‘’এই অনিশ্চয়তা, এই যুদ্ধ কোনভাবেই বাংলদেশের জন্য ভাল সংবাদ বয়ে আনছে না,’’ তিনি বলেন।
নিরপত্তার প্রশ্নে গড়িমসি
গত চার দশকে বাংলাদেশকে এই নিয়ে তৃতীয় বার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যা সামলাতে হয়েছে। তবে ২০১৭ সালের আগে কখনো এত সংখ্যক মানুষ আশ্রয়ের জন্য আসেনি, বা এত দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে রয়ে যায় নি।
এর আগের দুটি সময় – ১৯৭৯ এবং ১৯৯২ সালে, প্রত্যেকবার দুই থেকে আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়, এবং তাদের বেশির ভাগ বছর খানেকের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ প্রায় মরিয়া। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বা নিরপত্তার প্রশ্নে মিয়ানমার গড়িমসি করায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কোন ফল নিয়ে আসতে পারছে না।
রোহিঙ্গারাও বার বার বলেছে তাদের নিরাপত্তা আর নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে ফিরতে অনিচ্ছুক।
জাতিগত হত্যাযজ্ঞ
ছয় বছর আগে যে পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা বাংলদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, তাকে যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘জাতিগত হত্যাযজ্ঞ’ বা ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ২০২২ সালের ২১ মার্চ ওয়াশিংটন, ডিসি’র হলোকষ্ট মেমোরিয়াল মিউসিয়ামে এক ভাষণে বলেন, ‘’আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বার্মিজ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত হত্যাযজ্ঞ এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে।’’
কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমেরিকান চাপ বা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের অবস্থানে কোন পরিবর্তন আনতে পারে নি। তৌহিদ হোসেন মনে করেন তার জন্য চীন আংশিক দায়ী।
‘’প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে চীন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে,’’ হোসেন বলেন।
মেজর ইসলাম, যিনি সিতওয়েতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করেছেন, মনে করেন তারা আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করে অভ্যস্ত।
‘’তারা দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে বসবাস করেছে। তারা আর কিছু পরোয়া করে না,’’ তিনি বলেন।
চীন - ভারত প্রতিযোগিতা
তবে এখানে ভু-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা পানি ঘোলাটে করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
দুই আঞ্চলিক শক্তি, ভারত ও চীন, মিয়ানমারে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। চীন যখন গভীর সমুদ্রে বন্দর তৈরি করছে, তখন কলকাতা বন্দরকে রাখাইনের সিতওয়ের সাথে সংযুক্ত করার ভারতীয় প্রকল্প প্রায় শেষের পথে।
প্রায় ৫০ কোটি ডলারের কালাদান প্রকল্প কলকাতা বন্দরকে সিতওয়ে এবং চিন রাজ্যে প্লেটওয়া দিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করবে। এর ফলে ভারত বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে কলকাতা থেকে পণ্য মিজোরাম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে পাঠাতে পারবে।
গত বছর ১০ মে ভারতীয় অর্থায়নে তৈরি সিতওয়ে বন্দর উদ্বোধন করা হয় কলকাতা থেকে একটি মালবাহী জাহাজ আসার মাধ্যমে। ভারতীয় গণমাধ্যমে সিতওয়ে বন্দর উদ্বোধনের খবরকে চীনা সংযোগ প্রকল্পের ‘জবাব’ বলে অভিহিত করা হয়।