অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

পূর্ব ভারতের ওড়িশায় বজ্রপাতের বিরল ঘটনা: দু' ঘণ্টায় ৬১ হাজার ৩৫০টি বাজ পড়ে মৃত ১২


ওড়িশা রাজ্য বিপর্যয় দফতর সূত্রে খবর, শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হয় বাজ পড়া। ২-৩ ঘণ্টায় ৬১ হাজার ৩৫০টি বাজ পড়ে।
ওড়িশা রাজ্য বিপর্যয় দফতর সূত্রে খবর, শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হয় বাজ পড়া। ২-৩ ঘণ্টায় ৬১ হাজার ৩৫০টি বাজ পড়ে।

ভারত সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্তের মেঘ ঘনিয়েছে। এর অভিমুখ পূর্ব ভারতের ওড়িশার দিকে। দুর্যোগ শুরু হয়েছে সারা ওড়িশা জুড়ে। ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে সে রাজ্যে গত শনিবার ২ অগাস্ট। মাত্র দু’ঘণ্টায় ৬১ হাজারের বেশি বাজ পড়ে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ইদানীংকালে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৯-’২০ সালের তুলনায় ২০২০-’২১ সালে বজ্রপাতের হার বেড়েছে ৯৯.৭৬ শতাংশ। কিন্তু মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে ৬১ হাজারের বেশি বাজ পড়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়।খামখেয়ালি আবহাওয়া, উত্তাপ বাড়ছে, তার মধ্যেই বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর ফলেই বজ্রপাতের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলেই জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।

ওড়িশা রাজ্য বিপর্যয় দফতর সূত্রে খবর, শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হয় বাজ পড়া। ২-৩ ঘণ্টায় ৬১ হাজার ৩৫০টি বাজ পড়ে। এত ঘন ঘন বজ্রপাতকে বিরল ঘটনা বলেই মনে করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। মৃতের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ জনে। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে মৃতদের পরিবার পিছু চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

মৌসম ভবন মঙ্গলবার ৫ অগাস্ট জানিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় ঘূর্ণাবর্ত ২৪ ঘণ্টায় নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা। এই নিম্নচাপের অভিমুখ ওড়িশারই দিকেই। এর জেরে আগামী ৭ তারিখ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওড়িশায় আবহাওয়ার এমন চরম অবস্থা থাকবে।

বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যদি বেশি হয় এবং চারপাশে পরিবেশের তাপমাত্রা যদি বাড়ে, তাহলে সেই আর্দ্র ও উত্তপ্ত বায়ু দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হয়ে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি করে।

কিউমুলোনিম্বাস বা বজ্রগর্ভ মেঘ থেকেই সাধারণত বজ্রপাত হয়। এই বজ্রগর্ভ মেঘের প্রবাহ নীচ থেকে উপরের দিকে হয়, যাকে বলে থান্ডার ক্লাউড। এই মেঘের মধ্যে জলীয় বাষ্প বাড়তে থাকলে তাদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়, ফলে ছোট ছোট জলকণা, তুষারকণা তৈরি হয়। এদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলেই বৈদ্যুতিক আধার তৈরি হয়। যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ পাঁচ মিলিমিটার ছাড়িয়ে যায় যখন জলের অনুগুলো আলাদা হয়ে তড়িৎ ধণাত্মক ও ঋণাত্মক আধার তৈরি করে। ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি হয়। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়।

বজ্রগর্ভ মেঘের নীচের অংশে জলীয় বাষ্প ও তুষারকণার পরিমাণ বেশি থাকে। সেখানে জলকণায় সংঘর্ষ বেশি হয়, তুলনায় উপরের দিকে কম হয়। ফলে মেঘের নীচের দিকে নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেশি থাকে, আর উপরের দিকে থাকে পজিটিভ চার্জ। এই দুই বিপরীতধর্মী চার্জের প্রতিক্রিয়ায় শক্তিশালী বিদ্যুৎ ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্র মেঘের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বজ্রপাত তখনই হয় যখন মেঘের মধ্যে এই তড়িৎ ঋণাত্মক বা ইলেকট্রন চার্জের পরিমাণ বেড়ে যায়, বিপরীতে মাটিতে তড়িৎ ধণাত্মক চার্জ জমা হয়। বজ্রগর্ভ মেঘ ও মাটিতে তৈরি হওয়া দুই বিপরীতধর্মী চার্জের পরিমাণ বাড়লে মাঝের বাতাসের বাধা অতিক্রম করে একটি লাইন তৈরি হয়, যাকে বলে স্টেপড লিডার। মেঘে যে শক্তিশালী ক্ষেত্র তৈরি হয় তার প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০ হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ শক্তি থাকে। ফলে চারপাশের বাতাসও আয়নিত হয়ে যায়। এই পথেই মেঘ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি মাটিতে নেমে আসে। তখন বলা হয় বজ্রপাত হয়েছে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পরিবেশে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা আগের থেকে অনেক বেশি থাকছে। গত কয়েক বছর ধরে এপ্রিল-মে মাস নাগাদ তাপমাত্রা এতটাই বাড়ছে যে এই বজ্রগর্ভ মেঘও অনেক বেশি তৈরি হচ্ছে। তার একটা অন্যতম কারণ যেমন বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য, তেমনই আর একট কারণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। আর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত দূষণ। দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা তত বাড়ছে। ফলে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হওয়ার আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। বজ্রপাতের পরিমাণও বাড়ছে। এই বজ্রপাত সাধারণত অল্প জায়গায় মধ্যে ‘ক্লাউড টু গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ মেঘ থেকে মাটির দিকে হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ভারত্র গ্রামীণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেড়েছে। এর কারণ হল ফাঁকা মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। ফাঁকা জায়গাতে সরাসরি মেঘ থেকে ভূমিতে বিদ্যুৎ প্রবাহের লাইন তৈরি হয়, ফলে এইসব জায়গায় বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাছাড়া এখন চাষের কাজে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। সেইসব যন্ত্রে বিদ্যুৎ আকর্ষিত হয়। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হলে ফাঁকা মাঠে না গিয়ে বাড়িতেই থাকা, কিংবা বাইরে থাকলে কোনও বাড়ির নীচে আশ্রয় নেওয়া উচিত।

XS
SM
MD
LG