চাঁদের মাটি থেকে তখন হয়ত কয়েকশো মিটার দূরে ছিল চন্দ্রযান-৩। কোনওরকম গলদ ছাড়াই মসৃণভাবে নামতে নামতেই ক্যামেরা তাক করে ল্যান্ডার বিক্রম। তার হাই-রেজোলিউশন ল্যান্ডার হরাইজনটাল ভেলোসিটি ক্যামেরায় ছবি উঠতে থাকে চাঁদের। সেই ছবিই এখন ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোকে পাঠিয়েছে বিক্রম। সেই সঙ্গেই ইসরো-র গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে।
কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে ইসরো-র গ্রাউন্ড স্টেশনে বর্তমানে প্রবল উত্তেজনা। একদিকে চাঁদ-জয়ের আনন্দ, অন্যদিকে ল্যান্ডার বিক্রম ও রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে চিন্তাও ছিল। চাঁদে সফ্ট ল্যান্ডিং সফল, চাঁদের বুকে নিরাপদে নেমেছে বিক্রম। তবে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ এর পরের পর্ব নিয়ে। চাঁদের অন্ধকার দক্ষিণ মেরুর প্রতি পদে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। চাঁদের ওই অংশটা এখনও অজানা। সেখানে কী ধরনের বিপদ হতে পারে তা জানা নেই পুরোপুরি।
ছোট-বড় গহ্বরে ভরা চাঁদের ছবি তুলেছে বিক্রম। ইসরো আগেই জানিয়েছিল, অবতরণ যদি মসৃণ হয়, কোনওরকম যান্ত্রিক ত্রুটি না ঘটে, তাহলে প্রোগ্রামিং অনুযায়ী চাঁদের মাটির কাছাকাছি এলেই কাজ করা শুরু করবে ল্যান্ডার বিক্রমের রেডার ও সেন্সর। একই সঙ্গে অ্যাকটিভ হবে তার হাই-রেজোলিউশন ক্যামেরা। চাঁদে নামতে নামতে যতগুলো সম্ভব ছবি তুলবে বিক্রম। ল্যান্ডার হরাইজোনটাল ভেলোসিটি ক্যামেরা (LHVC)-এর সাহায্যে চাঁদের কক্ষপথ বা লুনার অরবিট থেকেই চাঁদের একের পর এক ছবি তুলেছিল সে। এবার চাঁদের উপর থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তুলে পাঠাল ইসরোকে।
ইসরো জানিয়েছে, এখনই রোভার প্রজ্ঞান তার কাজ শুরু করবে না। আগে অবতরণস্থলের চারদিক ভাল করে পরীক্ষা করে নেবে রোভারের রেডার ও সেন্সর। আশপাশে কোনও গহ্বর আছে কিনা, বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা তা বার বার পরীক্ষা করার পরেই চাঁদের মাটি সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। এখন চাঁদের ধুলো রেগোলিথ থেকে বাঁচাতে প্রজ্ঞানকে সুরক্ষা দিচ্ছে ইসরো। বিক্রম ও প্রজ্ঞানের গায়ে যাতে ধুলো লেগে না থাকে তা দেখা হচ্ছে।
চাঁদের মাটি ছুঁয়ে বিক্রম-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে রোভার প্রজ্ঞান। চাঁদে এখন টানা ১৪ দিন থাকবে বিক্রম-প্রজ্ঞান। তবে পৃথিবীর হিসেবে ১৪ দিন। আসলে কিন্তু এক চান্দ্র দিন, মানে চাঁদের সময়ের হিসেবে একদিন।
চাঁদের ৭০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের যেখানে বিক্রম নেমেছে সেই জায়গার আশপাশ বিপদসঙ্কুল। সেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। হিমশীতল আঁধারে ঘেরা চাঁদের দক্ষিণ পিঠ। তার উপর খানাখন্দ ছড়িয়ে চারদিকে। চাঁদের ধুলো রেগোলিথ সেখানে ছটফটে। আয়নিত কণারা প্রচণ্ড উত্তেজিত। চাঁদের ধুলো সামলে গহ্বর এড়িয়ে সাবধানে পা ফেলতে হবে রোভারকে। ৬টা চাকা ছুটিয়ে সে এবার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চষে বেড়াবে।
রোভারের চারদিকে লাগানো সোলার প্যানেল কাজ করা শুরু করবে এবার। পৃথিবীর সময়ের হিসেবে ১৪ দিন চাঁদের দক্ষিণ পিঠে সূর্যের আলো থাকবে। এই আলোকে কাজে লাগিয়েই শক্তি তৈরি করবে রোভার। তাতেই তার চাকা দৌড়বে, কাজ করবে হাই-রেজোলিউশন ক্যামেরা।
ইসরো জানিয়েছে, তৃতীয় চন্দ্রযানের রোভার অনেক উন্নত। এতে আছে আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (APXS) এবং লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপ (LIBS)। চাঁদে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলবে, নুড়ি-পাথর কুড়োবে, বরফের অস্তিত্ব খুঁজবে রোভার প্রজ্ঞান। চাঁদের মাটিতে খনিজের খোঁজও করবে সে। পাশাপাশি, চাঁদের মাটিতে অশোক স্তম্ভ এবং ইসরো-র প্রতীক চিহ্নও আঁকবে রোভার। অর্থাৎ চাঁদ জয় করে দেশের বিজয় চিহ্ন এঁকে দেবে প্রজ্ঞান।
চাঁদে বাতাস নেই। কিন্তু নানারকম গ্যাস আছে। চাঁদের মাটির কাছে গ্যাসের স্তর পরীক্ষা করবে রোভার। হিলিয়াম, নাইট্রোজেন কী মাত্রায় আছে তা পরিমাপ করবে।
চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, চৌম্বকক্ষেত্রও নেই। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের তেজ বেশি সময় ধরে দেখা যায় না। তার কারণ চাঁদ তার কক্ষপথে সামান্য হেলে থাকে। ফলে চাঁদের উত্তর মেরুর তুলনায় দক্ষিণ মেরু অনেক বেশি অন্ধকার। এই কারণে হিমশীতল দক্ষিণ মেরুতে বরফ থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর বরফ মানেই জল। জলের তড়িৎ বিশ্লেষণে পাওয়া যাবে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। এখান থেকে লাভ হবে দু’টো, এক, হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যেতে পারে জ্বালানি হিসেবে। দুই, অক্সিজেন শ্বাস নিতে সাহায্য করবে। কাজেই আগামী দিনে চাঁদে বসে মানুষের গবেষণার কাজ সহজ হবে।