বারো বছরের শাকেরা বিবির স্বপ্ন সে চিকিৎসক হবে। "ডাক্তার হয়ে মানুষের অসুখ ভাল করতে চাই," শাকেরা উত্তর দিলেন তার রোহিঙ্গা ভাষায় । বারো বছর বয়স হলেও সবে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে সে।
"মিয়ানমারে থাকলে এবার ষষ্ঠ গ্রেডে (শ্রেণীতে) পড়তো," জানালেন পাশে বসে থাকা ডাম্প ট্রাক চালক বাবা মুহাম্মদ ইউনুস । শাকেরা চার বোনের মধ্যে সবার বড়।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন শুরু করলে, রাখাইনে নিজেদের দোতলা বাড়ি রেখে পালিয়ে আসা পরিবারের সঙ্গেই দেশ ছাড়ে ছয় বছরের ছোট্ট শাকেরা, আশ্রয় হয় রোহিঙ্গা শিবির।
কুতুপালং-লাম্বাশিয়া ক্যাম্পের টিলার ঢালে পাকা মেঝের উপরে বাঁশ-তারপলিনের ঘর তাদের । দিনের বেলাও সে ঘরে আলো ঢোকে না । মাদুর বিছিয়ে সেখানেই অল্প আলোতে লেখাপড়া করতে হয় তাকে।
“বার্মার ঘরটা সুন্দর ছিল, দুই তলা ছিল, সিমেন্টের দুই তলা,” স্মৃতি হাতড়ে জানালো শাকেরা। বার্মার কথা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে তার। সে যখন এই কথা বলছে, তার মা দরজার পর্দায় মুখ ঢেকে দূর থেকে মেয়েকে দেখছেন তখন।
অবসরে মা-র সঙ্গে বাড়ির কাজে সাহায্য করে, অন্য ছোট বোনদের দেখাশোনা করে শাকেরা। আর সময় পেলে, মা শাকেরাকে লেখাপড়া দেখিয়ে দেন।
শাকেরার বাবা জানালেন মিয়ানমারে থাকতে দুই বছরে একবার হলেও তার মেয়ের জন্মদিন করতেন ।
"আগে সেখানে দাওয়াত দিয়ে মাংস এনে গরু জবাই করে, মুরগীর মাংস দিয়ে, বড় বড় আলেমদের দাওয়াত দিয়ে দাওয়াত খাওয়াইছি," ভ্যাপসা গরমে হাতপাখা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন মুহাম্মদ ইউনুস।
মিয়ানমারেও গাড়ি চালাতেন তিনি। বাংলাদেশের টাকার হিসেবে দিনে তখন তার আয় ছিলো ৩,০০০ ধেকে ৪,০০০ টাকা । “আজকে সারাদিন মিলে ২০০ টাকা ইনকাম করেছি,” জানালেন ইউনুস ।
“বার্মার জীবন অনেক সুন্দর হলেও এখন কী করব, সবারে দিলে আমাদেরও দেয়, কাজ করি, ভাল কাজ থাকলেও ওটা(ত্রাণ) দিয়ে খাইতে হয় ।“
ত্রাণের পাশাপাশি ধীরে ধীরে বিনামুল্যে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে শাকেরাও । ইংরেজি, গণিতসহ সাত বিষয় পড়ানো হয় বলে জানালো সে।
মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে চলছে লেখাপড়া
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, কক্সবাজারে দুই টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় আশ্রয় নেওয়া ৯.৬ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৫২ শতাংশই শিশু।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষার সুযোগ প্রয়োজন। ২০২২ সালের আগস্ট মাসের সরকারি তথ্য বলছে, সেখানে ৫,৬১৮ টি বিদ্যাকেন্দ্রে ২.৯২ লাখ শিশু মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, "প্রাথমিক ভাবে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসারে ২০২১ সালে কার্যক্রম শুরু করার পর এখন তা পুরোদমে চলছে।"
তিনি বলেন, "রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হলে যাতে তারা নিজ দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে না পড়েন, সে কারণেই মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে শিশুরা।"
রোহিঙ্গা শিবিরের শিক্ষক কী বলছেন
রোহিঙ্গা শিবিরের মরাগাছতলা পুলিশের নিরাপত্তা তল্লাশী থেকে ১০০ মিটার দুরে রাস্তার পাশে ছোট ছোট মেয়েদের দেখা মিললো লাফদড়ি হাতে। তাদের কাছে এগিয়ে যেতে তারা লজ্জা পেয়ে সরে গেলো। ছোট ছেলেদের দেখা মিলল ফুটবল হাতে। কেউ ব্রাজিলের জার্সি কেউ আবার আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে।
এই রোহিঙ্গা শিবিরের যুবক নাজিম উল্লাহ জানালেন কিছু কিছু সাহায্য সংস্থা বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী দিয়েছে।
নাজিম উল্লাহ ক্যাম্প-১১ তে মাসিক ৮,০০০ টাকায় শিক্ষকতা করছেন। মিয়ানমারে তিনি কলেজের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ পর তার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, "বাচ্চারা এখানে দুই ভাগে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৪:৩০ পর্যন্ত সামাজিক উন্নয়ন কেন্দ্র ও বিদ্যাকেন্দ্রে শিক্ষার সুযোগ পায়।" তবে তিনি বলেন, "সমস্যা হলো এ শিক্ষার কোন সার্টিফিকেট দেবার ব্যবস্হা নেই। তাছাড়া সবাই পড়ার সুযোগটাও পায়না।"
নাজিম উল্লাহ-র দাবি রোহিঙ্গা শিবিরের শিশুদের মধ্যে ২৫ শতাংশ মাদ্রাসায় পড়ে আর ২৫ শতাংশ স্কুলে।
"আর বাকিরা [ ৫০ শতাংশ] সবাই কাজ করে, কোনো পড়ালেখা করে না। পড়ালেখা করার জন্য অনেক আগ্রহ এদেরও আছে। আমরাও পড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু এরা রাজি হয় না," জানালেন তিনি।
নাজিমের ধারণা হলো, একটা পরিবারে যদি ৫ জন থাকে, সবাই কাজ করতে পারে না, একদম ছোট বাচ্চাকেও তাই কাজ করতে হয়।
“এনজিও, [রোহিঙ্গা ] শিবিরের কর্মকর্তারাও বলে দিয়েছে আপনারা ছোটদের কাজ দিবেন না। কিন্তু কাজ না দিলে তো এরা খাইতে পারে না," স্পষ্ট বক্তব্য নাজিম উল্লাহ-র।
এই তরুণ শিক্ষক মনে করেন, শিশুরা কাজ করে মা-বাবার সংসার চালাতে সাহায্য করে। "আপনি সেটা দেখলে চোখের পানি ফেলবেন," স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে গড়ে ওঠা বাঁশ-তারপলিনের ঘরের গা ঘেঁষে টিলার ঢালে সরু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলেন নাজিম উল্লাহ।
সেখানেই টিলার ঢালে মাটিতে বসে, আরো তিনজনকে নিয়ে খেলা করছিলো ১১ বছর বয়সী রশিদ উল্লাহ।
স্কুলে কখন যাও জানতে চাইলে, বাঁশের খুঁটি নিয়ে খেলা করতে করতে জানালো, সে মাদ্রাসায় যায়।
একটু দুরে বসা তার বয়স্ক বাবা আবদুল জব্বার। তিনি জানালেন তার সাত সন্তান। তার মধ্যে দুই ছেলে।তিনি কাজ করতে পারেন না তাই তার বড় ছেলে রশিদ মক্তবে পড়ার পাশাপাশি পান বিক্রি করে সংসারে চালাতে সাহায্য করে। বাবা জববার জানালেন, তার যে পাঁচ মেয়ে তাঁরা বাড়িতেই থাকে। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। তিনি মিয়ানমারে চাষাবাদ করতেন, মরিচের ক্ষেত করতেন, কিন্তু এখানে ক্ষেত করার সুযোগ নাই।
ছেলের মধ্যে রশিদ বড়, তার চেয়ে তার বাড়িতে বড় ছেলে আর নাই।
"এর বোন কি আর বাইরে গিয়ে টাকা ইনকাম করবে নাকি, ও যতটুকু পারে করে," ঘরের দরজায় বসে বাবার উত্তর। রশিদ জানালো, পান বিক্রি করে দিনে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা আয় হয় তার, "এগুলা দিয়ে পরিবারে বাজার করি।"
শাকেরা বড় হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নরা
শাকেরার খেলাধুলার সুযোগ কম। তাদের বাসায় যে স্মার্ট ফোন আছে সেখানে শিক্ষামুলক কন্টেন্ট দেখা কিংবা তার বান্ধবীদের সাথে পাঁচ গুটি খেলাই বিনোদন। বাইরে বের হতেও খানিকটা ভয় লাগে তার।
গত অক্টোবরে ১১ বছরের এক রোহিঙ্গা মেয়ে তাসদিয়া আক্তার উখিয়ার শরনার্থী শিবিরে সশস্ত্র হামলাকারীদের গুলিতে নিহত নয়। আর গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে উম্মে হাফসা (১১) আর আবুল ফায়েজ (৮) নামের দুই শিশু কুতুপালং শিবিরের ইরানি পাহাড় এলাকায় দুই সশস্ত্র হামলাকারীরা সংঘাতের সময় গুলিবিদ্ধ হয়।
“এখানে অনেক ভয় করে! এখন তো আমার মেয়ে একটু ছোট। আর একটু বড় হলেই আর বাইরে যেত দিব না, সারা বছর ঘরে রাখি, ঘরে ঢুকাই রাখি, বাইরের লোকে যদি বলে এরকম, কানে শুনলে অসম্ভব,” বলেন শাকেরার বাবা মুহাম্মদ ইউনুস ।
“বিভিন্ন ধরনের লোক আছে, আমার মেয়ে এত বড় হয়েছে, আমার মেয়ে পড়ালেখা করছে, এই রকম দেয়া, আমার সম্ভব না । আমার পরিবারে এই রকম নেই, পড়তে দিব না, বের(ঘর) হতে দিব না, বিয়ে দিয়ে দিব। আমাদের [পরিবারে] ১২-১৩ বছর হলে ঘরে ঢুকে যায় ( বাড়ির মধ্যেই থাকা) আর বের হতে পারে না । [শাকেরা] ডাক্তার হতে চাইলেও আমি হতে দিব না, আমার পরিবারের মধ্যে ৬ ভাই আছে, ৬ ভাইয়ের ৬টা মেয়ে আছে বড় বড়, যদি বড় হয়, মানুষের চোখে লাগলে ঢুকাই ফেলব (বাড়ির মধ্যে থাকা), অনেক লোক আছে হুজুর আছে, বড় বড় আলেম আছে, ওনাদের মেয়েকে বের করে দেয়, চাকুরী করে, এখানে যায় ওখানে যায়, আমি এই রকম পছন্দ করি না," দ্বিধাহীন জানিয়ে দিলেন মুহাম্মদ ইউনিস।