অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

"শিল্পীর কাজ হচ্ছে চলমান যে ঘটনাগুলো চলছে, তাকে প্রশ্ন করা"


আশফাক নিপুন
আশফাক নিপুন

আশফাক নিপুন (৪২) এসময়ের একজন নির্মাতা। নিজের কন্টেন্টের কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ নিজেই লেখেন। অভিনয়ও করেছেন মাঝেমধ্যে। সেরা নাট্যকার ও সেরা নাটক পরিচালক হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৭ ও ২০১৯-এ। তুমুল জনপ্রিয় ওয়েবসিরিজ 'মহানগর'-এর জন্য ২০২২-এ ডিজিটাল মিডিয়ার শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আই থেকে। সম্প্রতি আমরা কথা বলেছি তার সঙ্গে। মহানগরের দ্বিতীয় সিজন তৈরির অভিজ্ঞতা, ওটিটিতে সেন্সরশিপ, শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব ইত্যাদি নানান বিষয় উঠে এসেছে আলাপে।

ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাকিব প্রত্যয়।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ 'মহানগর' এর দ্বিতীয় সিজন সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকেই আপনাকে এদেশের সাহসী নির্মাতা বলছেন। কেন বলুনতো?

আশফাক নিপুনঃ আমার কাছে মনে হয় না যে আমি খুব বড় কিছু করে ফেলেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কথাটা বলার, আমি সে কথাটাই বলছি। কিন্তু যেহেতু সময়টা একটু প্রতিকূল… এই যে কিশোর, শামসুজ্জামান বা রাইটার মুশতাকের ঘটনাগুলো - যার ফলে মনে হচ্ছে, এটা অনেক সাহসী কোন কাজ। যদি আমরা সাধারণভাবেও চিন্তা করি - আমার ঘরে যদি কখনও আক্রমন হয়, তখন আমি কী করব? তখন কি আমি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করব? করব না। আমার বাসায় যদি আগুন লাগে, তখন কি আমি এভাবে চিন্তা করব যে, “না থাক, চুপচাপ আমি আমার রুমে বসে থাকি, অন্যের ঘর জ্বলে গেলে জ্বলে যাক”? তখন তো আমি ঝাঁপিয়েই পড়ব, রাইট? বাংলাদেশ আমার ঘর। যখন আমার পাশের ভাই বা যে কেউ আক্রান্ত হচ্ছে, তখন তার পাশে দাঁড়ানো দরকার আমারও। আমি হয়ত রাস্তায় দাঁড়াতে পারব না। সেটা আমার কাজ না। আমি পলিসিমেকার না যে পলিসিটা চেন্জ করতে পারব। একজন ক্ষুদ্র শিল্পী হিসেবে আমার যতটুকু করা দরকার, সেটা যদি আমার সামর্থের মধ্যে করতে পারি, তাহলে এ্যাটলিস্ট আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে পারব যে আমি চেষ্টা করেছিলাম। হবে কি হবে না সেটা সময় বলে দিবে। এটাই আমাকে সবসময় কিছুটা সাহস দেয়।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ এই ‘সাহস’টা কিভাবে পেলেন?

আশফাক নিপুনঃ এই সাহসটা এসেছে তিন জায়গা থেকে। প্রথমত, আমাদের সংবিধান থেকে। সংবিধানে কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। ৩৯ ধারায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। সো, একজন নাগরিক হিসেবে যখন আমার সংবিধান আমাকে এই অধিকারটা দেয়, তখন আমি কেন বলতে পারব না? আমার মনে হয় না আমি বেআইনি কিছু করছি, যখন আমি (আমার গল্পে) আশেপাশের ঘটনাকে তুলে আনতে চাই।

দ্বিতীয় সাহসের জায়গাটা দেশের মানুষ। আমি আমার দেশের মানুষকে যেভাবে চিনি, যতই আমরা পার্টিজন পলিটিক্স করি, বা যাই করি না কেন, একটা ইনহেরেন্ট সরলতা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আছে। আমরা কিন্তু অতিথিপরায়ণ জাতি। সবাই বলে এটা। অতিথিপরায়ণ আপনি কখন হবেন? যখন আপনি নিজেই উদার থাকবেন। সো উদার কখন হয়? যখন আসলে আরেকজনকে এ্যাকসেপ্ট করার ক্ষমতা থাকে, আরেকটা মতবাদকে এ্যাকসেপ্ট করার ক্ষমতা থাকে। এটা আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হতে হতে দেখে এসেছি। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি যে, পাড়া-মহল্লার মধ্যে চাচার সাথে আমার বাবার হয়ত অনেক দ্বন্দ্ব, কিন্তু দেখা যাচ্ছে কারো বিয়ে আসলে তাকে বলে যে, ভাই আসেন। আমার মেয়ের বিয়ে আপনাকে আসতেই হবে। অথচ ওদের মধ্যে কিন্তু প্রচুর দ্বন্দ্ব। ঈদের দিন কিন্তু এমন না যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে। এই ডিভিশনটা আমি ছোটবেলায় কখনো পাইনি। মতবাদের অনেক ধরণের পার্থক্য থাকতে পারে। সেটাই হচ্ছে সৌন্দর্য। সব যদি একই মতের হয়ে যায়, তাহলে তো সেই সৌন্দর্য্য থাকবে না। তো এটা আমাকে খুব সাহস দেয় - দেশের মানুষ।

আর তিন নম্বর কারণ হচ্ছে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’। আপনি দেখবেন কি - পলিটিক্স, ইকোনোমিক্স, ক্যাপিটালিজম, (সবখানেই) ‘পাওয়ার’ সবসময় ডিভাইড অ্যান্ড রুলে বিশ্বাস করে। এটা শুধু আমাদের দেশ নয়, এটা গ্লোবালি। ওনলি আর্টস অ্যান্ড কালচার এই ডিভিশনটাকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করে। আর্টস অ্যান্ড কালচারের পক্ষেই সম্ভব একদম গণমানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। পাওয়ার-প্লে সবসময় চায় একটা ডিসট্যান্স তৈরি হোক যাতে মানুষ ভয় পায়। শুধুমাত্র শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব একদম যেকোন একটা সাধারণ মানুষের ভেতরের কষ্টের কথাটা বলে আসার। জহির রায়হান পাকিস্তান আমলে ‘জীবন থেকে নেয়া’র মত একটা চলচ্চিত্র বানাতে পেরেছেন। কিভাবে পেরেছিলেন? বিকজ, উনি একজন শিল্পী।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ বলে একটা কথা আছে। সেক্ষেত্রে, মানুষের কথা তুলে আনার প্রয়োজন কেন বোধ করলেন?

আশফাক নিপুনঃ শিল্পীতো শুধুমাত্র বিনোদন দিবে - এটা আসলে শিল্পীর উদ্দেশ্য হতে পারে না। অবশ্যই বিনোদন একটা ইন্ট্রিগ্রাল পার্ট। কিন্তু শিল্পীর একধরনের দায়বদ্ধতা (আছে) সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি। অবশ্যই, অবশ্যই থাকতে হবে। শিল্পীর প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকতে হবে। শিল্পীর প্রশ্ন করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। শিল্পীর কাজ সমাধান দেয়া নয়। শিল্পীর কাজ হচ্ছে চলমান যে ঘটনাগুলো চলছে, তাকে প্রশ্ন করা। লুকায়িত যে ব্যাপারগুলো আমরা বলতে পারি না, সে ব্যাপারগুলোকে জনসম্মুখে তুলে আনা। সমাধান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রনায়কদের বা পলিসি মেকারদের। কিন্তু শিল্পীর কাজ হচ্ছে পলিসি মেকারদের পর্যন্ত এই কথাটা, এই বার্তাটা পৌঁছে দেয়া। যেটা সাধারণ মানুষরা পারে না।

সেকারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আপনি দেখবেন শিল্পীর সমাদর হয় বেশি। আপনি যদি ফ্রান্সের কথা বলেন, তাহলে ফ্রান্সকে আমরা কিভাবে চিনি? আর্টসের ক্যাপিটাল হিসেবে চিনি। শিল্পের শহর হিসেবে চিনি প্যারিসকে। ফ্রান্সে কে কবে প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কে কবে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, উনাদের কয়টা ব্রিজ হলো, কয়টা হাইরাইজ বিল্ডিং হলো, এভাবে আমরা ফ্রান্সকে যাচাই করি না। আমরা ফ্রান্সকে যাচাই করি কিভাবে? ল্যুভ মিউজিয়াম ওখানে আছে। মোনালিসা ওখানে আছে। সো একটা কান্ট্রিকে, একটা জনপদকে, একটা জনগোষ্ঠীকে যদি রিপ্রেজেন্ট করতে হয়, তাহলে আর্টসের কোন বিকল্প নেই। সাহসটা কই থেকে পেলাম? এই আর্টই আমাকে শক্তি দেয়। আর্টসের ক্ষমতা আছে যেকোন বাউন্ডারিকে মুছে ফেলার।

নুর হোসেন গায়ের মধ্যে লিখেছিলেন “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। সেটা কিন্তু তখন ক্ষমতার কাঠামোতে যারা বসে ছিল - তাদের বিরুদ্ধাচরণ। ঐ সময়ের বিচারে দ্যাট ইজ অপরাধ। এটা আপনি লিখে (রাজপথে) দাঁড়াতে পারেন না। জীবন দিয়ে তাঁকে প্রমাণ করতে হলো। ফলে কী হলো? আজকে কিন্তু নুর হোসেনকে আমরা স্মরণ করি। কেন? তিনি ওইসময়ে সময়োচিত কাজটি করার সাহস দেখিয়েছিলেন। বা আমি যদি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা বলি, যুদ্ধের সময় যে উনারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে গান গেয়েছেন, সেটা কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকের বিপক্ষে যায়। কিন্তু উনারা করেছেন। আজকে কিন্তু আমরা তাদেরকে স্মরণ করি। আমরা তাদেরকে সমাদর করি, সমাদৃত হন তারা। এটা কোত্থেকে আসে? এটা আসলে আসে ইনহেরেন্ট মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি একধরণের দায়িত্ববোধ থেকে।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ এত কিছু থাকতে ফিল্মমেকার বা নির্মাতা হতে চাইলেন কেন?

আশফাক নিপুনঃ অনেক কিছুই ট্রাই করেছি বিচ্ছিন্ন ভাবে, কিন্তু কোথাও গিয়ে আমার মাথায় এই যে ভিজুয়াল মিডিয়ামে গল্প বলা, এটা কোথাও না কোথাও গেঁথে ছিল। আমি খুব গল্পবাজ ছেলে। যেটাকে সোজা বাংলায় ‘চাপাবাজি’ বলে। বন্ধুরা বলতো, আমি খুব সুন্দর করে চাপাবাজি করতে পারি। সো, তখন আমার মনে হলো যে আমি যা কিছু বলতে চাই, সেটা যদি ভিজুয়ালি আসে… আমি ওয়ার্ল্ডের অনেক বড় বড় ফিল্মমেকারের গল্প পড়েছি। ছবিতো দেখেছিই, ওদের গল্পও দেখেছি, পড়েছি। আমি ঋত্বিক ঘটকের গল্প পড়েছি। দেশভাগের পর উনি ওখানে গিয়ে কত কষ্ট করেছেন। শেষদিন পর্যন্ত কষ্ট করে মারা গেছেন। বা আমি সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে যখন দেখলাম, বা পথের পাঁচালী যখন দেখলাম, তখন আমার মনে হলো যে, বিউটিফুল। মানে এইভাবে আসলে সেলুলয়েডে গল্প বলার ইচ্ছা। আমি যখন আব্বাস কিয়ারোস্তামির ছবি দেখছি, আমি জানিও না যে উনি বাংলাদেশ বলে কোন দেশ আছে কিনা, তা জানেন কিনা, কিন্তু সেই ইরানের ছবি দেখে আমার মনে হচ্ছে এটা আমার চিরচেনা গল্প। সেখান থেকে আমার মনে হলো যে, না, কোন একটা জায়গা থেকে তাড়নাটা থাকে।

আমি নিজেকে শিল্পী বলবো না, আমার শিল্পী হবার পথ অনেকটাই বাকি। যারাই আর্টসের চর্চা করতে চায় তারা আসলে প্ল্যান করে করতে পারে না। জয়নুল আবেদীন কোনদিন প্ল্যান করে আঁকেননি। উনি আঁকবেন এটা অনুমিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু এমন না যে খুব বেশি সাহিত্যচর্চা করে আসলেন। নজরুল ইসলাম রুটির দোকানে কাজ করতেন। সেখানেই তিনি লেখা শুরু করলেন। সাকিব আল হাসান যে সময় খেললে বাংলাদেশ গ্লোবাল ম্যাপে যাবে, সেই সময়েই এসেছেন। উনি কিন্তু হাবিবুল বাশার সুমনদের সময় আসেননি। ইভেন বঙ্গবন্ধু। আগেও কিন্তু অনেক বরেণ্য নেতা ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, যার হাত ধরে বাংলাদেশটা তৈরি হবে, সময় উনাকে ওই জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন। যার ফলে আমরা ৭ই মার্চের ভাষণ পেলাম, যার ফলে আমরা বাংলাদেশ দেশটা পেলাম। বঙ্গবন্ধু আর ২০ বছর আগে আসলে, মেইবি আমরা এই পরিক্রমাটা পেতাম না।

আমার মনে হয় কি, কোন শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, রাইটার, পেইন্টার, বা আমি যদি বলি ফিল্মমেকার, ইভেন অ্যাক্টর, সিঙ্গার, মিউজিশিয়ান - এরা কেউ কোনদিন প্ল্যান করে (আর্টিস্ট) হতে পারে না। কোথাও না কোথাও এটা আপনার ভেতরে থাকতে হবে। সময়ের দায়েরও একটা ব্যাপার আছে। সময় ঠিক করে দেয় কে কোন পজিশনে থাকবে।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ আপনার ইনফ্লুয়েন্সদের সম্পর্কে বলুন। শিল্পে স্বকীয়তার প্রয়োজনকে কিভাবে দেখেন?

আশফাক নিপুনঃ ‘থ্রু দ্যা অলিভ ট্রিজ’ আমাকে খুবই আন্দোলিত করেছিল। ‘সিনেমা প্যারাডিসো’ও খুবই আন্দোলিত করেছিল। শ্যাম বেনেগল, গোবিন্দ নিহালানির ছবি খুবই আন্দোলিত করেছিল একসময় - কারণ এগুলো একদমই মেইনস্ট্রিম হিন্দি মুভির বাইরে, পুরোপুরি প্যারালাল ছবি। আমি তখন ঠিক করে ফেলেছি যে আমি ফিল্মমেকিংই করব। কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখার পর আমি ডিসাইড করি, আমি আসলে ফিল্মমেকিংয়ে আর আসব না। কারণ, দেখার পর আমার মনে হয়েছে যে, এই ইমোশন আমি আসলে কোনদিন পর্দায় আনতে পারব না। এটা সম্ভব না! আমার ভেতরে সেটা নেই। সো আমি তখন (নিজেকে) বললাম যে, না, আমার পক্ষে সম্ভব না। তারচেয়ে ভালো, আমি সেটা বাদ দেই। আমি ছয়মাস ফিল্মমেকিং বাদ দিয়ে তখন অন্য কিছু করার চিন্তা করছিলাম।

কিন্তু ওই যে বললাম, যে কোথাও না কোথাও সময় এসে আপনাকে মিলিয়ে দিবে। সময় মিলিয়ে দিবে বলে আমি ঢাকায় এসে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথেই কাজ করছিলাম। তার সাথে কাজ করার জন্য তখন না হলেও আরো পাঁচশো জন তৈরি। ঢাকার ছেলেরাই তৈরি। কিন্তু কোথায় চট্টগ্রাম থেকে একটা ছেলে এসে উনার সাথে কাজ করল। সময়ই ঠিক করে দেয় আপনি কোথায় কখন কিভাবে যাবেন।

একটা কথা কি, ইনফ্লুয়েন্স তো সবসময় সবার কাজে থাকবে। ঋত্বিক ঘটক কাজেও কিন্তু বুনওয়েলের ইনফ্লুয়েন্স ছিল, আইজেস্টাইনের ইনফ্লুয়েন্স ছিল। সত্যজিতের উপর ছিল জিন রেনোয়ার, 'বাইসাইকেল থিভস’ দেখে উনি ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছিলেন। ইনফ্লুয়েন্স সবসময় থাকবে। এটা নিয়ে কারো কোন ডাউট নেই। আমার উপরেও ইনফ্লুয়েন্স আছে। সত্যজিৎ রায়ের যে পরিমিতিবোধ, সেটার ইনফ্লুয়েন্স আছে আমার কাজের মধ্যে। আমি বলছি না যে আমার কাজের মধ্যে সত্যজিতের ইনফ্লুয়েন্স দেখা যায়, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের যে পরিমিতিবোধ থাকার কথা, সেটা আছে। আবার ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে যে একটা পাগলা সাহস, সেটাও আমার মধ্যে কিছুটা আছে - যে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দেয়ার মত একটা ব্যাপার। দুইটাই কিন্তু পুরো বিপরীতধর্মী। আবার মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর কথা যদি বলি, দ্যা ভেরি স্পন্টিনিউয়িটি, এটাও কোথাও না কোথাও আমার মধ্যে আছে।

কোস্তা-গাভরাস বলে একজন গ্রিক ফিল্মমেকার আছেন, যিনি অস্কার জেতা ‘জি’ (Z) বানিয়েছেন, ‘মিসিং’ বানিয়েছেন। তার যে গল্পে পলিটিক্সকে তুলে আনা, সেটা আমাকে হিউজলি ইন্সপায়ার করে। জাফর পানাহি, ভেরি রিসেন্টলি আমার সবচাইতে ফেভারিট ইরানিয়ান ফিল্মমেকার, যিনি একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের সামনে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ছবি বানিয়ে যাচ্ছেন, জেল খাটছেন। উনি এখনও জেলে। উনার ছবি নিষিদ্ধ, ইরানের বাইরে নেয়া যায় না। মানে, একদম ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখ রাঙ্গিয়ে উনি ছবি বানিয়ে যাচ্ছেন। এরা আমাকে ভয়াবহ ইনফ্লুয়েন্স করে। আসলে আমরা সবাইতো কোথাও না কোথাও ইনফ্লুয়েন্সড হই।

তো, এদের কাজ অবশ্যই ইনফ্লুয়েন্স করে। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমার মনে হয় যে - ছবি, সিরিজ, পেইন্টিং, কবিতা - যাই বলি না কেন, কোথাও গিয়ে যদি পার্সোনাল টাচটা না থাকে, এটা তখন ইউনিভার্সাল হয় না। পাঠক বা দর্শক এটা হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারবে না, কিন্তু ওরা ঐ শিল্পই পছন্দ করে, যেখানে সে শিল্পীর একটা পার্সোনাল টাচ দেখে। শিল্পী যদি বারোয়ারি কাজ করে, তখন গিয়ে দেখবেন কি, দর্শক বা পাঠক, ওরা অটোমেটিক্যালি বুঝে ফেলে যে, “এটা হচ্ছে ফরমায়েশি কাজ, এটা আমি নিব না।” কিন্তু যখন দর্শক বুঝে, দিস ইজ ভেরি পার্সোনাল, তখন গিয়ে (কানেক্ট করতে পারে)। “মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই”, এটা কোথাও গিয়ে পার্সোনাল। যার জন্যেই সে কানেক্ট করেতে পারে তাড়াতাড়ি।

তো আমার মনে হয় যে - আমার বেড়ে উঠা, আমার সমসাময়িক সময়, আমার ক্রাইসিস, আমার দেশের যে টার্মোয়েল চলছে - সবকিছুই কোথাও না কোথাও আমার নিজস্ব একটা ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করায় ভূমিকা রাখছে।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ হলিউডের মুভি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আপনার অভিমত কী?

আশফাক নিপুনঃ স্টুডিও ফিল্ম থেকে ইন্ডি ফিল্ম - সবকিছুই হলিউডে হয়। হলিউড যেহেতু একটা প্রপার সিস্টেমেটিক চ্যানেল, সেখানে সবার জায়গা আছে। সেখানে একজন ব্রাজিলিয়ান ফিল্মমেকার গিয়েও ছবি বানাতে পারছে, স্প্যানিশ ফিল্মমেকারও পারছে, মেক্সিকো থেকে আলফানসো কুরোও গিয়ে ছবি বানাতে পারছে। সো, হলিউডকে চলচ্চিত্রের মক্কা বা সূতিকাগার বলা যেতে পারে। হলিউডের ছবি আমার খুবই পছন্দ।

অনেক ছবিই খুব পছন্দ। গত অস্কারে নমিনেশন পেয়েছিল যে ছবিটা - ‘দ্যা বানশিজ অফ ইনিশেরিন’। আমি খুব চেয়েছিলাম এই ছবিটা অস্কার পাক। আমার অসম্ভব প্রিয়। আবার ‘লা লা ল্যান্ড’ - পুরোপুরি একধরণের ফ্যান্টাসি ছবি, কিন্তু এটাও আমার পছন্দের। যদি স্পিলবার্গের আগের ছবি বলি, ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ আমার প্রিয়। ইনারিতুর ছবি আমার পছন্দ, যেমন ‘রিভেন্যান্ট’। এটা ছাড়াও এখন হলিউডে প্রচুর ইন্ডি ছবি হয়। একটা ছবি আছে কেলি রাইকার্টের, একজন মহিলা নির্মাতা, ‘ওয়েনডি অ্যান্ড লুসি’ - আমার অসম্ভব প্রিয় একটা মুভি। এটা আপনি ইউজুয়াল টপ বক্স অফিস চার্টে পাবেন না।

এখনও হলিউডে যখন লেটেস্ট কোন রিলিজ আসে, আমি সিনপসিস পড়ি। যখন মনে হয় যে মুভিটা আমার সেনবেলিটির সাথে যায় (আমি দেখে ফেলি)। ধরুন হলিউড থেকে নির্মিত এবছর যে ছবিটা (অস্কার পেলো), ‘এভরিথিং এভরিহয়ার অল অ্যাট ওয়ানস’, এটা আমি কলকাতায় আইম্যাক্সে দেখেছিলাম, এবং আই ওয়াজ ব্লোন আওয়ে। এটাও কিন্তু হলিউডের ছবি। ওরা সিনেমার গ্রামারকে ভেঙে চুরে, এডিটিংয়ের গ্রামারকে ভেঙে চুরে, মানে একদিকে নিয়ে চলে গেল, ব্রিলিয়ান্ট! আমার তো মনে হয়, শেষ দিন পর্যন্ত কোন ছবি থাকুক আর না থাকুক, হলিউডের ছবি থাকবেই।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ হলিউডে বা নেটফ্লিক্স/অ্যামাজনে কাজ করার সুযোগ পেলে কাকে ক্যাস্ট করবেন? কেমন গল্প বলবেন?

আশফাক নিপুনঃ এটা আসলে বামন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার মত অবস্থা হয়ে যাবে। আমি চাইলাম বললেই কি সেটা হয়ে যাবে?

তবে, আমার ব্র্যাড পিটের সাথে কাজ করার খুব ইচ্ছা। নট অনলি দ্যা অ্যাকটর ব্র্যাড পিট, বাট দ্যা প্রডিউসার, ট্যু। এই রোলটা অনেকেই জানে না। উনি যে ধরণের সিনেমা প্রডিউস করেন - ‘মুন লাইট’ বা আরো অনেক ছবি আছে, যেগুলো একদমই ভিন্ন ধারার, প্রথাগত হলিউডের বাইরে। রবার্ট ডি নিরোর সাথে কাজ করা আমার স্বপ্ন। মেরিল স্ট্রিপের সাথে কাজ করার অসম্ভব ইচ্ছা, যদিও উনার এখন অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। আর যদি ইয়াংগার জেনারেশনের কথা বলি, আমি জেনিফার লরেন্সের সাথে কাজ করতে চাই। বিকজ আমি তার হিউজ ফ্যান। আমার স্কারলেট জোহানসনের সাথেও কাজ করার খুব ইচ্ছা। মানে যদি কোনদিন… ওয়াইল্ডেস্ট ফ্যান্টাসি। এই ধরণের অ্যাক্টরদের দেখলে আমার মনে হয় যে, ওয়াও! যদি এদেরকে কোনদিন ডিরেকশন দেয়া যেত বা কোনদিন এদের সাথে কাজ করা যেত!

যদি কখনও সুযোগ হয় ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্মে গল্প বলার, তাহলে আমি একদমই আমার দেশের, যেটা আসলে আমি অন্য কোনও দেশে দেখবো না, সেই ধরনের গল্প বানাতে চেষ্টা করবো। একদমই আমার দেশের ক্রাইসিস, আমার দেশের মানুষের গল্প। মানে, আমি যদি একদম ছোট একটা উদাহরণ দিই - এই যে ভাড়াটেদের প্রবলেম, যে (ঠিকঠাক) বাসা পাওয়া যাচ্ছে না - এটা কিন্তু একদম আমাদের নিজেদের ক্রাইসিস। ধরেন, রাত এগারোটার পর গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। (তার পর) আপনি ঢুকতে পারবেন না। এটা পৃথিবীর কোথাও হয় না, আমাদের এখানেই হয়। এই যে ভেরি লোকালাইজড - যেটা আমাদের গল্প। আমি শহরের গল্প বললাম, গ্রামের দিকে অন্য রকমের গল্প আছে বা মফস্বলের দিকে আরও অন্য রকমের গল্প আছে। এই গল্পগুলো করার আমার খুব ইচ্ছা।

ভয়েস অব আমেরিকাঃ স্বতস্ফূর্ত পরিচালক হিসেবে আপনার পরিচিতি রয়েছে। আপনি নাকি সেটে বসেই স্ক্রিপ্ট লেখেন। এর পেছনে কি ফারুকীর প্রভাব আছে?

আশফাক নিপুনঃ অবশ্যই আছে। যদিও ফারুকী ভাই নিজেই এখন এখান থেকে বের হয়ে এসেছেন। এখন উনার কাজ একদম স্ক্রিপ্টবাউন্ড থাকে। আমাদের যে স্কুলিংটা ছিল, প্রথমে ফারুকী ভাই যেটা করেছিলেন, সেটা হচ্ছে স্পনটিনিউয়িটি। তখনো স্ক্রিপ্ট থাকত, কিন্তু সেটা এতটা রিহার্সড না। সেটার একটা প্রভাব তো অবশ্যই আমার উপর আছে। সেখান থেকে যদিও ফারুকী ভাই নিজেই এখন বের হয়ে এসেছেন - এখন উনি অনেক প্ল্যানড, এখন উনি অনেক বেশি কম্পোজড, ফোকাসড। ইনফ্যাক্ট, আমাকে ফারুকী ভাই মহানগরের শ্যুটের আগেও বললেন, “তুমি এভাবে শ্যুট করে পারবা না, তোমার আসলে প্রপার প্ল্যানড শ্যুটে যাওয়া উচিত”। আমি বললাম, “কি করব বলেন, যেটা আসলে শিখেছি, ঐটাই তো এখন আসলে এপ্লাই করব। এখন বয়স হয়ে গিয়েছে, বস। বুড়ো বয়সে তো আর মাস্টার্স পরীক্ষা যতবার দেই পাস করতে পারব না। এখন ধুম করে যদি চেঞ্জ করতে যাই, তাহলেতো মুশকিল। দেখি কী হয়।” সো এটায় অবশ্যই একটা ইনফ্লুয়েন্স আছে ওনার।

মহানগরের সেকেন্ড সিজন শ্যুট করেছি আমরা একুশ দিনে। ৯ এপিসোড - ২১ দিনে শ্যুট করেছি।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ মোশাররফ করিম বা ফজলুর রহমান বাবু-র মত জনপ্রিয় অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছেন মহানগরে। এ্যাক্টরদের নির্দেশনা দেয়ার ব্যাপারে আপনার স্টাইলটা কি?

আশফাক নিপুনঃ মহানগরে আমি যাদের সাথে কাজ করেছি - মোশাররফ করিম, জয়রাজ, ফজলুর রহমান বাবু, তানজিকা, দিব্য, শ্যামল মাওলা - দে আর অল ওয়ান্ডারফুল অ্যাক্টরস। এমন না যে উনারা স্কিলড না, ট্রেইনড না। সো, উনাদেরকে ডিরেকশন দেয়ার সময়, সিচুয়েশনটাতো ডেফিনেটলি বলতাম এবং আমি কি চাই সেটাও বলতাম। যদি দেখি যে স্ক্রিপ্টের সাথে বা আমি যেভাবে চিন্তা করছি, সেদিক থেকে সাংঘর্ষিক না হয়, তখন আমি তাদেরকে তাদের মত করতে দিতাম। যে মোমেন্টে আমার মনে হচ্ছে যে, না, এটা আসলে আমি যেভাবে চরিত্রটাকে দেখি, সেভাবে হচ্ছে না, তখন আমি গিয়ে ইন্টারভিন করতাম। বলতাম, এটা এভাবে করো। অনেকসময় আমি দেখিয়েও দেই যে আমি ডেলিভারিটা এভাবে চাই না, এভাবে চাই। আপনি একটু সময় নিয়ে নেন। আমি লুকটা এভাবে চাই না। আপনি চোখ সরিয়ে ফেলছেন, আপনি চোখ সরিয়ে ফেলবেন না। আমি চাই আপনি একদম তাকিয়ে থাকবেন এদিকে। এটা খুব ইম্পরট্যান্ট।

প্রপার রিহার্সাল করেই (শ্যুটে) যাই, কিন্তু সেটা অনেক আগে থেকে না। সেটা ইন্সট্যান্টলি করা। একদম এখন… এটা একধরণের ইনসিকিউরিটিতে ফেলাও বলতে পারেন। যখন আপনি একজন অভিনেতাকে অনেক আগে থেকে কোন কিছু দিবেন না, এবং ঠিক শটে যাওয়ার আগের মুহুর্তে, ৫মিনিট ১০ মিনিট আগে দিয়ে বললেন যে ডু ইট, রিহার্স করি চলেন - তখন তার হাতে কিন্তু পারফর্ম করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এটা অনেকটা ধাক্কা মেরে সাঁতার শেখানোর মত, এখন তাকে উঠতেই হবে, যেভাবেই হোক। ও তো আর বলতে পারবে না যে আমি সাঁতার জানি না, আমাকে বাঁচাও। কারণ তার নিজেরও স্টেক অনেক হাই, তার নিজেরও পারতে হবে। এই যে ওকে কম্ফোর্টজোন থেকে বের করে এনে ডিসকম্ফোর্ট জোনে ফেলে দেয়া, তখনই সে ডেস্পারেট হয়ে পারফর্ম করে। সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য সে যে সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাইটা করে। তখনই আসলে ম্যাজিকটা হয়। আমি ওই ম্যাজিকটা দেখতে পছন্দ করি এবং আমি ওই ম্যাজিকে বিশ্বাসী। তারমানে এই না যে আসলে প্রেপ করে হয় না তা। বাট আমি পার্সোনালি এটাতে বিশ্বাসী।

যে ব্রিফ আমার অ্যাক্টরদের প্রতি বা আমার টেকনিক্যাল ক্রুদের প্রতি সবসময় থাকে, সেটা হচ্ছে - ‘কমপ্লিট সারেন্ডার’ করতে হবে আমার কাছে। এটা আমার জন্য সবচাইতে ইম্পরট্যান্ট। মানে, প্রশ্নাতীতভাবে। তার মানে এই না যে কোন প্রশ্ন আসলে আমি সেটাকে ফেস করিনা। অবশ্যই আমি তাদের সাজেশন নিই। কিন্তু, চিন্তা করে যদি দেখি যে এরচেয়ে বেটার উত্তর আছে আমার কাছে, তখন আমি সেটা নিয়েই বের হই। আর যদি মনে হয় যে, না, সে যা বলছে, ঠিক - আমি একভাবে চিন্তা করছিলাম, কিন্তু সেটা আরেক ডাইমেনশনে করা যায়, সেটাও নিই।

আপনি যদি প্রশ্নাতীতভাবে সারেন্ডার করতে পারেন, আই ক্যান টেইক ইউ প্লেসেস। আমি আপনাকে এমন একজায়গায় নিয়ে যাব, যেটা হয়ত আপনি চিন্তাও করেননি। কিন্তু যদি আপনি প্রশ্নাতীতভাবে সারেন্ডার না করেন, আপনি যদি বারবার সেকেন্ড গেস করতে থাকেন, তখন আমার জন্যেও খুব ডিফিকাল্ট হবে আপনাকে ওই জায়গায় পৌছে দেয়া। যখন মোশাররফ করিম বা বাবু ভাইয়ের মত বিজ্ঞ অভিনেতা থেকে শুরু করে দিব্য, যে নতুন শুরু করল, এরা যখন কমপ্লিটলি সারেন্ডার করে, তখনই আসলে মহানগরের মত একটা প্রোডাকশন দাঁড়ানো সম্ভব হয়।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ মহানগরের দ্বিতীয় সিজন তৈরি করতে গিয়ে কোন চ্যালেঞ্জ ফেস করেছেন?

আশফাক নিপুনঃ সবসময় আসলে দ্বিতীয় সিজন কিন্তু ওয়ার্ক করে না। সেক্রেড গেমসের প্রথম সিজন যেভাবে ওয়ার্ক করল, সিজন টু সেভাবে করেনি। আমি কি এমন করলে অডিয়েন্স বলবে না যে আপনি আগের জিনিসই রিপিট করেছেন, কি এমন করলে অডিয়েন্স বলবে না যে, “ভাই আগেরটাই ভালো ছিল, টু না বানালেই পারতেন”।

অন্য কোনও শ্যুটিংয়ে গিয়ে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি আমাকে। আগে যত শ্যুট করেছি, ইনক্লুডিং মহানগর বা টেলিভিশনের কাজ - যা মন চায়, যেটা ইমিডিয়েটলি মনে আসতো - লিখে ফেলতাম, লিখে শ্যুট করতাম। এবার যেটা হয়েছে, প্রতিটা সিন, প্রতিটা অ্যাকশন আমাকে সেকেন্ড গেস করতে হয়েছে - বারবার। “আচ্ছা, এটা কি ঠিকঠাক যাচ্ছি? এটা কি ঠিক হবে? এটা কি এতটুকু যেতে পারব? এটা কি আদৌ গল্পটাকে ঝুলিয়ে দিবে?” আর একজন ডিরেক্টর যখন স্ক্রিপ্টে চ্যালেঞ্জ ফেস করে, সেটার একটা ইম্প্যাক্ট কিন্তু গোটা ক্রুয়ের উপর পড়ে। কারণ হি ইজ দ্যা ‘ক্যাপ্টেন অব দ্যা শিপ’। তার চেহারায় যদি কনফিউশন থাকে, তখন অ্যাক্টর থেকে শুরু করে ক্রু - সবাই একটু কনফিউসড হয়ে যায়। মনে করে, আচ্ছা, মেইবি ঠিক মত হচ্ছে না, আমার ভুলেই কি হচ্ছে না? সো, এটা ছিল সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ এ সময়ের বাংলাদেশের নির্মাতাদের কাজ কেমন লাগে? তাদের কাজ দেখে প্রভাবিত হন?

আশফাক নিপুনঃ আমার তো সবসময় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাজ খুবই ইন্সপায়ারিং লাগে। যদিও আমার আগের জেনারেশনের, কিন্তু স্টিল, উনাকে আমি আগের জেনারেশনের বলি না। সেই ২০০৭ সাল থেকে তিনি কন্টিনিউয়াসলি ছবি বানিয়ে যাচ্ছেন। একটা ছবি অলরেডি আটকে আছে - উনি কিন্তু থেমে নেই। ছবি বানিয়েই যাচ্ছেন। কেবল আমার গুরু বলে বলছি না - উনার এনার্জি, উনার টপিক, উনার স্টাইল আমাকে খুবই এক্সাইটেড করে।

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আমাকে অসম্ভব ইন্সপায়ার করেন। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, ওকে কোথাও দেখা যায় না, কিন্তু উনার ছবি কথা বলে - এটা আমাকে খুব ইন্সপায়ার করে। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ এক সপ্তাহ চলেছিল সিনেপ্লেক্সে। ওই সাতদিনে তিনবার লাইভ ফ্রম ঢাকা দেখেছি, বিকজ আমি বড় পর্দায়ই দেখতে চাচ্ছিলাম।

আমি নুহাশের অনেক বড় ফ্যান। নুহাশ এক ধরণের কাজ করে - একটা জনরা বেজড কাজ, ভৌতিক গল্প নিয়ে। ও যেভাবে কাজ করছে, আমাকে সেটা খুব ইন্সপায়ার করে।

শাওকি আমাকে খুব ইন্সপায়ার করে। যখন ‘তকদির’ করেছিল, তখন আমি শাওকিকে বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রথম কেউ ওয়েব সিরিজ যে কিভাবে বানাতে হয়, করে দেখালো। এর আগেও ওয়েব সিরিজ হয়েছে বাংলাদেশে, কিন্তু শাওকি ইজ দ্যা ফার্স্ট ওয়ান, তকদির ইজ দ্যা ফার্স্ট ওয়ান - যেটা একদম প্রপারলি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে, একটা ওয়েব সিরিজে কিভাবে পর্বগুলো হওয়া সম্ভব, কিভাবে দর্শকদের আটকে রেখে এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এর আগে না, আমরা একধরণের সিনেমার প্র্যাকটিসটাই ওয়েব সিরিজে করছিলাম। যারা সিনেমা বানাতে চায়, সেই সিনেমাকে ভেঙ্গেই আমরা ওয়েব সিরিজের প্যাটার্নে যাচ্ছিলাম। তকদির আমাকে ইন্সপায়ার করেছিল মহানগর বানাতে।

তবে ওইভাবে যদি বলি, কোথাও তো ডিরেক্টলি ইনফ্লুয়েন্স করেনি, কিন্তু কোথাও গিয়ে স্পিরিটটা তো অবশ্যই ইন্সপায়ার করেই। যখন ফেলো ফিল্মমেকারের একটা ভালো কাজ দেখি, তখন যতটা না কিভাবে শট নিলো, কিভাবে ছবিটা বানালো, কতটা ভালো অ্যাক্টিং করালো, তার চেয়ে যেটা আমাদের ফিল্মমেকারদের টাচ করে, সেটা হচ্ছে স্পিরিটটা। এটা একধরণের পুশ দেয় অন্যদের।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ পাঁচ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান? দশ বছর পর?

আশফাক নিপুনঃ আমি যেভাবে মহানগর এবং মহানগর দুই বানিয়েছি, সেখানে পাঁচ বছর পর যে আসলে কোথায় থাকব সেটা বলা মুশকিল। এটা শুধু আমার ইচ্ছার উপর না, কতৃপক্ষের ইচ্ছার উপরও অনেক কিছু ডিপেন্ড করে। আমাদের অবস্থাটা যদি অনুকূলে থাকত, তাহলে হয়ত আমি বলতে পারতাম। এখন যেহেতু অবস্থা কিছুটা প্রতিকূলে, যে কোন শিল্পীর জন্যেই… শিল্পী যখন আসলে ‘সহমত ভাই’ হয়ে কোন শিল্প চর্চা করে না - তখন অবস্থা প্রতিকূল হয়ে যায়। সো, সেটা যে সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছার উপর, তা নয়।

যদি আমার ইচ্ছায় বলেন, আমি পাঁচ বা দশ বছর পরে গিয়ে আরো অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই। আমি প্রথমে টিভিতে কাজ করতাম, ভেরি লিমিটেড অডিয়েন্স, এরপর ওটিটিতে কাজ করলাম, হরাইজনটা একটু বড় হলো, সিনেমা করবো, হরাইজনটা আরো বড় হবে। আমি মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই।

XS
SM
MD
LG