অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রিজার্ভে টান ও জ্বালানি সংকট: কোন পথে বাংলাদেশ


রিজার্ভে টান ও জ্বালানি সংকট: কোন পথে বাংলাদেশ
রিজার্ভে টান ও জ্বালানি সংকট: কোন পথে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে রেকর্ড হারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার পর জ্বালানি সংকট চরম আকার ধারণ করায় সরকার এলাকাভিত্তিক যে লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটছে তাতে বিশেষজ্ঞরা ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যতের’ লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছেন। তাদের মতে, সামনের কয়েক মাসে শুধু বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা কমলেও সামগ্রিক অর্থনীতির যে চাপ, বাংলাদেশের সেটি সহ্যের ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক কঠিন পরিস্থিতি হজম করতে হতে পারে।

এই অবস্থার জন্য বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বললেও মোটা দাগে গ্যাস উৎপাদন ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজিতে নির্ভর করেছিল। এখন রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উন্নত দেশগুলো এই এলএনজি কিনছে। তাদের সঙ্গে দামে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ। গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারের যে অবস্থা তাতে এখন সরকারকে এলএনজি কিনতে হলে প্রায় সাতগুণ দাম দিতে হবে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "এই সংকটের মূল কারণই জ্বালানির অভাব। সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে গ্যাসের উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর অতিরিক্ত ভর করা হয়েছে। ২০০৯-১০ সালের দিকেও গ্যাস দিয়ে আমরা ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি। গ্যাসের প্রাপ্তি যেন বজায় থাকে, সেই ব্যবস্থা আমাদের করা উচিত ছিল।"

তিনি বলেন, "এই সরকার উৎপাদন সক্ষমতায় বিশাল অর্জন দেখিয়েছে। তাদের আমলের শুরুতে সক্ষমতা ছিল ৫ হাজার মেগাওয়াট। এখন সেটা ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এই বিদ্যুৎ কী দিয়ে উৎপাদন করা হবে, সেই দিকটা একেবারেই অবহেলায় পড়েছিল। এখন এই ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জ্বালানি নেই। বিশেষ করে গ্যাস নেই। অনেক বছর ধরে গ্যাস ক্রমাগত কমে আসছে। বিপরীত দিকে গ্যাসের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ঠিক ছিল না। অনুসন্ধান কাজ হয়নি। যার ফলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই ঘাটতি পোষাতে আমরা এলএনজিতে নির্ভরশীল হয়েছি। এটা উচ্চমূল্যের জ্বালানি। এখন রাশিয়ার গ্যাস না পাওয়ার ফলে ইউরোপের দেশগুলো এলএনজিতে ভর করেছে। ফলে আমরা কিনতে পারছি না।"

"এখন বাংলাদেশের মতো সমস্যায় পৃথিবীর অনেক দেশই পড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণেই এটা হয়েছে। সরকারের পক্ষে এখন আগের চেয়ে সাতগুণ দামে ৪০ ডলার দিয়ে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব না। ওদিকে সব কিছুর দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয়ও অনেক বেড়েছে", বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর।

তিনি আরও বলেন, "সামনের দিনগুলোতে আমাদের আমদানি কমাতে হবে। দেশীয় চাহিদা কমানোর জন্য তিনটা উপায় আছে। একটা হচ্ছে এক্সচেঞ্জ রেট। সেটা মোটামুটি ছাড় দেয়া হয়েছে। আরেকটু ছাড় দিতে হবে। দুই নম্বর হচ্ছে মনিটারি পলিসি (মুদ্রানীতি)। অর্থাৎ ইন্টারেস্ট বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটি সরকার করছে না। সেখানে সরকার এখনো নয়-ছয়ের মধ্যেই অনড় হয়ে আছে। তিন নম্বর হচ্ছে ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্বনীতি) থেকেও কিছু সাপোর্ট দরকার। তেলের দাম বাড়ানো, গ্যাসের দাম বাড়ানো...ইত্যাদি করলে সেখান থেকে হয়তো চাহিদা কিছুটা কমতো। সেটাও সরকার করছে না। এখানে সরকার রেশনিং পদ্ধতিতে যাচ্ছে। এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। কাজ হবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের ব্যয় কিছুটা কমলেও ব্যক্তিখাতে তেলের ব্যবহার বেড়ে যাবে। সরকারকে মূল্যবৃদ্ধির দিকে চিন্তা করতে হবে। অথবা বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।"

রিজার্ভে ভাটার টান

রিজার্ভ প্রায় দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চার হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রিজার্ভে ঠিক কত ডলার আছে তা নিয়েও চলছে কানাঘুষা। বহুপাক্ষিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) নিয়মে হিসাব করলে রিজার্ভ ৩১ হাজার কোটি ডলারের আশপাশে থাকার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে সেটি ৩৯.৭৯ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের কাছে ইতিমধ্যে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে।

ঋণ চাওয়ার এই খবর সামনে আসার পর ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইএমএফের কাছে চিঠি লিখে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সহায়তা চেয়েছে।

এই কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির নাম প্রকাশ না করে গণমাধ্যমটি দুই পক্ষের চুক্তির একটি খসড়া দেখার দাবি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএমএফ বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সরকার সেখানে চার মাসের কথা বলছে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলছেন বিশ্ববাজারে দাম না কমলে রিজার্ভ সামনের কয়েক মাসে আরও কমে যাবে, "দাম না কমলে এভাবে বাণিজ্যখাত চলতে থাকলে আমাদের রিজার্ভ আরও কমে যাবে। তখন এক ধরনের সমস্যায় আমরা পড়ে যেতে পারি। কাজেই পলিসি পরিবর্তন করতে হবে। পলিসির পরিবর্তন ছাড়া এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। যদি বিশ্ববাজারে হঠাৎ সব কিছুর দাম কমে যায়, তাহলে ভিন্ন কথা। সরকার অল্পতে পার পেয়ে যেতে পারে। যদি সেটা না হয় তাহলে সহ্য ক্ষমতা না থাকলেও এভাবে চলতে হবে!"

সমস্যা পুরোনো, ধরন ভিন্ন

বাংলাদেশ এখন যে সমস্যায় পড়েছে সেটি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সংকট অতীতে দেখা গেলেও এবার ধরন আলাদা।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শওকত হোসেন তার সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক সংকট এবারই প্রথম না। ২০০৭-০৮ সালেও আমরা অর্থনৈতিক সংকট দেখেছি। এর আগে ১৯৯৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট হয়েছে, বিশেষ করে এশিয়ায়। তবে সময়ভেদে সংকটের ধরণ ভিন্ন হয়ে থাকে। একটার সঙ্গে আরেকটার তুলনা করা যাবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের সংকটের সঙ্গে সত্তরের দশকের শুরু দিকের সংকটের মিল আছে। তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরে সংকট দেখা দিয়েছিল। পার্থক্যটা হচ্ছে তখন সংকট ছিল জ্বালানি তেল কেন্দ্রিক। এখন মূল কারণ গ্যাস। বিশেষ করে ইউরোপে গ্যাস সংকটের বিষয়টি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।"

শওকত হোসেন মনে করেন, "শুধুমাত্র যুদ্ধের কারণে এই সংকট শুরু হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। আমরা দেখেছি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে সংকট শুরু হয়েছে। মূল্যস্ফীতির একটা চাপ ছিল। তখন মোটামুটি ধরে নেয়া হয়েছিল আমরা করোনা থেকে অনেকখানি মুক্ত। এরপর চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে।"

নতুন সংকটের শঙ্কা

শওকত হোসেন মনে করছেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের বিপদ আরও বাড়বে।

তার মতে, "সবকিছু নির্ভর করছে যুদ্ধটা কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে তার ওপর। যুদ্ধ না থামলে মূল্যস্ফীতির বিপদ আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে সামনে দাম আরও বাড়বে। ওদিকে মানুষের আয় বাড়ছে না। এটা একটা বড় সমস্যা।"

পাশাপাশি আরেকটা সংকটের কথা ভাবছেন তিনি, "সারা বিশ্ব যদি গভীর মন্দার দিকে যায়, তখন অনেক পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। এর লক্ষণ একটু একটু দেখা যাচ্ছে। চাহিদা কমে গেলে আমাদের রপ্তানিতে বড় একটা ধাক্কা আসবে। তখন আয়ের ক্ষেত্রে বড় বিপদে পড়বো আমরা।"

অর্থনীতি বাঁচাতে সাশ্রয় নীতি

সরকার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এরই মধ্যে সব সেক্টরের কর্মকর্তাদের সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের খবর সামনে আসছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও খনিজসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ম. তামিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "উচ্চমূল্যে জ্বালানি কিনে ডলার সংকট ঘনীভূত হলে, সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। এই বিপদ এড়াতেই আমরা জ্বালানিতে আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি।"

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করা এই বিশেষজ্ঞ বলেন, "বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে গরীব দেশ। আমাদের টাকা-পয়সার যে সংস্থান, তাতে অন্যান্য যে আমদানি আছে সেটার প্রেক্ষিতে জ্বালানি বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখন সাশ্রয় করা হচ্ছে।"

বিদ্যুৎ সংকট হ্রাসের আশা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "বিদ্যুতের সংকট আগামী চার মাসে কিছুটা কমতে পারে। কারণ তখন আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবে। আরও কয়েক মাস পর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কিছু বিদ্যুৎ চলে আসবে। সরকার বলছে ডিসেম্বরের মধ্যে রামপাল আসবে, তারপর পায়রার ট্রান্সমিশনের জন্য যে অর্ধেক বিদ্যুৎ আমরা আনতে পারছি না, সেটাও চলে আসবে। তবে আমি মনে করি ডিসেম্বরের মধ্যে হবে না। এগুলো পেতে পেতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে যেতে পারে।"

সংকট মোকাবিলায় বদরুল ইমামের পরামর্শ এমন, "যে কারণে সংকট দেখা দিয়েছে, এখন তার উল্টো কাজ করতে হবে। স্বল্প অথবা দীর্ঘ মেয়াদে গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারলে সংকট অনেকটা কেটে আসবে। মূল সমস্যা জ্বালানি। জ্বালানি কিনতে গিয়ে অন্য অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।"

XS
SM
MD
LG