অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যায় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিশু


প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

দিনের আলো তীব্রতা সঞ্চয় করে নিদাঘ দুপুরে গড়াতে গড়াতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রতিদিন ‘প্রায় ৪০ শিশুর’ মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এর মধ্যে অধিকাংশেরই প্রাণ যায় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে; অভিভাবকের ব্যস্ততায় কিংবা অসচেতনতায়। ২০১৬ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে এই তথ্য উঠে আসে। এর পর বাংলাদেশ পানিতে ডুবে শিশু-মৃত্যু প্রতিরোধের কৌশল উদ্ভাবন করে। বিশ্বদরবারে সুনামও অর্জন করে। সেই দেশে গত ছয় বছরে এ বিষয়ে আর কোনো তথ্যই সংগ্রহ করা হয়নি।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান ভয়েস অব আমেরিকাকে জানিয়েছেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ২০১৬ সালের ওই আলোচিত জরিপের পর, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে তারা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি একনেকে বড় একটি প্রকল্পও পাস হয়েছে।” সাম্প্রতিক কোনো পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে, আমিনুর রহমান বলেন, ‘‘গবেষণা আরও করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের গবেষণা করা কঠিন। সরকারের সহযোগিতা পেলে আগামী বছর আরেকটা গবেষণা করব।’’

আমিনুর রহমান।
আমিনুর রহমান।

আমিনুর রহমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার। ৫ বছরের কম বয়সের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অর্থাৎ, পানিতে ডুবে মারা যাওয়াদের প্রায় অর্ধেকের বয়সই ৫ বছরের কম।

সংখ্যাগুলো দিনের হিসাবে বিবেচনা করলে, ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৩০টি শিশু প্রতিদিন মারা যায়। ১৮ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ জন; আর সব বয়সী চিন্তা করলে প্রতিদিন মারা যায় প্রায় ৫০ জন। ‘‘এই মৃত্যু কমানোর জন্য আমরা কিছু কৌশল বের করেছি,’’ জানিয়ে আমিনুর রহমান বলেন, ‘‘৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখতে হবে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। এই বয়সী যে শিশুরা মারা যায়, তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ এই সময়টাতেই পানিতে ডোবে।’’

আমিনুর রহমান আরো বলেন, ‘‘এই চার ঘণ্টা প্রাপ্তবয়স্কদের কেউ যদি শিশুদের দেখে শুনে রাখে, তাহলে শিশুর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার শঙ্কা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে যায়।’’

জীবনের জন্য সাঁতার

৬-১০ বছরের বাচ্চাদের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাঁতার শিখিয়ে সিআইপিআরবি দেখেছে, মৃত্যুহার অনেক কমে যাচ্ছে। শিশুরা যেন কমপক্ষে ২৫ মিটার সাঁতার কাটতে পারে এবং গভীর পানিতে প্রায় ৩০ সেকেন্ড ভেসে থাকতে পারে-সুইমসেফ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়। কর্মসূচিটিকে তারা বলছেন ‘জীবনের জন্য সাঁতার’।

আমিনুর রহমানের ভাষায়, ‘‘অন্যকে উদ্ধারের জন্যও কিছু কৌশল আছে। সেগুলোও বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে। সে পানিতে নামবে না। কোনো কিছু দিয়ে, যেমন লাঠি অথবা দড়ি ছুঁড়ে অথবা ভাসমান কোনো বস্তু ছুঁড়ে দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করা। অর্থাৎ বাচ্চাদের পানিতে নামতে নিষেধ করা হচ্ছে। প্রাথমিক চেষ্টার পর সে বড়দের সহযোগিতা চাইবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘সুইমসেফ প্রোগ্রামের আওতায় আমরা এই ইন্টারভেনশনগুলো দিয়েছি। দেখা গেছে, ৬ থেকে ১০ বছরের যে সব বাচ্চা সুইমসেফ প্রক্রিয়ায় সাঁতার শেখে, তাদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর শঙ্কা প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যায়। অর্থাৎ একটা বাচ্চা ৯০ শতাংশ সুরক্ষিত।’’

‘‘আমরা যেমন কোভিড ভ্যাকসিন দিচ্ছি, তাতে যেভাবে ৫০/৬০ শতাংশ প্রটেকশন আসছে, তেমনি যদি একটা বাচ্চা সাঁতার জানে তাহলে সে ৯০ শতাংশ প্রটেকটিভ হয়;” জানালেন আমিনুর রহমান

সিআইপিআরবি’র সলিড নামের আরেকটি প্রোগ্রাম ছিল। সেভিং অব লাইভস ফ্রম ড্রাউনিং। তাতে দেখা গেছে বাচ্চাদের ডেকেয়ারে রাখতে পারলে সব মিলিয়ে মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ কমে যায়। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের যদি সপ্তাহে ৬দিন ডেকেয়ারে ৪ ঘণ্টা করে রাখা যায়, তাহলে মোট মৃত্যু সংখ্যার ৮০ শতাংশই কমে।

এর পরেও শিশুরা পানিতে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ যদি তাকে উদ্ধার করা যায় এবং মুখ থেকে মুখে শ্বাস দেয়া যায়, বুকে চাপ দেয়া যায়, তাহলে তার জীবন রক্ষা করা সম্ভব। আমিনুর রহমান বলেন, “এটা করতে হবে ঘটনাস্থলেই। আমরা যদি মনে করি, এটা কোনো ডাক্তার করবেন, সে জন্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা সময় লাগবে…তাহলে জীবন বাঁচানো যায় না। সেজন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের এটা শেখানো দরকার।’’

২০০৫ সাল থেকে এ বিষয়ে কাজ করছে সিআইপিআরবি। এ সময়ের মধ্যে, দশ বছর বয়সী থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক দুই হাজার চার শ; মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সংগঠসটি। ১২টি গ্রামে দুইশ’ জন করে মানুষকে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তখন দেখা গেছে, জরুরি পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এই ব্যবস্থাগুলোকে বাংলাদেশের ইনোভেশন বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে প্রয়োগও করতে বলেছে বিশ্ব স্বস্থ্য সংস্থা।

আঁচলের মমতায় শিশুদের রক্ষা

শিশুমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রে সিআইপিআরবি রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আঁচল নামের ডেকেয়ার সেন্টার চালু করে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে তারা। আমিনুর রহমান বলেন, “ইতোমধ্যেই প্রায় সাত লাখ বাচ্চাকে সাঁতার শিখিয়েছি আমরা। কভিডের আগ পর্যন্ত কাজ হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রায় তিন হাজার শিশু আঁচল নামের ডেকেয়ার সেন্টার আছে। প্রতিটিতে ২০ থেকে ২৫ জন শিশু থাকে। সেই হিসাবে প্রায় ৬০-৬৫ হাজার বাচ্চাকে আমরা দেখাশোনা করছি। তারা আঁচলে থাকে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। এছাড়া ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আমরা ফাস্ট রেসপন্স ট্রেইনিং দিয়েছি। এগুলো সবই গবেষণার অংশ।’’

সরকারের পদক্ষেপ

বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দুই মাস আগে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। এর মাধ্যমে ১৬টি উপজেলায় প্রায় ২ লাখ বাচ্চাকে ডেকেয়ার সেন্টারের আওতায় আনা হবে। তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে নতুন করে সাঁতার শেখানো হবে। এতে যে খরচ হবে, তার ৮০ শতাংশই বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। বাকি ২০ শতাংশ আসবে দুটি দাতা সংস্থা থেকে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিভিন্ন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে শিশু একাডেমি। সিআইপিআরবি কারিগরি সহায়তা দেবে।

আপাতত নির্দিষ্ট কয়েকটি উপজেলায় কাজ শুরু হলেও, সরকারের আশা, ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে সারা দেশ এই কর্মসূচির আওতায় আসবে।

যত্ন-সচেতনতার বিকল্প নেই

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর বিষয়টিকে এখন অনেকেই অভিভাবকের ‘অবহেলাজনিত অপরাধ’ বলে উল্লেখ করছেন। গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় পরামর্শ সভার আয়োজন করে, এমন বার্তাই দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি, সিআইপিআরবির মতো ব্যাপক পরিধির জরিপ না চালালেও, তাদের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ মাসে, সারা বাংলাদেশে ৪৬৭টি ঘটনায় ৮৩৩ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদের মধ্যে ৬৮৬ জনই (৮২.৩৫ শতাংশ) শিশু। মৃতদের মধ্যে ২৮১ জন কন্যাশিশু।

সমষ্টি’র পরিচালক ও চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক মীর মাসরুর জামান মনে করেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধের ব্যাপারটি সামগ্রিক যত্নের বিষয়। তিনি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “ বিষয়টি পারিবারিক, কমিউনিটি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যত্ন নিয়ে দেখতে হবে।’’

মীর মাসরুর জামান।
মীর মাসরুর জামান।

এই ‘যত্নে’র ব্যাখ্যাও দেন তিনি। বলেন, ‘‘শিশুরা দিনের অনেকটা সময় কারো দেখাশোনার বাইরে থাকে। বাবা-মা যখন কাজে থাকে, ওই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা গ্রাম পর্যায়েও আছে, নগর পর্যায়েও আছে। এসময় সে একা থাকে অথবা আশপাশের ছোট কিংবা বড় ভাইবোনেরা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে। সেও শিশু। তখন তার চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেকোনো সময় পানিতে পড়তে পারে। এমনকি বালতির পানিতে পড়েও মারা যেতে পারে। এই সময়ে তার জন্য স্থায়ীভাবে দেখাশোন বা যত্ন নেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। একই সঙ্গে, আশপাশের জলাধারগুলোয় বেড়া দিয়ে রাখতে হবে। চাইলেও যেন সে চট করে পানিতে যেতে না পারে।’’

মীর মাসরুর জামান জানান, ‘‘সাঁতারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।” বলেন, “প্রথমে আমি সাঁতারের কথা বলিনি, কারণ এটা শেখার একটা বয়স আছে। ৫/৬ বছরের আগে সাঁতার শেখা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় ৪ বছরের মধ্যেই অনেক শিশু মারা যায়। সাঁতার শেখার বিষয়টি কমিউনিটি থেকে স্কুল পর্যায় পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগী হতে হবে। এখানে স্থানীয় সরকারের বড় ভূমিকা রয়েছে।’’

এনএডিপির ৫ বছরের ক্যাম্পেইন

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে গত ২৯ মার্চ ৫ বছরের একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন-এনএডিপি। বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে গঠিত এই জোট-সংগঠনের আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার ভয়েস আমেরিকাকে বলেছেন, “একদম তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে সচেতন করতে আমরা ক্যাম্পেইনটি শুরু করেছি। এ জন্য আমরা ৬৪টি জেলার স্থানীয় সংস্থা এবং ৬২টি জেলা থেকে প্রকাশিত স্থানীয় পত্রিকাকে সহযোগী করে ক্যাম্পেইন করছি। মানুষকে সচেতন করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’’

সদরুল হাসান মজুমদার।
সদরুল হাসান মজুমদার।

সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, ‘‘পুকুরটাকে বেড়া দিয়ে না রাখা শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ-গ্রামের মানুষেরা এটা বুঝতে পারলে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আমরা ব্যাপকভাবে মানুষকে সচেতন করতে চাই। শহরের মানুষকেও বুঝতে হবে বাথরুমের বালতি ভর্তি পানি ঢেকে রাখতে হবে। না রাখাটা যে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, এই তথ্যটা মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছে দেয়াই আমাদের ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য।’’

XS
SM
MD
LG