বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীরা শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে তুলনামূলকভাবে ‘আগের চেয়ে বেশি ’ মুখ খুললেও মানসিক নির্যাতন নিয়ে তেমন অভিযোগই করেন না। মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, অনেকে এখনো জানেনই না আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাকে পারিবারিক সহিংসতা বলা হয়।
পারিবারিক সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতে নারীরা অধিকাংশ সময় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করেন। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা বিভাগটি সে বছর এ সংক্রান্ত মাত্র সাতটি কল পেয়েছিল। তবে, সেবা বিভাগটির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তবারক উল্লাহ ভয়েস অব আমেরিকাকে জানিয়েছেন, ২০২১ সালে তারা ৯৮৩১টি কল পেয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
নারীরা তাৎক্ষণিকভাবে এই বিভাগের সহায়তায় শারীরিক নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচলেও তাদের আইনি কিংবা অন্য কোনো সহায়তার জন্য নিজেদেরই লড়াই করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু মানবাধিকার সংগঠন পাশে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এমনই একটি সংগঠন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় তাদের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েক জন নারী সহায়তার জন্য এসেছেন। হিন্দু, মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের নারীরা আছেন তাদের মধ্যে। এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভয়েস অব আমেরিকাকে জানান, স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। উপায় না পেয়ে মহিলা পরিষদে এসেছেন। স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চান।
স্বামীর নির্যাতনের নির্মম বর্ণনা দিতে দিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কথা বললেও এ বিষয়ে অভিযোগ করা যায় কি না, সে বিষয়ে তার ধারণা নেই বলে জানালেন।
মহিলা পরিষদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নারীরা অনেক সময় ফোনে তাদের কাছে অভিযোগ করেন। তখন আসতে বলা হয়। সব শুনে তারপর নেয়া হয় আইনি পদক্ষেপ। কেউ আসতে না পারলে জেলা পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়।
শহুরে বনাম গ্রামের নারীর পরিস্থিতি
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা প্রায় এক যুগ ধরে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি জানিয়েছেন, মানসিক ক্ষতির অভিযোগে কেউ মামলা করেছেন ক্যারিয়ারে এমন কখনো শোনেননি আর নিজেও লড়েননি। তবে অসংখ্য লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন, যার অধিকাংশ শহুরে নারী। তবে মামলার ক্ষেত্রে গ্রামের নারীরা এগিয়ে।
তিনি বলেন, ‘‘এটা আসলে খুবই দুঃখজনক বিষয়। মানসিক ক্ষতিকে অ্যাড্রেস করে আমার জানামতে কোনো মামলার কথা শুনিনি। আমিও পাইনি। ’’
‘‘আমি এক যুগ ধরে এ বিষয়ে কাজ করছি। সর্বশেষ পাঁচ বছরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মানসিক ক্ষতিকে অ্যাড্রেস করে মামলা না হলেও অসংখ্য লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি। এমন ঘটনা আছে স্বামী গালিগালাজ করে, কথায় কথায় ঝগড়া করে-এমন অভিযোগে একই বাড়িতে থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।’’
‘‘গত পাঁচ বছরে আমি যে লিগ্যাল নোটিশগুলো পাঠিয়েছি তার বেশিরভগাই শহরকেন্দ্রিক নারী। কিন্তু আইনি সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে শহুরে নারীদের চেয়ে গ্রামীণ নারীরা অনেকটাই এগিয়ে আছেন। শহরের নারীরা অনেক ক্ষেত্রে খুব চিন্তা করেন। একবার মামলা হয়ে গেলে লোকে কী বলবে, এই সামাজিক ট্যাবুটা শহুরে নারীদের মধ্যে বেশি।’’
‘‘কিছুদিন আগে আমার কাছে শহরের এক নারী আসেন। তার মুখে আঘাতের চিহ্ন। স্বামী মেরেছে। অনেক দিন ধরেই এমন চলছে। আমি বললাম আপনাকে এভাবে আঘাত করেছে, মামলা করবেন কি না। ওনারা আগ্রহী না। কিন্তু যখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারীরা আমাদের কাছে আসেন, তখন দেখি আইনি সহায়তা নেয়ার প্রবণতা বেশি। তারা বলেন, যেভাবেই হোক টাকা-পয়সা জোগাড় করব। কিন্তু এটার বিচার চাই।’’
মিতি সানজানা বলেন, ‘‘একটা সময় মানুষের ধারণা ছিল শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি শুধুমাত্র পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশের প্রচলিত যে আইন এবং জাতিসংঘের যে সনদ রয়েছে তাতে চারটি বিষয়কে পারিবারিক সহিংসতা বলা হয়: শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন নির্যাতন।’’
‘‘একটা সময় আমাদের কাছে যারা আসতেন, তারা মারধরের কথা বলতেন। অনেক ক্ষেত্রে তাকে হয়তো প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, আটকে রাখা হয়েছে, টাকা পয়সা নিয়ে নেয়া হচ্ছে-এগুলোও যে সহিংসতার মধ্যে আছে, সেটা কিন্তু তারা জানত না।’’
এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা প্রচুর লেখালেখি করছি। সব প্ল্যাটফর্মেই বিষয়টিকে অ্যাড্রেস করছি। সবাইকে বলার চেষ্টা করছি।‘
‘‘এই লড়াইয়ের ফল আমরা আস্তে আস্তে পাচ্ছি। মানসিক নির্যাতন যে আইনের ভেতর পড়ে এটা অনেকেই এখন বোঝেন।’’
নারীরাই মূলত নির্যাতনের শিকার
এখনকার দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই পুরুষ নির্যাতনের প্রসঙ্গ সামনে আনেন। কিছুক্ষেত্রে এমন উদাহরণ থাকলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং বাংলা একাডেমির ফেলো অধ্যাপক মোহিত কামাল বলছেন সহিংসতার ভুক্তভোগী নারীরাই বেশি।
ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, ‘‘অনেকগুলো কারণ আছে। অনেক ব্যাখ্যা আছে। দুটোকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। একটা হচ্ছে ফ্রাসট্রেশন থেকে অ্যাগ্রেশন। যে ঘরে পুরুষের মনে হতাশা তৈরি হয়, সেটি অর্থনৈতিক, চাকরি, সম্পর্কের অবনতি নানা কারণে হতে পারে। করোনার কারণে অনেকের হতাশা বেড়ে গিয়েছিল। আরেকটা কারণ হল মাদক। যেসব ঘরে স্বামীরা অ্যালকোহল গ্রহণ করে, তাদের ভেতরও অ্যাগ্রেশন রিলিজ হয়। এই অ্যাগ্রেশনে রাতের বেলা স্ত্রীকে মারে, সকালবেলায় পায়ে ধরে মাপ চায়। সেক্ষেত্রে অনেক নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। এর পাশাপাশি এখনকার সমাজে পরকীয়া একটা বড় কারণ।’’
জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তবারক উল্লাহও বললেন পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে নারীরা বেশি ফোন করেন, ‘‘অনেক সময় পরিবারের লোকেরাও ফোন করে। প্রতিবেশীরাও আমাদের জানায়। নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে। পারিবারিক ফ্যাক্টর আছে, ব্যক্তিগত ফ্যাক্টর আছে, সামাজিক ফ্যাক্টর আছে। রাষ্ট্রীয় পলিসিগত ফ্যাক্টর আছে। এটা কমানো চাট্টিখানি কথা না। ডমেস্টিক ভায়োলেন্স অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো প্রতিরোধের জন্য সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করাটাই হচ্ছে জরুরি। দেশে আইনের অভাব নেই। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সকল ঘটনা আসে না। এর থেকে প্রতিকার পেতে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।’’