অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

অভিষেক অনুষ্ঠানটিকে আমেরিকান গণতন্ত্রের এক শক্তিশালী প্রতীক বলা যেতে পারে


প্রতি চার বছর আমেরিকানরা উৎসাহের সাথে একটি দিন উদযাপন করে যাকে আমেরিকার গণতন্ত্রের বিশেষ একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, এই দিনটিতে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ নেন। এই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে প্রত্যক্ষ করার জন্য অভিষেক দিবসের আয়োজন করা হয়। ২০২১ সালের ২০শে জানুয়ারী সবার নজর ছিল সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি, যিনি ওই দিন আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন।

আমেরিকান স্বশাসনের আদর্শকে নিশ্চিত করতে অভিষেক দিবসে ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এইদিন যথাযথ সম্মতি প্রাপ্তির পর এবং শাসন ক্ষমতা অর্জনের পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নতুন নেতা শপথ নিয়ে থাকেন।নতুন প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদ শুরু করেন একটি ভাষণ দিয়ে যা পরবর্তী চার বছরের জন্য তার ধারণাগুলির এক রূপরেখার নির্দেশ করে দেয়।

White House Historical Association অথবা হোয়াইট হাউস ইতিহাস সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কলেন শোগান বলেন, "এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিষিক্ত প্রেসিডেন্টের জন্য একটি আসল সুযোগ। প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট জাতির কাছে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করেন এরকম সুযোগ তাঁর আর কখনই আসবে না। তাই এটি আমেরিকার প্রশাসনিক ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বলা যায়"।

এই অভিষেক ভাষণ এতটাই গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয় এবং এর কিছু কিছু অংশ এমনভাবে মনে দাগ কেটে যায় যে এগুলি আমেরিকান শব্দকোষের অংশ হয়ে যায়। যেমন ১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট উক্তি করেছিলেন যে, "আমাদের ভয় পাওয়াটাকেই কেবল ভয় করতে হবে" এবং ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডি আমেরিকানদের বলেছিলেন "আপনার দেশ আপনার জন্য কি করতে পারে তা জিজ্ঞাসা করবেন না-আপনি আপনার দেশের জন্য কি করতে পারেন সেটাই জিজ্ঞাসা করুন"।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ ম্যাট ডাল্লেক বলেছন, এই অভিষেক ভাষণটি নতুন প্রেসিডেন্টের ধারণা, মতাদর্শ এবং চিন্তাধারাকে পরিস্ফুটিত করে এবং আগামী চার বছরের কাজকর্মের একটা ধারাকে ব্যক্ত করে।

কিছু অভিষেক বক্তৃতা রাজনীতির আঙ্গিনায় একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলে। যেমন রোনাল্ড রেগান নাটকীয় ঘোষণা করেছিলেন যে, “ভবিষ্যতে আমাদের সমস্যার সমাধান নয়, সরকার নিজেই সমস্যা”। এই ঘোষণার চল্লিশ বছর পরেও রিপাবলিকানরা সরকার বিরোধী বাগাড়ম্বর মেনে নিচ্ছে।

ফেডারেল সরকারের পরিধিকে সংকুচিত করার জন্য রেগনের আহ্বান হোক বা আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ২০০৯ এর অভিষেক ভাষণই হোক, কখনও কখনও এই অভিষেক ভাষণ সেই সময়ের গণ্ডী অতিক্রম করে দেশ ও জাতিকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়।"এই সব মুহূর্ত জাতির স্মৃতিতে বেঁচে থাকে, কেননা তারা তারা দেশ এবং যে যুগ তারা অতিক্রম করছে সে সম্পর্কে মৌলিক কিছু বলতে চায়।"

ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর কামালা হ্যারিস প্রথম মহিলা হিসেবে এবং কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এইদিন শপথ গ্রহণ করেছেন
ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর কামালা হ্যারিস প্রথম মহিলা হিসেবে এবং কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এইদিন শপথ গ্রহণ করেছেন

সেই অর্থে ২০২১ সালের এই অভিষেক অনুষ্ঠানও ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করল, কেননা ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর কামালা হ্যারিস প্রথম মহিলা হিসেবে এবং কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এইদিন শপথ গ্রহণ করেছেন।

মৃত্যুশয্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন
মৃত্যুশয্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন

আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অভিষেক ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালের তার দেওয়া প্রদেয় অভিষেক ভাষণটি মাত্র ১৩৫ টি শব্দ দিয়ে সম্বলিত ছিল।১৮৪১ সালে উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের ভাষণটিতে ছিল ৮৪৫৫ শব্দ দিয়ে এবং সবথেকে দীর্ঘতম ভাষণ ছিল। এটির করুণ পরিণতি হয়েছিল। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হ্যারিসন সেইসময়কার সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি যথেষ্ট উজ্জীবিত ছিলেন এবং নিজে এই বয়সেও কাজ করতে যথেষ্ট সক্ষম সেটা প্রমাণ করার জন্য ৬৮ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট এক ঘণ্টা ধরে এই দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেদিনের তাপমাত্রা খুব শীতল ছিল এবং সেদিন সন্ধ্যায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক মাস পরে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পতম সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

অভিষেক দিবসের অনুষ্ঠানের একটি বড় দিক হচ্ছে ‘এর প্রতীকী পরিবেশনা।

অভিষেক অনুষ্ঠানের কুচকাওয়াজগুলির প্রদর্শনীতে ট্যাঙ্ক, সৈনিক এবং ক্ষেপনাস্ত্র
অভিষেক অনুষ্ঠানের কুচকাওয়াজগুলির প্রদর্শনীতে ট্যাঙ্ক, সৈনিক এবং ক্ষেপনাস্ত্র

১৮০৯ সালে, যখন নবীন প্রজাতন্ত্র তার জাতীয় সত্ত্বা কে সারা বিশ্বে পরিচিত করাতে সচেষ্ট ছিল, জেমস ম্যাডিসন নিশ্চিত করেছিলেন যে, তাঁর পরিহিত পোশাকটি্র পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমনকি পায়ের রেশমের মোজাটি পর্যন্ত যেন ‘মেড ইন আমেরিকা’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হোক। ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার ১৯৫৩ এবং ১৯৫৭ সালের অভিষেক অনুষ্ঠানের কুচকাওয়াজগুলির প্রদর্শনীতে ট্যাঙ্ক, সৈনিক এবং ক্ষেপনাস্ত্র রেখে আমেরিকার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

White House Historical Association অথবা হোয়াইট হাউস ইতিহাস সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কলেন শোগান আরও বলেন, "১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিংকন যখন দ্বিতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হবার শপথ নিয়েছিলেন, তখন তিনি প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের অভিষেকের কুচকাওয়াজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে উড্রো উইলসনের অভিষেক অনুষ্ঠানে মহিলারা প্রথমবারের মতো কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করেছিলেন।"

সময়ের সাথে সাথে এই অভিষেক অনুষ্ঠানগুলি ক্রমশ: খুব বর্ণময় হয়ে উঠছে।

১৮০১ সালে, টমাস জেফারসন হেটে গিয়েছিলেন ক্যাপিটল হিলের ভবনে, শপথ গ্রহণ করেছিলেন, এবং অভিষেক ভাষণটি দিয়ে, হেটে তাঁর বোর্ডিং হাউসে ফিরে গিয়েছিলেন। আর আজ, শপথ গ্রহণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এক জটিল ও বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, প্রেসিডেন্ট লিমোজিনে করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, যা লক্ষ লক্ষ মানুষ টেলিভিশনের মাধ্যমে বা সরাসরি প্রত্যক্ষ করে থাকে। অনুষ্ঠানের শেষে একটি কুচকাওয়াজ হয়, যা সমস্ত ৫০টি রাজ্য উদযাপন করে এবং কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।

টেলিভিশনের প্রযুক্তি এই অনুষ্ঠানটি আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে, যদিও প্রেসিডেন্টের কাজের পরিধি ও গুরুত্ব সময়ের সাথে সাথে অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ ম্যাট ডাল্লেক বলেছেন, "দুই শতাব্দী ধরে এবং বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রেসিডেন্টের কাজের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন ঐতিহাসিক যেমন বলেছেন, জনগণের এই অবিশ্বাস্য প্রত্যাশা বৃদ্ধির ফলে, প্রেসিডেন্টের কাজ ও দায়িত্ব এক অসম্ভব পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। আর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় আমরা এটাই দেখছি যে এই অভিষেক অনুষ্ঠানগুলো কুচকাওয়াজে আড়ম্বরে যেন জীবনকেও অতিক্রম করে গেছে ।

যদিও কভিড মহামারীটি ফলে এ বছর অভিষেক অনুষ্ঠানের অনেক কার্যক্রম একটু ভিন্নভাবে করা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোভিড-১৯, জাতিকে আমেরিকান গণতন্ত্রের স্থায়ী এই অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদদাতা ডোরা মেকোয়ারের এই প্রতিবেদনটির বাংলা রূপান্তর করেছেন জয়তী দাশগুপ্ত।

XS
SM
MD
LG