প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রাক্বালে প্রস্তুতি হিসেবে ওয়াশিংটনে গড়ে তোলা হচ্ছে ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কালো রঙের উঁচু অস্থায়ী বেষ্টনী, মোতায়েন করা হচ্ছে ২৫ হাজার আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং লক্ষ লক্ষ দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে নিরাপত্তা চেকপয়েন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনের সিঁড়িতে সোমবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এবং সেখান থেকে শোভাযাত্রা দিয়ে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যাত্রা করবেন। এর আগে এই সপ্তাহান্তে ট্রাম্প বিরোধীদের বিক্ষোভ এবং রিপাবলিকান সমর্থকদের সমাবেশে হবে।
ট্রাম্পের উপরে দুইবার প্রাণনাশের চেষ্টা চালানো এবং নববর্ষের দিন সাধারণ আমেরিকানদের ওপর জোড়া হামলা চালানোর পরই এই অভিষেক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ট্রাম্পের ওপরে একটি হামলায় একটি গুলি তাঁর কান ছুঁয়ে যায়।
নিউ অরলিন্সে নববর্ষ উদযাপনকারীদের ভীড়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর এক সাবেক সদস্য একটি ট্রাক নিয়ে মানুষের উপরে চালিয়ে দিলে ১৪ জন নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়। ঐ একই দিনে লাস ভেগাসে ট্রাম্প ব্র্যান্ডের একটি হোটেলের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর এক সেনা টেসলা সাইবারট্রাকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট সার্ভিসের স্পেশাল এজেন্ট ইন চার্জ ম্যাট ম্যাককুল বলেন, “আমরা প্রচণ্ড হুমকির পরিবেশে রয়েছি।”
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবেন তখন কংগ্রেসের সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট, তার নতুন প্রশাসন এবং আরও হাজার হাজার মানুষ তা প্রত্যক্ষ করবেন। এই অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ক্যাপিটল হিলের সিঁড়িতে যেখান থেকে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট সরাসরি দেখা যায়।
আর এটা হচ্ছে সেই স্থান যেখানে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটাল ভবনের জানালা ভাঙ্গে, পুলিশের সাথে লড়াই করে এবং আইন প্রণেতাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল । তারা ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিজয়ের ফলাফল পাল্টানোর চেষ্টাতেই তারা ঐ দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেছিল
ডেমোক্র্যাটিক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে তার পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন তবে ট্রাম্প এখনও মিথ্যা ভাবে দাবি করে চলেছেন যে ২০২০ নির্বাচনের ফলাফল জালিয়াতি হওয়ার কারণে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন।
একক আততায়ীর হুমকি
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানকে ঘিরে কোনো সুনির্দিষ্ট বা সমন্বিত হুমকি আছে কিনা সে সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। তবে তারা যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তা হচ্ছে কোনও আততায়ীর এককভাবে হামলা চালানোর আশঙ্কা। যেমনটি ঘটেছিল একটি নিউ অরলিন্সের আক্রমণ অথবা গত সপ্তাহে দুটি পৃথক ঘটনায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল পুলিশের তথ্য অনুসারে, একটি ঘটনায় এক ব্যক্তি ক্যাপিটল ভবনে একটি ছোঁড়া নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলে তাকে আটক করা হয়। পৃথক আরেকটি ঘটনায় এক ব্যক্তি ক্যাপিটল ভবনের কাছে আগুন জালানোর চেষ্টা করেছিল, তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল পুলিশ প্রধান থমাস মাঙ্গার নিরাপত্তা বিষয়ক এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “এরকম একক আততায়ীর হামলার হুমকিই হচ্ছে আগামী সপ্তাহ জুড়ে আমাদের সবচেয়ে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার সবচেয়ে বড় যৌক্তিক কারণ।
এফবিআই এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ সোমবার নিউ অরলিন্সের ঘটনার আদলে হামলার ঝুঁকির বিষয়ে দেশব্যাপী পুলিশ বিভাগকে সতর্ক করেছে।
হোয়াইট হাউস থেকে ক্যাপিটল ভবন পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মূলত ওয়াশিংটন
শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি বড় অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। ঐ স্থানগুলিতে প্রবেশ করার পথগুলো সিমেন্টের তৈরি প্রতিবন্ধক, আবর্জনার ট্রাক এবং অন্যান্য ভারী জিনিষ দিয়ে বন্ধ করা হবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২ মিটার উচ্চতার কালো বেষ্টনী দেয়া হয়েছে এবং ঐ বেষ্টনী এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ওয়াশিংটনে এটাই হবে সর্বকালের দীর্ঘ বেষ্টনী। নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ন্যাশনাল গার্ডের ৭ হাজার ৮০০ সেনা এবং দেশের অন্যান্য পুলিশ বিভাগ থেকে আনা চার হাজার কর্মকর্তা মোতায়েন করা হবে।
এই শহরের ৯০ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পের পরিবর্তে হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন। এই বাসিন্দাদের কিছু যখন সপ্তাহান্তের ছুটিতে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বা ভিড় এড়াতে বাড়িতেই সময় কাটাবেন, তখন ধারণা করা হচ্ছে যে হাজার হাজার মানুষ হয় অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য নতুবা বিক্ষোভ করার জন্য এই শহরটিতে এসে হাজির হবে।
স্মিথ ট্রাভেল রিসার্চের তথ্য এবং ওয়াশিংটনের সরকারি পর্যটন সংস্থা ডেসটিনেশন ডিসি রয়টার্সের সঙ্গে শেয়ার করা তথ্য অনুযায়ী, অভিষেক অনুষ্ঠানের রাতে এবং এর আগের রাতের জন্য ওয়াশিংটনের হোটেলের ৩৪ হাজার ৫০০টি কক্ষের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ বুকিং গত সপ্তাহর মধ্যেই দেয়া হয়ে গেছে।
ট্রাম্পের ২০১৭ সালের অভিষেকের সময় হোটেল রুমের লোক ভর্তি ছিল প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিতীয় অভিষেকের সময় ছিল প্রায় ৭৮ শতাংশ।
মিছিল ও সমাবেশ
ট্রাম্পের ২০১৭ সালের অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় ব্যাপক বিক্ষোভ ও পাল্টা বিক্ষোভ হয়েছিল।
তার সাবেক মুখপাত্র শন স্পাইসার দায়িত্ব নেয়ার শুরুতে বিখ্যাত ভাষণে দাবি করেছেন যে, ন্যাশনাল মল এলাকা জুড়ে মানুষের ভীড় ছিল “যেকোনো অভিষেক অনুষ্ঠান দেখতে আসা সবচাইতে বড় সংখ্যক দর্শক - ফুল স্টপ!"
তবে ধারণ করা সব চিত্রের সঙ্গে তার এই দাবী সামাঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
অভিষেক অনুষ্ঠানের ঠিক পরের দিন উইমেনস মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন ওয়াশিংটনের রাস্তায় নেমে এসেছিল হাজার হাজার লোক - এবং সারা দেশে ঐ মার্চের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে অনেক অনুষ্ঠান হয়েছিল।
মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান পামেলা স্মিথ সোমবার জানিয়েছেন, শনিবার ডিসিতে ট্রাম্প-বিরোধী পিপলস মার্চে ২৫ হাজার অংশ নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা আগের মার্চের তুলনায় অনেক ছোট।
স্থানীয় কর্মকর্তারা রবিবার ২০ হাজার আসনের ক্যাপিটাল ওয়ান অ্যারেনায় ট্রাম্পের সমাবেশসহ শনি ও সোমবারের মধ্যে প্রায় ডজন খানেক বিক্ষোভ বা সমাবেশের অনুমতি দিয়েছেন যেখানে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ওবামা প্রশাসনের সময় হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাবেক কর্মকর্তা হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক জুলিয়েট কায়েম বলেন, কর্মকর্তারা সব ধরণের সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অনুশীলন অনুসরণ করা হচ্ছে।
“আপনি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির কথা ভেবে পরিকল্পনা করছেন, তবে আমার সন্দেহ যে এমনটি ঘটবে না, যা ভাল” কায়েম বলেন। “পরিকল্পনার ক্ষেত্রে, ধীরে ধীরে বাড়ানোর চেয়ে কমানো সব সময়ই বেশি সহজ ।