সিরিয়ার প্রকৃত নেতা আহমেদ আল-শারা – যার নেতৃত্বে ইসলামপন্থী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) যোদ্ধারা গত মাসে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষময়াচ্যুত করে – সম্প্রতি দেশের ক্রিস্টিয়ান নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এক রাশ আক্রমণের পর এই বৈঠক কিছু পর্যবেক্ষককে আশাবাদী করেছে যে জঙ্গিরা অন্তর্ভুক্তি এবং সহনশীলতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। তবে অন্যান্য পর্যবেক্ষক সন্দিহান রয়ে গেছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর হামার এক ক্রিস্টিয়ান-অধ্যুষিত শহরে ক্রিস্টমাস গাছ পোড়ানর ঘটনা এবং অন্যান্য হয়রানির প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশের জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নতুন ইসলামপন্থী কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ব্রিটেন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস-এর তথ্য অনুযায়ী, “উজবেক অস্ত্রধারীরা হামার ক্রিস্টিয়ান-অধ্যুষিত আল-সাকিলিবিয়া শহরের ক্রিস্টমাস গাছে আগুন লাগিয়ে দেয়।”
ক্যাথলিক, অর্থোডক্স এবং অ্যাংলিকান ধর্মযাজকদের সাথে আল-শারার বৈঠকের খবর এবং ছবি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিরিয়ান আরব নিউজ এজেন্সি পরিবেশন করে।
সিরিয়ার ক্যাথলিক আর্চবিশপ হোমসের জাক মুড়া, যিনি বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন, বলেন আল-শারা “সংখ্যালঘু” শব্দটি ব্যবহার করেননি। ফ্রান্স-ভিত্তিক ক্যাথলিক সাময়িকী লা ক্রোয়া ইন্টারন্যাশনাল এই তথ্য দিয়েছে।।
“তিনি বলেন যে, ক্রিস্টিয়ান এবং অন্যান্য গোষ্ঠী সিরিয়ান জনগণের অংশ,” আর্চবিশপ লা ক্রোয়াকে বলে। “ক্রিস্টিয়ানরা যে এই দেশের ভিত্তির সাথে সম্পৃক্ত, সে বিষয়ে তিনি অবগত।”
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট-এর গবেষক রাফিফ জুয়েজাতি জবাবদিহিতার দাবীতে জনসমাবেশ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
“সিরিয়ায় যেসব বিক্ষোভ হচ্ছে সেগুলো যদি আপনি দেখেন, আপনি সাথে সাথে দেখবেন জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করছে,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “এই জিনিস আমরা অর্ধ শতক ধরে করতে পারি নাই।”
তিনি বিশ্বাস করেন যে সিরিয়া সঠিক পথেই এগুচ্ছে। সিরিয়া একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তা তিনি নাকচ করে দেন।
কিন্তু অন্যরা এত নিশ্চিত নয়।
ইন ডিফেন্স অফ ক্রিস্টিয়ানস নামক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক রিচার্ড ঘাযাল ভিওএ-কে বলেন, “এইচটিএস এবং তাদের আগের সংগঠন, যাবহাত আল-নুসরা, নুসরা ফ্রন্ট, আল-কায়েদা, এমনকি ইসলামিক স্টেট-এর সাথে কোন পার্থক্য নেই।”
“তারা আইসিস এবং আল-কায়েদার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে,” তিনি বলেন। ইসলামিক স্টেট-এর ক্ষেত্রে তিনি তাদের আরেক নাম, আইসিস ব্যবহার করেছেন। “তারা সেটাকে ব্যবহার করে তাদের বার্তা, তাদের মিডিয়া যোগাযোগ আধুনিক করেছে, এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে বোকা বানাচ্ছে, এমনকি বিশ্বাসও করাচ্ছে।”
আল-শারা যদিও আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরের দিনই সহনশীলতার ভাষার উপর জোড় দিয়ে “সিরিয়া সবার জন্য” বলে ঘোষণা দেন, ঘাযাল বলছেন যে তারা কীভাবে দেশ চালাবেন তা এখনো দেখার বিষয়।
জুয়েজাতি ২০১৬ সালের দিকে ইঙ্গিত করেন, যখন এইচটিএস উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীদের থেকে নিজেদের সরিয়ে আনে।
“তারা নিজেদের ইসলামপন্থি গোষ্ঠীদের থেকে অনেক বেশি নমনীয় হিসেবে দেখাতে পেরেছে,” তিনি বলেন। “আমরা দেখছি, ইসলামি স্বৈরতন্ত্র থেকে ধীরে সড়ে আসার প্রক্রিয়া। তারা এখন সৈন্যের চেয়ে বেসামরিক লোক হিসেবেই সামনে আসছে।”
সিরিয় পরিচয়ের গুরুত্ব
ঘাযাল বলছেন, সকলের অন্তর্ভুক্তির জন্য এইচটিএস নেতৃত্বের আহ্বান সত্ত্বেও, অসহিষ্ণুতার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে অ্যালকহল পানীয়র উপর নিষেধাজ্ঞা, গণপরিবহনে পুরুষ এবং নারী আলাদা করে দেয়া, এবং দামেস্কের কিছু শহরতলীতে ইসলামিক স্টেট-এর পতাকার উপস্থিতি।
“এটা খুবই উদ্বেগজনক যে এটা আমরা ক্রিস্টিয়ান মহল্লায় দেখতে পাচ্ছি,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “এই লক্ষণগুলো আমাদের বলছে যে, এখন পর্যন্ত কোন ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতা দেখা না গেলেও, আমি শঙ্কিত যে সেটা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে।”
জুয়েজাতি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ঐক্য এবং সিরিয় পরিচয়ের গুরুত্বের উপর জোড় দেন।
“আমি বিশ্বাস করি, এই মুহুতে সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের নিজেদের ভয়,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “আমরা দেখেছি এবং শুনেছি, এখানে ক্রিস্টিয়ান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের গ্রহণ করার সদিচ্ছার উদাহরণ আমরা দেখেছি। শুধু সংখ্যালঘু না, আমরা তাদের সবার সাথে সম্মানের সাথে ব্যবহার করতে দেখেছি।”
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম সেক্রেটারিয়াট-এর নাদিন মায়েনযা ডিসেম্বরের শেষের দিকে আলেপ্পোর বাইরে শেহবা অঞ্চলে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর অন্তত ১২টি হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা নথিভুক্ত করেছেন।
“এইচটিএস এবং তুরস্ক-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কঠোর ধর্মীয় লঙ্ঘনের ইতিহাস আছে,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “কুর্দি, ইয়াজিদি, ক্রিস্টিয়ান এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু তুরস্ক-সমর্থিত ইসলামপন্থি মিলিশিয়াগুলোই এ’কাজ বেশি করছে।”
ঘাযাল বলছেন তাঁর ধারণা দেশ থেকে সংখ্যালঘুরা বের হয়ে যাবে।
“যেসব ক্রিস্টিয়ান বর্তমানে সিরিয়ায় আছেন, তাদের ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ায় চলে না যাওয়ার কারণ কিন্তু এই না যে তারা যেতে চাননি,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “তারা যাবার কোন সুযোগ পাননি। এবং সেটাই মর্মান্তিক বিষয়।”
তবে জুয়েজাতি হয়রানির খবরগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেন।
“আমি কিছু ঘটনা দেখেছি যেখানে দুষ্কৃতিকারীরা গণ্ডগোল উস্কে দিয়েছে, কিন্তু আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতেও দেখেছি,” তিনি ভিওএ-কে বলেন। “সিরিয়ান সংখ্যাগুরু সুন্নিরা কুর্দি এবং আলাউই এবং ক্রিস্টিয়ানদের সাথে হাত মিলিয়েছে। এবং আসাদ সরকারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখছি।”
এই রিপোর্ট ভিওএ’র আর্মেনিয়ান সার্ভিস থেকে লেখা হয়েছে।