বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় একটি আদালত বৃহস্পতিবার (২২ অগাস্ট) দু’জন সাংবাদিককে চার দিনের পুলিশ রিমান্ডে পাঠিয়েছে। ঢাকায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সময় একজন গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে বুধবার তাদের গ্রেফতার করা হয়।
একাত্তর টিভির প্রাক্তন বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ এবং তার স্ত্রী ঐ চ্যানেলের প্রাক্তন মুখ্য সংবাদদাতা ফারজানা রুপাকে তাদের কন্যাসহ ঢাকার শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা বিদেশে যাবার উদ্দেশ্যে বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন।
সাংবাদিক দম্পতির গ্রেফতারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জারনালিস্টস (সিপিজে) এক বিবৃতিতে আহমেদ এবং রুপাকে অন্তরীণ করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
“আমরা কর্তৃপক্ষর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি রিপোর্টারদের অধিকার সম্মান করার জন্য, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং তাদের সাংবাদিকতার প্রতিশোধ হিসেবে আনা যেকোনো তদন্ত বন্ধ করার জন্য” সিপিজে বুধবার সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক বার্তায় বলে।
হাসিনা-সমর্থক চ্যানেল
বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবির ১০ দিনের রিমান্ডের জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মোহাইমিনুর রহমানের আবেদনের শুনানির পর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করেন।
বুধবার বিমান বন্দরে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আহমেদ এবং রুপাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। তারা টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ইস্তানবুল হয়ে প্যারিস যাচ্ছিলেন। সাংবাদিক দুজন হাসিনা-সমর্থক টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতেন এবং ৫ অগাস্ট সরকারের পতনের পর চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের বরখাস্ত করে।
ধারনা করা হয় কর্তৃপক্ষ তাদের বরখাস্ত করে ছাত্র নেতাদের চাপে, যারা বিভিন্ন সংস্থায় লোকজনকে বরখাস্ত করার জন্য নিয়মিত দাবী জানাচ্ছে।
যে গার্মেন্ট শ্রমিক ৫ অগাস্ট উত্তরায় বিক্ষোভের সময় নিহত হয়, তার হত্যা মামলায় আহমেদ এবং রুপার নাম প্রথমে উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় হাসিনা সহ ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। সাংবাদিক দুজনকে “অজ্ঞাতনামা” অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ বৃহস্পতিবার জানায় সাংবাদিক দম্পতি বিক্ষোভকারীদের হত্যার জন্য হাসিনা সরকারকে উস্কে দিয়েছিল।
“আমরা সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, অভিযুক্তরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রদের দমন করতে (প্রাক্তন) সরকারকে উস্কে দিচ্ছিল। পুলিশ যখন তাদের ভালমত জিজ্ঞাসাবাদ করবে তখন ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে,” আদালতে পেশ করা পুলিশের আবেদনে বলা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর উদ্বেগ
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সাংবাদিক দম্পতির গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
“এটা খুবই উদ্বেগজনক যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিচার ব্যবস্থা তাদের পক্ষপাতদুষ্ট এবং অবমাননাকর ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি করছে। স্বেচ্ছাচারমূলক গ্রেফতার এবং আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে তারা শুধুমাত্র লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করেছে,” সংস্থার এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে এক ইমেইলের মাধ্যমে বলেন।
“শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকা যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু মনোযোগ রাখতে হবে প্রতিশোধ নয়, সংস্কারের দিকে। প্রতিশোধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে,” তিনি বলেন।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ব্যাপক ভাংচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ লক্ষ্য করে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত সাতটি টেলিভিশন স্টেশন এবং সংবাদপত্রের অফিস আক্রমণের শিকার হয়।
জাতিসংঘের বক্তব্য
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।
“সাংবাদিকদের নিরাপত্তা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেসব দেশ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে,” বলেন জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক। “সাংবাদিকরা যাতে কাজ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা এবং যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয় তাদের জবাবদিহি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
সাংবাদিক দম্পতির গ্রেফতার এবং রিমান্ডের ঘটনা আসে যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য খাতের প্রধানদের বদল করে পুনর্গঠনের কাজ করছেন।
ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার ৮ অগাস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১,৮০০’র বেশি নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে অপসারণ করা হয়েছে। হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাবার পর রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত করে দেন।
জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ছাত্র আন্দোলনের সময় এবং তার পরের সহিংসতায় ৬৫০ এর বেশি মানুষ প্রাণ হারান। রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় ৪০০জন মারা জান ১৬ জুলাই এবং ৪ অগাস্টের মধ্যকার সময়ে। নতুন দফার সহিংসতায় আরও ২৫০ জন নিহত হন হাসিনার পতনের পর, ৫ এবং ৬ অগাস্ট।
(এই রিপোর্টের জন্য দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে)