সীমান্তের দুপাশে ভারি বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে বাংলাদেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আটটি জেলায় বন্যার পানি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ঢাকায় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কুশিয়ারা, মনু, ফেনী, ধলাই সহ কয়েকটি নদী বিপৎসীমার উপের চলে যাওয়ায় বন্যা বিস্তীর্ণ হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
আকস্মিক এই বন্যার জন্য বাংলাদেশের অনেকে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে, ভারতের জলাধারে "গেট খুলে দেওয়াকে" দায়ী করছেন। ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভারতের কাছ থেকে "স্পষ্ট ব্যাখ্যা" দাবী করেছেন।
স্থানীয়ভাবে ভারি বৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে ফেনী, নোয়াখালী আর কুমিল্লায় বন্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হবিগাঞ্জ, সুনামগাঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যা ছড়িয়ে পড়ছে বলে স্থানীয় গণ মাধ্যম থেকে জানা গেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ লক্ষ্যেরও বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। নোয়াখালী জেলার প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার জানাচ্ছে, শুধুমাত্র নোয়াখালী জেলাতেই প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন।
বিদ্যুৎ-বিহীন ফেনী
অন্যান্য জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে ফেনী, যেখানে তিন লক্ষের বেশি মানুষ পানিবন্দী বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা ইউএনবি।
“বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। পানির তীব্র স্রোতের কারণে ঠিকভাবে উদ্ধার কাজও করতে পারছেন না। তার মধ্যে বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আরও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে,” ফেনী জেলার পরশুরামের স্থানীয় সাংবাদিক মহি উদ্দিনকে উদ্ধৃত করে ইউএনবি জানায়।
উদ্ধারকাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং কোস্ট গার্ড যোগ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বুধবার ফেনী শহর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে সংবাদ সংস্থা জানায়। এর আগেই পরশুরাম, ফুলগাজি এবং ছাগলনাইয়ার সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
“পানি না নামা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকবে। বন্যার পানি কমার আগে সংযোগ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই,” ফেনী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হোসেন মাহমুদ শামীম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে ইউএনবি জানায়। তবে কত মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছেন এই হিসাব তিনি দিতে পারেননি।
ফেনীর এক ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন সদস্য মোহাম্মাদ সেলিম জানান, এই অঞ্চলে উজানের ঢলে প্রতি বছর বন্যা হয়, কিন্তু এরকম মারাত্মক বন্যা তারা ১৯৮৮ সালের পর আর দেখেননি।
ত্রিপুরায় জলাধারের গেট খোলা
পরিস্থিতির অবনতি হবার সম্ভাবনার কথাও কর্মকর্তারা বলছেন।
“আগামী ২৪ ঘণ্টায় মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই ও সারিগোয়াইন নদীর পানি কয়েকটি পয়েন্টে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে,” দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বুধবার সাংবাদিকদের জানান।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানকার যেসব নদী বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়, তারা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অধিক পানি বহন করায় সীমান্তের দুপাশেই বন্যা উপচে পড়ছে।
একই সাথে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম জানাচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একটি বড় জলাধারের উপর পানির প্রবল চাপ কমাতে একটি গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ত্রিপুরার ১০টি প্রধান নদীর মধ্যে ৯টাই বিপৎসীমার উপরে, এবং “পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩১ বছর পর মধ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলার বিশাল জলাধার ডুম্বুরের” একটি গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
সরকারের উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি
পুরো এলাকাজুড়ে ভারি বৃষ্টি আকস্মিক বন্যার অন্যতম কারণ হলেও, বাংলাদেশে একটা ধারনা প্রবল হয়েছে যে, উজানে “পানি ছাড়ার” কারণেই বন্যা হচ্ছে।
এই বিতর্কে যোগ দিয়েছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, যারা সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে ৫ অগাস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।
“আমাদের যখন পানির প্রয়োজন আপনারা পানি দিচ্ছেন না,” ভারতের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অন্যতম হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন। “আবার যখন পানির প্রয়োজন নেই আপনারা বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় বাংলাদেশের মানুষকে সংকটের মধ্যে ফেলছেন।”
আন্দোলনের আরেক নেতা যিনি দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা, আসিফ মাহমুদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির কথা বলেন।
"কোন নোটিস ছাড়াই ওয়াটার গেইট খুলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে," মাহমুদ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
মাহমুদ ভারতের কাছ থেকে "স্পষ্ট ব্যাখ্যা" দাবী করেন।