ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (১৫ জুলাই) বিকালে এই সংঘর্ষ হয়।
বিকাল ৩টার দিকে, সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে যোগ দেন।
কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ইডেন মহিলা কলেজ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন কর্মী সমাবেশে যোগ দিতে এলে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা গেটে তালা লাগিয়ে তাদের বাধা দেয়। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
আহতদের মধ্যে রয়েছেনে; সায়মা আফরোজ, শাহিনুর সুমি, সুমাইয়া আক্তার ও সানজিদা হক। এদের মধ্যে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে, সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে রবিবার (১৪ জুলাই) গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেনছ
‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর আহবানে রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলে ছাত্রীদের হলসহ সব আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
উল্লেখ্য, চীন সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি চাকরি পাবে না, চাকরি পাবেকি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা? এটা জাতির কাছে আমার প্রশ্ন।”
ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
আসন্ন পবিত্র আশুরা ও তাজিয়া মিছিল কেন্দ্র করে, পুরান ঢাকার হোসেনী দালান ইমামবাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সোমবার (১৫ জুলাই) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, “আদালতের নির্দেশ আমাদের মানতে হবে। তাই আদালতের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই পুলিশ কাজ করবে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে মোকাবেলা করা হবে।”
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধাসহ বিদ্যমান কোটা বাতিল সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রবিবার (১৪ জুলাই) বিকেলে ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার যদি বিদ্যমান কোটার হার পরিবর্তন করতে, কমাতে অথবা বাড়াতে চায়, তাহলে এই রায় বাধা হবে না।
এর আগে, গত ১১ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা ও আদেশ (অপারেটিভ অংশ) সম্বলিত এক পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করা হয়।
আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগ গত ১০ জুলাই কোটার বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ৭ আগস্ট শুনানির দিন রেখেছে আপিল বিভাগ। ফলে আপাতত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হবে না।
কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে করা ২৩৫ নম্বর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় ও আদেশ এবং যে রায়টি ২০৬২/২০১৩ নম্বর লিভ টু আপিলের মাধ্যমে সংশোধিত আকারে আপিল বিভাগে বহাল রাখা হয়েছে, সেই রায়ের আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের কোটা পুনরায় বহাল করার নির্দেশ দেয়া হলো।
একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং অন্যান্য যদি থাকে, সেক্ষেত্রে কোটা বহাল রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব, সেটা আদেশের কপি গ্রহণের সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করার নির্দেশ দেয়া হলো।
রায়ে আরো বলা হয়, যেভাবেই হোক, যদি সব ক্ষেত্রে কোটার হার পরিবর্তন করতে, কমাতে অথবা বাড়াতে চায়, তাহলে বিবাদীদের (সরকারের) জন্য এই রায় ও নির্দেশনা বাধা হবে না। যদি কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটা পূরণ না হয়, সেক্ষেত্রে শূন্য পদ সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করার ক্ষেত্রে বিবাদীদের স্বাধীনতা থাকবে।
রায়ের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান বলেন, আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। আগামী ৭ আগস্ট শুনানির দিন রেখেছে আপিল বিভাগ। ফলে আপাতত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হবে না।
হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, রায়ে সব কোটা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তবে, প্রয়োজনে সরকার তা কমাতে বা বাড়াতে পারবে। আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। ফলে এ রায় এখনই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকারি পরিপত্র জারি করা হয়।
এই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাত ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। এরপর রুলের শুনানি শেষে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। রবিবার (১৪ জুলই) এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
কোটা পদ্ধতি প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ
এদিকে, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের চলমান ‘বাংলা ব্লকেডের’ মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ওপর ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ।
বুধবার (১০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বেঞ্চ কোটা সংস্কার নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীর করা আবেদনের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম জানান, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ৪ সপ্তাহের মধ্যে লিভ-টু-আপিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আপিল বিভাগে আবেদন করেন ২ জন কোটা আন্দোলনকারী। বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগ এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করে চেম্বার আদালত।
এর আগে ৪ জুলাই রিট আবেদনকারীর আইনজীবী অনুপস্থিত থাকায় হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি করে আপিল বিভাগ।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে এ বছরের ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। রিট আবেদনকারী পক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়।
এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী ৯ জুলাই আবেদন করেন। দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য ১০ জুলাই আপিল বিভাগে ওঠে। শুনানি শেষে স্থিতাবস্থার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।