ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনার হত্যার ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা থেকে দুই সন্দেহভাজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল বুধবার (২৬ জুন) খাগড়াছড়ির পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই সন্দেহভাজন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল গাজীকে আটক করে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদ।
আটকের পরপরই বিকেলে হেলিকপ্টারযোগে তাদের ঢাকায় আনা হয়।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, সন্দেহভাজন দুই জন ২৩ দিন ধরে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি এলাকার কালী মন্দিরে অবস্থান করছিল এবং সে সময় তারা স্থানীয়দেরকে হিন্দু পরিচয় দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তারা মন্দিরে আশ্রয় পাওয়ার জন্য হিন্দু নাম ধারণ করেছিল। তারা স্থানীয়দের বলত, কালী মাতার সঙ্গে থাকতে তারা পছন্দ করে। তাই তারা মন্দির ছেড়ে কোথাও যায় না।
এর আগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে হেলিকপ্টারে করে অভিযান চালায় ডিএমপির গোয়েন্দারা।
তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সূত্রে জানা গেছে, সন্দেহভাজনদের মধ্যে মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হত্যার আগে ২ মে কলকাতায় গিয়েছিলেন।
তারা ১৯ মে দেশে ফেরেন। পলাতক এই দুই সন্দেহভাজনকে মরিয়া হয়ে খুঁজছিলেন গোয়েন্দারা।
আটক দুই জনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত শিমুল ভূঁইয়ার বাড়িও একই এলাকায়।
উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য ১১ মে ভারতে গিয়েছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। ১২ মে তার বন্ধু গোপালের বাড়িতে যান তিনি। ১৪ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। আট দিন নিখোঁজ থাকার পর ২২ মে তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
কলকাতার অদূরে নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে তাঁকে (আনোয়ারুল আজিম) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে ২২ মে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এ ঘটনায় ২২ মে একটি মামলা দায়ের করা হয়। আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের অভিযোগের ভিত্তিতে শেরে বাংলা নগর থানায় মামলা করা হয়।
আনোয়ারুল হত্যার উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি: ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বিদেশে অবস্থান করায় হত্যার মূল উদ্দেশ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি।
২৯ মে (বুধবার) ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “এমপি আনার হত্যার পেছনে উদ্দেশ্য কী- এটি বাংলাদেশ পুলিশ বা ভারতীয় পুলিশ এখনো পর্যন্ত বের করতে করতে পারেনি।”
হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা গ্রেপ্তার হলেই উদ্দেশ্য জানা যাবে। পুলিশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, এমপি আনোয়ারুল হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত শাহীন এখন যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো বহিঃসমর্পণ চুক্তি নেই। তবে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্য
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
২৩ মে (বৃহস্পতিবার) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।
হাছান মাহমুদ জানান, ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে।
হাছান মাহমুদ আরও বলেন, “আমাদের মিশন পুরো বিষয়টি নিয়ে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। যেহেতু তদন্তাধীন বিষয়, তাই এ নিয়ে বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়।”
এর আগে ২২ মে (বুধবার) কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাছান মাহমুদ জানিয়েছিলেন, কলকাতার যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতা পুলিশ সেই ফ্ল্যাটে ঢুকে মরদেহ পায়নি।
তখন তিনি আরও বলেছিলেন, “আমরা আমাদের মিশনের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখছি এবং মিশন থেকেও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তাধীন। তাই এর বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আরও যোগাযোগ রাখছে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বক্তব্য
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ এখনো উদ্ধার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ২৩ মে (বৃহস্পতিবার) বিকেলে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমরা এখনো লাশ উদ্ধার করতে পারিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবকিছু উদ্ধার করতে না পারছি, ততক্ষণ আমরা আপনাদের কোনো তথ্য দিতে পারব না। আবারও বলছি, উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে কাজ করছে।”
তবে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরসহ প্রায় সবকিছু শনাক্ত করেছে বলে জানান তিনি।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের শনাক্ত করার খুব কাছাকাছি আছি আমরা। শুধু ঘোষণা বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা একমত হলেই ঘোষণা দেওয়া হবে।”
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা, ভারতীয় পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। আমরা নিশ্চিত যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে তাদের থেকে শুনেছি, তবে আমরা এখনো লাশ উদ্ধার করতে পারিনি।”
এ হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় কেউ জড়িত কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভারতীয় জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিইনি। তদন্ত চলছে। কারা জড়িত তা কিন্তু আমরা এখনো বলিনি। আমরা বলেছি যে, আমাদের একটি সাধারণ ধারণা আছে। সেই ধারণার ভিত্তিতেই আমরা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা নিয়ে কাজ করছি।”
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৩ মে (বৃহস্পতিবার) বলেছিলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না তা তদন্ত করে জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, “তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারব না। আওয়ামী লীগে অপরাধীদের কোনো স্থান নেই।”
ওবায়দুল কাদের বলেন, জনপ্রিয়তার কারণে ঝিনাইদহ-৪ আসনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সেসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “অন্যায়কারী দলের লোক হলেও শেখ হাসিনা তাকে রেহাই দেন না। অপরাধের ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলেন।”
এসব অভিযোগের সময় ও সুযোগ নিয়েও প্রশ্ন তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “(তাঁর) মৃত্যুর আগে আমাদের দেশের সাংবাদিকদের কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ বিষয় কেন আসেনি?”