অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

‘ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী সম্পর্কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে’, গোলটেবিল বৈঠকে শাহরিয়ার আলম


রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম।
রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম বলেছেন, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। দুই দেশের এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বে দৃষ্টান্ত। দুই দেশের এই সম্পর্ক আরো নতুন উচ্চতায় এগিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

শুক্রবার (১৪ জুন) সকালে রাজধানী ঢাকায় আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন শাহরিয়ার আলম।

শাহরিয়ার আলম বলেন, দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক জোরদার করার চ্যালেঞ্জ কাটাতে, গত ১৫ বছরে কূটনীতির বাইরে গিয়েও অনেক কাজ করা হয়েছে। সেই কারণে ২০২৪ সালে মানুষের মাঝে যে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে তাতে প্রত্যাশার মাত্রা বেড়েছে।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২১ জুন দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যাবেন। ওই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

“ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এখন পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করাটাই কাজ। দুই দেশের মধ্যে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা গেছে। বাকিগুলোও করা যাবে;” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের বরাত দিয়ে বলেন শাহরিয়ার আলম।

তিনি জানান, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে ৩৩ দফা যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ), জ্বালানি সহযোগিতা, জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ, বিস্তৃত সংযোগ এবং অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর এসব ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে জানান শাহরিয়ার আলম।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) পরবর্তী বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন শাহরিয়ার আলম। বলেন, ২০২২ সালের আগস্টে নয়াদিল্লিতে জেআরসির ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে পানি সম্পদ খাতে সহযোগিতা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২১-২২ জুন অনুষ্ঠেয় শেখ হাসিনার ভারত সফরে, দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক, চুক্তি সই রয়েছে হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া সহযোগিতার কয়েকটি ক্ষেত্র নিয়ে ঘোষণাওআসতে পারে।

বক্তাদের অভিমত

আলোচনায় দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি, ভারত সরকারের নতুন মেয়াদে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “আশা করি আমাদের ন্যায্য হিস্যা পাবো।”

বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশী, এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বল উল্লেখ করেন শমসের মবিন চৌধুরী। “১৯৭১ সালে যদি আমরা রক্ত ভাগাভাগি করতে পারি, আমার বিশ্বাস, আমরা পানি ভাগাভাগি করতে পারবো;” তিনি যোগ করেন।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই উপনিবেশমুক্ত হওয়ার ফলে উপকৃত হচ্ছে। “দুই দেশকেই, এগিয়ে যেতে থাকা এই সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে হবে” তিনি আরো বলেন।

“আমি মনে করি, আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন কিছু আনতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে কথা বলে আসছি;” বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনের বিকাশের প্রয়োজন। এ সময় 'তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট' প্রকল্পের কথা বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ । এ প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ধারণার বিষয়ে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একই প্রকল্পে ভারতের আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তিনি আরও বলেন, “আমি মনে করি, সংঘাতের ভূ-রাজনীতিকে সহযোগিতার ভূ-রাজনীতিতে রূপান্তর সম্ভব। কারণ, বাণিজ্যসহ অনেক ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়ার ইচ্ছা আছে ভারতের। এটি দেশটির জন্য সবাইকে একত্রিত করে নেতৃত্ব গ্রহণের একটি সুযোগ। তিনি বলেন, “তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি নাও থাকতে পারে, কিন্তু ব্যবহারের জন্য যা পাওয়া যায় তা ভাগ করে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে সমস্যা সেখানেই সমাধান খুঁজতে হবে।”

তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বিষয়ে চীনের কোনো প্রস্তাব নেই, তবে বাংলাদেশের অনুরোধে তারা আগ্রহ দেখিয়েছেন।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক সাহাব বলেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে বিশাল লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) পাচ্ছে। তবে এর বাস্তবায়ন ধীর গতিতে চলছে।

তিনি আরো বলেন, বিশাল এলওসি আসছে, যা খুবই আকর্ষণীয়। টাকা তো আছেই। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। “তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমি মনে করি দুই দেশকে আরো বাস্তববাদী হতে হবে;” যোগ করেন অধ্যাপক সাহাব।

তিনি আরো বলেন, চীনের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি খুবই দ্রুত; এমনকি এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রও খুব দ্রুত গতির। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ এবং চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।

প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী বলেন, দুই দেশ বহু বছর পর স্থলসীমানা সমস্যার সমাধান করেছে এবং তিস্তা বিষয়ে সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সিইপিএ নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন গৌতম লাহিড়ী। বলেন, “আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আমাদের দ্রুত এগোতে হবে।”

তিনি বলেন, ভারত বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ এমন কিছু করবে না, যা ভারতের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে এবং বাংলাদেশের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হওয়ার লক্ষ্য পূরণে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকার হেড অফ পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স দেবদীপ পুরোহিত বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে দেখে। এর মধ্যেই ভারতের কাছে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন ৩৬০ ডিগ্রিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দেবদীপ বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে তিস্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন তিস্তার পানি ভাগাভাগির কথা ওঠে, তখন প্রশ্ন আসে, সেচের লক্ষ্য কীভাবে পূরণ হবে। কারণ, শুষ্ক মৌসুমে তো নদীতে পানি থাকে না। তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় দুই দেশ কীভাবে তিস্তাকে ব্যবহার করবে, তা নিয়ে নতুন ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।

“সব মিলিয়ে তিস্তাকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রস্তাবও আছে। চীনও প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ কার সঙ্গে যাবে এটা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই;” যোগ করেন দেবদীপ পুরোহিত।

সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে দেবদীপ পুরোহিত বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে এসে বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, রাজীব গান্ধী ও প্রিয়াংকা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। সে সাক্ষাতের ছবি রাহুল গান্ধী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। সেই ছবি ভীষণ ভাইরাল হয়েছে। এতেই বুঝা যায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে।

বাংলাদেশ ভারতের নতুন সরকার: সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের নতুন সূচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত।

XS
SM
MD
LG