বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ সরকারের সহায়তায় দেশ ছেড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক।
তিনি প্রশ্ন করেন, “চোর ও দুর্নীতির রাজা বেনজীর সরকারি সহায়তা ছাড়া কীভাবে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার হলেন?”
জয়নুল আবদিন ফারুক আরও বলেন, বর্তমান সরকার যদি গণতান্ত্রিক হতো এবং বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত হতো তাহলে বেনজীরকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হতে সাহায্য করত না।
তিনি বলেন, “এ কারণেই মানুষ বলতে শুরু করেছে এই সরকার চোরের রাজা, এই সরকার দুর্নীতির রাজা। এটা জনগণের সরকার নয়।”
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমেদসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এসব কথা বলেন তিনি।
গণতন্ত্র ফোরাম এই মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে।
জয়নুল আবদিন ফারুক মানববন্ধনে অভিযোগ করেন, বেনজীর ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের মতো আরও অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
তিনি বলেন, “জনগণ জানতে চায় আজিজ-বেনজীরের মতো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ: ‘বেনজীরের বিদেশযাত্রায় কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি’
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।
৩ জুন (সোমবার) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
হাছান মাহমুদ বলেন, “তার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে বিদেশ ভ্রমণে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার স্বচ্ছভাবে দেশ পরিচালনা করে এবং দুদকের ওপর সরকারের কোনো প্রভাব নেই। “দুদক স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে;” বলেন হাছান মাহমুদ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
১ জুন (শনিবার) দুপুরে, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সরকার নিশ্চিত নয়।
“তার দেশত্যাগের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই বেনজীর আহমেদের বিচার হবে;” আরও বলেন আসাদুজ্জামান খান।
ওবায়দুল কাদের: বিএনপি নেতাকে ‘অন্ধকারে ঢিল' না ছোঁড়ার পরামর্শ
বেনজীর আহমেদের বিদেশে চলে যাওয়া নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমীরের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্মাদক ওবায়দুল কাদের।
মির্জা ফখরুল ১ জুন (শনিবার) প্রশ্ন করেছিলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কীভাবে দেশ ছাড়লেন? জবাবে ওবায়দুল কাদের ২ জুন (রবিবার) ঢাকায় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন “সরকারের কারা গিয়ে তাঁকে বিমানে তুলে দিয়েছে? কোন কর্তৃপক্ষ গিয়ে তাঁকে তুলে দিয়েছে? অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়বেন না।”
তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদের ঘটনা তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্ত, মামলা, গ্রেপ্তার, সবকিছু একটা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
“সরকার এখানে দুদককে এড়িয়ে আগ বাড়িয়ে কেন ব্যবস্থা নেবে? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী যেসব সংস্থা আছে তাদের কোনো ব্যর্থতা থাকলে তারও বিচার হবে,” তিনি বলেন।
ওবায়দুল কাদের জানান, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বেনজীর আহমেদ বিদেশে থাকলেও বিচার চলবে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে দেশে ফিরতেই হবে। “সরকার কোনো ছাড় দেবে না,” আরও বলেন তিনি।
সিঙ্গাপুরে বেনজীর
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ৩১ মে (শুক্রবার) এবং ১ জুন (শনিবার) সংবাদ প্রকাশ করে যে, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ৪ মে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন।
৪ মে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর গেছেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকার সংবাদমাধ্যমগুলো।
বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিন মেয়ে ও স্ত্রীসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যান তিনি। স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসাজনিত কারণে তাঁরা সেদেশেই অবস্থান করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, র্যাব ও বেনজীর আহমেদ
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ওই কর্মকর্তারা হলেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খান। তাঁদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত।
বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছেন বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।