ভারতের লোকসভা থেকে শুক্রবার ৮ ডিসেম্বর খারিজ হয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্রর সংসদ সদস্য পদ। সংসদের এথিক্স কমিটি প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডে মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে সুপারিশ জমা দিয়েছিল। ভারতের সংসদের নিয়মানুযায়ী ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে তৃণমূল সংসদ সদস্যের সংসদ সদস্য পদ এদিন খারিজ হয়ে যায়।
গত ৩ ডিসেম্বর থেকে সংসদে শুরু হয় শীতকালীন অধিবেশন। শুক্রবার মহুয়ার বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। তৃণমূল, কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির দাবি ছিল, রিপোর্ট পড়ার জন্য সময় দেওয়া হোক। সেইসঙ্গে মহুয়াকে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ দিক স্পিকার।
বিরোধীদের এই অভিযোগ নাকচ করে দেন স্পিকার ওম বিড়লা। তিনি বলেন, মহুয়া এথিক্স কমিটির কাছে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর আধঘণ্টা এই বিষয়ে আলোচনা-বিতর্ক হয়।
মহুয়া মৈত্রকে এভাবে সংসদ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অধীর। তার কথায়, মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে কোনও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তার আগেই তাকে শাস্তি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিতর্কে অংশ নিয়ে তৃণমূল বিধায়ক কল্যাণ বন্দোপাধ্যায় বলেন, লোকসভায় যেহেতু মহুয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে, তাই লোকসভার ভূমিকা এখানে আধা বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের মতই। এই ধরনের বিচারের শর্তই হল অভিযুক্তকে বলতে দেওয়া।
আধঘন্টা বিতর্কের পর সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীকে প্রস্তাব পেশ করতে বলেন স্পিকার।লোকসভায় বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর আনা প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি করলে সংসদ থেকে মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের আবেদনের পক্ষেই ধ্বনি ভোটে রায় দেয় লোকসভা। মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার প্রস্তাবে সিলমোহর দেন স্পিকার ওম বিড়লা।
সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে এসে মহুয়া মৈত্র বলেন, “আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এক তরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” মহুয়ার দাবি, তাকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে এথিক্স কমিটির সুপারিশ করার কোনও অধিকার নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের কার্শিয়াংয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, "পুরোটাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ে করা হল। মহুয়ার সঙ্গে সুবিচার করা হল না। আমি একবার ভেবেছিলাম প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন। কিন্তু দেখলাম গণতন্ত্রের কোনও স্থানই নেই।"
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল লোকসভায় প্রশ্ন করার জন্য তিনি ভারতীয় শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে ঘুষ বাবদ নগদ অর্থ ও নানা ধরনের উপহার নিয়েছেন। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এই অভিযোগে প্রথম সরব হন।
গত ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদরাই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও লোকসভার স্পিকারকে চিঠি পাঠান। সেখানে আইনজীবী দেহাদরাই মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগ করেন। তবে মহুয়া প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মহুয়ার দাবি ছিল, তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে কুৎসা প্রচার করা হচ্ছে। অতীতে এক সময় মহুয়া মৈত্রর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আইনজীবী দেহাদরাইয়ের।
মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ নিয়ে সরব হন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তিনি লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখে মহুয়া মৈত্রর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করার আবেদন জানান। তিনিই এই বিষয়ে যুক্ত করেন শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানিকে। তার অভিযোগ, সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ও গৌতম আদানির সমালোচনা করার জন্য মহুয়া টাকা ও দামি উপহার নিয়েছিলেন দর্শনের থেকে।
নিশিকান্তের বক্তব্য ছিল, মহুয়ার এই পদক্ষেপ সংসদীয় বিশেষাধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং সংসদের অবমাননা করেছেন মহুয়া। এই অভিযোগের পরই মহুয়া মৈত্র আইনি নোটিস পাঠান নিশিকান্ত দুবেকে। এছাড়াও বারবার হেনস্থা করার জন্য আইনজীবী দেহাদরাইয়ের বিরুদ্ধেও পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মহুয়া।
নিশিকান্তের অভিযোগের পরই সক্রিয় হয় লোকসভার এথিক্স কমিটি। বিজেপি সংসদ সদস্যের দাবির সত্যতা নিয়ে তদন্ত শুরু করে তারা। মহুয়ার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের লোকসভা সাইটের লগ ইন আইডি ও পাসওয়ার্ড দর্শনকে দিয়েছিলেন।
মহুয়ার বিরুদ্ধে শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানি একটি হলফনামা দাখিল করেন। তিনি দাবি করেন, মহুয়া তাকে ব্যবসায়িক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে অন্যায্য সুযোগ নিয়েছিলেন। মহুয়া মৈত্রকে তিনি দামি উপহার, বিদেশে ছুটি কাটানোর খরচ, দিল্লির বাংলো মেরামত করার জন্য অর্থ ইত্যাদি দিয়েছেন।
মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে এথিক্স কমিটি। কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ সোনকার জানিয়েছিলেন, ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের জন্য সমস্ত দিক যাতে খতিয়ে দেখা যায়, সেইজন্য তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্র এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে চিঠি দেওয়া হয়। সবকিছু খতিয়ে দেখে কমিটি গত ৩১ অক্টোবর সংসদ সদস্যকে তদন্তের খাতিরে তলব করে।
এরপর মহুয়া জানান, ৩১ অক্টোবর তিনি হাজিরা দিতে পারবেন না। ৫ নভেম্বরের পরেই এথিক্স কমিটির সামনে হাজির হতে পারবেন তিনি। কিন্তু এথিক্স কমিটি জানিয়ে দেয় ২ নভেম্বর তাকে হাজিরা দিতেই হবে।
গত ২ নভেম্বর এথিক্স কমিটির সামনে হাজিরা দেন মহুয়া। যদিও সেই বৈঠকের মাঝপথেই তিনি বেরিয়ে আসেন। তার অভিযোগ ছিল, কমিটি তাকে 'নোংরা' প্রশ্ন করেছে, যা খুবই অপমানজনক। তদন্ত শেষে এথিক্স কমিটি মহুয়া মৈত্রর সংসদ সদস্য পদ খারিজের সুপারিশ করে।
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাথমিক বক্তব্য ছিল সংসদীয় প্যানেলের তদন্ত শেষ হলে দল যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। তবে পরে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া মৈত্রকে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, "এদের প্ল্যান এখন মহুয়াকেও তাড়িয়ে দেওয়া। এতে মহুয়ার লাভ। মহুয়া আরও জনপ্রিয় হয়ে যাবে। যে কথাগুলো মহুয়া এতদিন সংসদের ভেতরে বলছিল, এখন সেগুলো বাইরে বলতে পারবে। মূর্খ না হলে কেউ এমন করে?" মহুয়া মৈত্রকে শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়েছে বিজেপি বিরোধী দলগুলি, তার মধ্যে রয়েছে কংগ্রেস, সিপিএম।
লোকসভার এথিক্স কমিটি তদন্ত শেষ করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্টে মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা প্রশ্ন-ঘুষ কান্ডের অভিযোগের সত্যতাকেই মান্যতা দেওয়া হয়। তার সংসদ সদস্য পদ খারিজের সুপারিশ করা হয়। স্থির হয়, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডের রিপোর্ট পেশ করবে এথিক্স কমিটি।
তারমধ্যেই সামনে আসে, লোকপালের নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি সিবিআই মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। তবে এই মামলায় মহুয়াকে গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। প্রাথমিক তদন্ত শেষে রিপোর্ট লোকপালের কাছে জমা দেবে তারা।