ভারতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে নানারকম সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তার মধ্যে নতুন সংযোজন মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারে রোবোটিক্স-এর ব্যবহার। বর্তমানে হার্টের যে কোনও জটিল অপারেশনের মতো স্পাইন সার্জারিতেও প্রয়োগ করা হচ্ছে রোবোটিক্স। এর ফলে কম সময়ে যন্ত্রণাহীন অপারেশনে দ্রুত সেরে উঠছেন রোগী। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতাল রোবোটিক স্পাইন সার্জারিতে নতুন দিশা দেখাচ্ছে।
হার্টের মতো মেরুদণ্ডের যে কোনও অপারেশন মানেই তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন রোগী ও তার পরিবার। এই ধরনের অপারেশন যেমন জটিল, তেমনই ব্যয়সাপেক্ষ। মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার বলতেই চিরাচরিত ধারণা হল, বেশ কয়েক ঘণ্টার পদ্ধতিতে অনেকটা কাটাছেঁড়া করা। তার পরে অন্তত পাঁচ-সাত দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা। কিন্তু রোবোটিক্স-এর প্রয়োগে এই ধারণা এখন বদলাচ্ছে ভারতে।
সম্প্রতি পনেরো বছরের এক কিশোরীর রোবোটিক স্পাইন সার্জারি হয়েছে বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতালে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বাসিন্দা এই কিশোরী মেরুদণ্ডের জটিল রোগ স্কোলিওসিস নিয়ে মণিপাল হাসপাতালে ভর্তি হন। বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও রোবোটিক স্পাইন সার্জারি বিভাগের প্রধান (এইচওডি) ডা. এস বিদ্যাধারা জানিয়েছেন, মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে স্কোলিওসিস। এ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড সোজা না হয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার পর বাঁকা হয়ে থাকে, নুয়ে পড়ে। জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক স্কোলিওসিস-এর চিকিৎসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকদের কাছেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ১০ বছর বয়সের পর থেকে মেরুদণ্ড দ্রুত বাড়তে থাকে। সাধারণ ভাবে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চতা বাড়ে। এর মধ্যে মেরুদণ্ডের গঠনে সমস্যা হলে তা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। কারণ বাঁকা মেরুদণ্ড হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের বৃদ্ধিও ঠেকিয়ে দেয়। ছোট থেকেই মেরুদণ্ডের গঠনগত সমস্যা খুব বেশি মাত্রায় হলে হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুস তো বটেই, অন্য অঙ্গের ওপরেও প্রভাব পড়ে। তখন রোগীকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
ডা. বিদ্যাধারা জানান, স্কোলিওসিস-এর চিকিৎসা দক্ষিণ ভারতে আধুনিক পদ্ধতিতে হয়। বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতালে স্পাইন সার্জারি মিনিমাল ইনভ্যাসিভ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে ও যন্ত্রণাহীন প্রক্রিয়ায় করা হচ্ছে। রোগী দ্রুত সেরেও উঠছে।
১৫ বছর থেকে ৯০ বছর বয়স অবধি রোগীদের মেরুদণ্ডের অপারেশন হচ্ছে বেঙ্গালুরুর মণিপাল হাসপাতালে। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ১৫ হাজারেরও বেশি স্পাইনের জটিল অপারেশন করেছে বেঙ্গালুরুর মণিপাল ইনস্টিটিউট অফ রোবোটিক স্পাইন সার্জারি (MIRSS)। রোবোটিক সার্জারিও চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছে এই হাসপাতালে। রোবোটিক স্পাইন সার্জারি শুরু হওয়ার পর থেকে ৫০টি অপারেশন সাফল্যের সঙ্গে করেছেন এখানকার চিকিৎসকেরা।
ডা. বিদ্যাধারা জানান, ৭০ বছর বয়স্ক এক রোগী টি-জেন লুম্বার সমস্যায় ভুগছিলেন। থোরাকোলাম্বার ফিউশন পদ্ধতির মাধ্যমে ওই বৃদ্ধকে সুস্থ করে নতুন জীবন দিয়েছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা।
ল্যাপারোস্কোপির থেকে আরও এক কদম এগিয়ে এই রোবোটিক সার্জারি। এক্ষেত্রে অপারেশন থিয়েটারে রোগীর পাশে নয়, চিকিৎসক থাকেন পাশের ‘কনসোল’-এ। সেখানে বসে মনিটরে ত্রিমাত্রিক ছবি (থ্রি-ডি ইমেজিং) দেখতে পান তিনি। শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করা হবে, সেই অংশটি প্রায় ৮০ গুণ বাড়িয়ে তিনি মনিটরের পর্দায় দেখতে পান। আর সেখান থেকেই চালনা করেন রোবটকে।
অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিনবত্ব। রোগীর শরীরে ছুরি-কাঁচি প্রয়োগ করে নয়, ছোট ছোট গোটা পাঁচেক ছিদ্র করে রোবটের হাত (যা মাত্র ১ সেন্টিমিটার চওড়া) এবং ছোট ক্যামেরা ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েই সার্জারি করা হয়। রোবট, হাতের কব্জি ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরাতে পারে, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শরীরের যে কোনও দুর্গম এবং ছোট জায়গায় পৌঁছে গিয়ে জটিল অস্ত্রোপচার অথবা নিখুঁত ভাবে সেলাই করা রোবটের পক্ষে অনেক সহজ।
যেহেতু খুব ছোট ছিদ্র বা ইনশিসন করা হয় তাই ক্ষত তাড়াতাড়ি সেরে যায়। কোনওরকম রক্তক্ষরণ হয় না। খুব তাড়াতাড়ি রোগী সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারেন। পোস্ট-সার্জারি পর্বে জটিলতা যেমন কম, তেমনই রোগী খুব দ্রুত তার স্বাভাবিক কাজকর্মও শুরু করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে যন্ত্রণা কম। প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকিও কম। সার্জারির এক থেকে দুই দিনের মধ্যে রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে।
ডা. এস বিদ্যাধারা বলছেন, “রোবোটিক পদ্ধতিতে আমরা স্কোলিওসিস-সহ মেরুদণ্ডের বহু সমস্যা যেমন- সার্ভিকাল কর্পেক্টমি, সার্ভিকাল পেডিকিউল স্ক্রু ফিক্সেশন, ভার্টিব্রাল প্লাস্টিস এবং কাইফোপ্লাস্টি-র ক্ষেত্রে অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। কম ঝুঁকি, দ্রুত রোগীর সুস্থতা এবং মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের জন্য এটি একটি অত্যন্ত আধুনিক ও সফল পদ্ধতি।”