ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে পুরুষদের কথা যেভাবে আলোচিত হয় সেই তুলনায় নারীশক্তির কথা বরাবরই কম আলোচিত হয়েছে। মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার সেই বিখ্যাত উক্তি- “বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।...জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,/মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্”। স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে মহিলারাও কখনও অন্তরালে থেকে কখনও আবার প্রকাশ্যে এসে লড়াই করেছেন এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক শ্রীমতী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন – “ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা অপরিসীম যদিও তার মূল্যায়ন খুবই কম হয়েছে। আইকনিক ফিগার ছাড়া খুব কমজনের কথাই আমারা ইতিহাসে পাই। স্বাধীনতার নানা ধারা ছিল যেমন- গান্ধীবাদী ধারা, সশস্ত্র বিপ্লবের ধারা, চল্লিশের দশকের বামপন্থী ধারা। এই নানা ধারায় অংশগ্রহণকারী মেয়েরা ছিলেন।” আসলে অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে নারীরা ছিলেন নিয়ম-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। সামাজিক অবস্থানের কারণেই ঘর থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশগ্রহণ স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে থাকেননি। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত সংযোজন করেন- “মেয়েরা জেলায় জেলায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মিটিং মিছিলের মধ্যে নিজেদের সবটুকু দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। সশস্ত্র বিপ্লবের ধারাতে মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদর, কল্পনা দত্ত – এনাদের কথা জানলেও অনালোচিত থেকেছেন আরও অনেক অনেক মেয়েরা যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পারিবারিক ও পুলিশি হেনস্থার স্বীকার হয়েও স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেক সময়ে ইতিহাসে তাদের কথা যত না আলোচিত তার থেকে আত্মজীবনী ও সাহিত্যে তাদের কথা বেশি পাওয়া যায়”।
ভারতের স্বাধীনতার দিনে ভয়েস অফ আমেরিকা-র পাতায় রইল তেমনই কয়েক জন স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীর কথা, যাদের হয়ত মানুষ ভুলতে বসেছেন।
শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী
অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের অন্যতম দুই মহিলা সংগ্রামী হলেন শান্তি ঘোষ (১৯১৬) ও সুনীতি চৌধুরী (১৯১৭)। দুজনেই কুমিল্লার ফৈজন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৩০ সালে কুমিল্লার আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে তাদের কিশোরী মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তারা ঐ বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবেন বলে লাঠি ও ছোরা চালানো শিখেছিলেন, গ্রাম থেকে বারো মাইল দূরে ময়নামতি পাহাড়ে গিয়ে বন্দুক চালানো শিখেছিলেন বীরেন্দ্র ভট্টাচার্যর কাছে। যে সময়ে এবং বয়সে দাঁড়িয়ে তারা এগুলি শিখছেন, তখনকার দিনে সেই ১৪/১৫ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। অথচ তাদের মনে তখন তীব্র ইংরেজ বিদ্বেষ ও দেশ মুক্তির আগুন জ্বলছে। ১৯৩১-এ কুমিল্লায় ছাত্র কনফারেন্স হলে তারা ৫০/৬০ জন ছাত্রী নিয়ে তৈরি করেন ‘ছাত্রী সংঘ’। ব্রিটিশ সরকারকে জব্দ করতে ১৯৩১-এর ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে তার বাংলোতে গিয়ে সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। সুনীতির দুটো গুলি স্টিভেন্স-এর বুকে লেগেছিল। এটি ছিল সশস্ত্র সংগ্রামে মহিলাদের প্রথম পদক্ষেপ। ধরা পড়ে যাওয়ার পর অশ্রাব্য গালিগালাজ আর প্রচন্ড মার জুটেছিল তাদের কপালে। অবশেষে ১৯৩২-এর ২৭ জানুয়ারি যখন তারা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ফাঁসির মঞ্চে যাবার জন্য, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী হওয়ার দরুন তাদের শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন জেল। এখানেও ইংরেজদের বিভাজন নীতি কাজ করেছিল, শান্তিকে দ্বিতীয় শ্রেণির আর সুনীতিকে তৃ্তীয় শ্রেণির কয়েদি করা হয়েছিল। জেলে থাকাকালীন তাদের পরিবারের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা হয়। কিন্তু শত অত্যাচার সহ্য করেও তাদের থেকে কোনও গুপ্ত কথা জানতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। পরে গান্ধীজির আবেদনে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে তাদের মুক্তি হয়েছিল। মনের জোরে সুনীতি পড়াশোনা করেন, ডাক্তার হয়ে দরিদ্রদের সেবা করেছেন। শান্তি সাহিত্যচর্চা করতেন, ‘অরণ্য-বহ্নি’ নামে জীবনকাহিনি লিখেছিলেন।
কল্যাণী দাস ও বীণা দাস
দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে বদ্ধপরিকর আদর্শবাদী বাবা শ্রী বেনীমাধব দাশের কাছ থেকে আদর্শের জন্য ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন দুই বোন কল্যাণী (১৯০৭) ও বীণা (১৯১১)। কল্যাণী দাস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াকালীন ‘ছাত্রীসংঘ’ গঠন করেন। তিনি ছিলেন এই সংঘের সম্পাদক। রাজনৈতিক দিক থেকে এই সংঘের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ধীরে ধীরে এখানে যোগ দেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্তর মত আন্দোলনকারীরা। এখানে মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামী তৈরি করা হত। তাদের সাঁতার শিক্ষা, সাইকেল চড়া, ফার্স্ট এইড-এর শিক্ষা দেওয়া হত। সমাজের নানা বঞ্চনাকে উপেক্ষা করে শিক্ষিত মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ে। যুগান্তর দলের কর্মী দীনেশ চন্দ্র মজুমদার তাদের লাঠিখেলা ও ছোরাখেলা শেখাতেন। পরবর্তীতে এই কাজের জন্য তার ফাঁসি হয়েছিল। কল্যাণী আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। কখনও বেথুন কলেজের সামনে, কখনও আবার বড়বাজারের বিদেশী কাপড়ের দোকনের সামনে পিকেটিং করতেন। ততদিনে তিনি নারী সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছেন। পরে ১৯৩২-এ হাজরা পার্কে সভা করতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং বিচারে আট মাসের জেল হয়। জেল থেকে বেরিয়ে নতুন করে উদ্যোগী হলেন। যাবজ্জীবন দীপান্তর সাজা প্রাপ্ত বিপ্লবী দীনেশ চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে মহিলাদের সংগঠনকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আবারও তিন মাসের জন্য বোম্বে জেলে যান। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় এসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শেষ জীবনে “জীবন অধ্যায়” নামে আত্মজীবনী লিখেছিলেন এবং সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
ছোট থেকেই বাবা, মা ও দিদির মত বীণাও পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করতেন। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ নাম হয়ে উঠলেন। তখন বেথুন কলেজের ছাত্রী বীণা দাস, ১৯৩২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সেনেট হলে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বীণা গুলি করেছিলেন তার মাথা লক্ষ করে। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি, কর্নেল সুরাবর্দি বীণার গলা টিপে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। স্ট্যানলি একটুর জন্য বেঁচে গেলেও ব্রিটিশ সরকারের কপালে ভাঁজ পড়েছিল বীণার এই দুঃসাহসী পদক্ষেপে। শত অত্যাচার সত্ত্বেও পুলিশ, সংগঠনের কোনও খবর বার করতে পারেনি তার মুখ থেকে। একদিনের বিচারে তার ৯ বছরের জেল হয়। জেলেই তার সঙ্গে আলাপ হয় শান্তি ও সুনীতির। গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় সাতবছর জেলে কাটিয়ে অবশেষে ১৯৩৯ সালে বেরিয়ে আসেন তিনি। নোয়াখালি দাঙ্গার পর সেখানে পীড়িত মানুষের সেবা করতে ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন।
অসামান্যা হয়ে উঠলেন যারা
অন্যদিকে কোনও অস্ত্র না ধরেও যে কত বড় আত্মত্যাগ করা যায় তা বুঝেছিলেন সুশীলা মিত্র (১৮৯৩)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পলাতক বিপ্লবীদের নিয়মিত আশ্রয় দিতেন তিনি। দিনের বেলায় যে বিপ্লবীরা শ্মশানে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন তাদের জন্য হতদরিদ্র মায়ের রান্নাঘর থেকে ঠিক পৌঁছে যেত খাবার। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে তিনি দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন নোয়াখালির মহিলাদের উন্নতির জন্য ‘নোয়াখালি সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি’। ১৯৩২-এর ২৬ জানুয়ারি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন। সেইসময়ে তার বাড়িতে আড়াই মাস, তিন বছর ও পাঁচ বছরের তিনটি সন্তান। তবু তিনি বন্ডে সই করে মুক্তি পেতে আস্বীকার করে বলেছিলেন- “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলব না”।
অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েশ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভাইঝি ছিলেন লতিকা ঘোষ (১৯০২) । কলকাতার লরেটো স্কুলের ছাত্রী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বি.লিট রিসার্চ ডিগ্রিধারী ছাত্রী লতিকা জাতীয়তাবাদী মানসিকতার জন্য বেথুন কলেজে অধ্যাপনার চাকরির সুযোগ পাননি। এরপর আরও জোরকদমে শুরু হয় গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শে চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে যোগ দিয়ে দরিদ্র পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জুনিয়র নার্সিং ও ধাত্রী কাজের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। সেখানে ডাক্তাররা এসে ক্লাস নিতেন। কিন্তু গোপনে শেখাতেন দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার মন্ত্র, আর তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯২৮-এর সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য ওয়েলংটন স্কোয়ারে কংগ্রেসের সভায় তার নেতৃত্বে মহিলাদের উপস্থিতি ও শপথ গ্রহণে। মহিলাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
এই প্রসঙ্গে আর একজনের নাম আসবেই, তিনি হলেন ননীবালা দেবী (১৮৮৮), প্রথম মহিলা রাজবন্দী। ১৯১৫ সালে কার্যত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপন তথ্য নিয়ে আসার জন্য আলিপুর জেলে বন্দি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে দেখা করেন তার স্ত্রীর পরিচয়ে। সেই সময়ে বিধবা মহিলা হিসেবে তার এই সাহসী পদক্ষেপ ছিল কল্পনাতীত। বিভিন্ন সময়ে পলাতক বিপ্লবীদের তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। পুলিশের সন্দেহ হওয়ায় তিনি পালিয়ে গেলেও তাকে পরে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বেনারসের জেলে পাঠানো হয়। জেলে অমানবিক ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা সত্ত্বেও বিপ্লবী সংগঠনের কোনও গুপ্ত খবর তার থেকে বের করতে পারেনি পুলিশ।
দুকরিবালা দেবী (১৮৮৭) ছিলেন বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের মাসি। বিপ্লবীদের প্রায়শই তিনি বাড়িতে আশ্রয় দিতেন। রডা কোম্পানি থেকে চুরি হওয়া পিস্তলের কিছু সংখ্যক পিস্তল তার সম্মতিতেই নিবারণ রেখে যান তার কাছে। পরে পুলিশ খবর পেয়ে হানা দিয়ে কিছু পিস্তল উদ্ধার করে এবং দুকরিবালা দেবী গ্রেপ্তার হন। জেলে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে যৌন নির্যাতন, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়।
এছাড়াও ছিলেন নেলী সেনগুপ্তা, লাবন্যপ্রভা দত্ত, প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম, ইলা সেন, ইন্দুমতী গুহ ঠাকুরতা, সুচেতা কৃপালানি, আভা মজুমদার, করুণা ঘোষ, রাজিয়া খাতুন, নিরুপমা দেবী প্রমুখ।ইতিহাসের পাতায় অনেকের নাম থাকলেও অনেকের নাম তলিয়ে গেছে অবহেলায়। অথচ ভারতকে স্বাধীন করার জন্য এই মানুষগুলি জীবনের বাজি রেখেছিলেন। তাদের আত্মত্যাগে একটি দেশ শুধু স্বাধীনতাই পায়নি, সেই দেশের জনজাতি, পরবর্তী প্রজন্মও পেয়েছে লড়াইয়ের মন্ত্র।