ছোটবেলায় সব আবদারের কথা নির্দ্বিধায় মায়ের সামনে বলা গেলেও তাঁর সামনে বলতে সংকোচ হত। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি তাঁর থেকে চাওয়া - সে দীর্ঘ এক প্রস্তুতিপর্ব। অতিরিক্ত দুরন্তপনা জন্য রাগ করলে মনে হত, হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ তিনিই। অথচ ছোটবেলায় যাঁর হাত ধরে হাঁটতে শেখা বা গান গেয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় যাঁর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া অথবা সামান্য সর্দি জ্বর হলেই দুশ্চিন্তায় যাঁর রাতের ঘুম উড়ে যায় কিংবা প্রচণ্ড মন খারাপের মাঝে সহসা সাহস দিয়ে যিনি বলে ওঠেন- “পারবি, তুই নিশ্চয়ই পারবি”- এই ‘তিনি’ মানুষটা হলেন ‘বাবা’। সন্তানের জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদক্ষেপে শত শাসন থাকলেও নিশ্চুপে নিবিড় ভালবাসায় আগলে রাখেন বাবা।
জুন মাসের তৃতীয় রবিবার, বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ দেশেই পালিত হয় পিতৃদিবস। জুন মাসের তৃতীয় শনিবার রাত ১২টার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় এর উৎযাপন। দিনটি পালনের নেপথ্য কাহিনি হয়তো অনেকেরই অজানা।
বাবাদের জন্য বিশেষ দিন তৈরির গল্প
যদিও এই দিনটি নিয়ে আছে নানা গল্প, নানা ব্যাখ্যা সঙ্গে নানা বিতর্ক। তবে কথিত আছে, যুক্তরাষ্ট্রেই প্রথম এই দিনটি পালন করা হয়। গল্পের কেন্দ্রে আছেন সোনোরা স্মার্ট ডড নামে যুকতরাষ্ট্রের এক কন্যা। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। সোনোরার ১৬ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট ছিলেন সেনাবাহিনীতে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছয় সন্তানকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেন তিনি। আর বাবার এই কষ্টকে সম্মান জানাতে প্রথম ফাদার্স ডে পালন করেন সোনোরা। দিনটি ছিল ৫ জুন, ১৯১০। কারণ ওই দিনটি উইলিয়ামের জন্মদিন। এই দিনটিকে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ানোর জন্য লড়াই করেছেন সোনোরা। আর তাঁর এই লড়াইকে সম্মান জানাতে ১৯১৩ সালে ৫ জুন ছুটি ঘোষণা করে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। কিন্তু তারপরেও লড়াই জারি থাকে দিনটির স্থায়িত্ব নিয়ে। অবশেষে ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দিনটিকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বলা হয় ৫ই জুনের পরিবর্তে ওই মাসের তৃতীয় রবিবার এই দিনটি উদযাপন করা হবে।
সেলুলয়েড-এর বাবারা
ভারতীয় সমাজে পিতা শুধুমাত্র একটি জৈবিক বা সামাজিক সম্পর্কই নয়, প্রচ্ছন্ন ভাবে হলেও তা একটি ক্ষমতার সম্পর্কও - যার অন্য নাম পিতৃতন্ত্র। ব্যক্তি-নির্বিশেষে সকল বাবার মধ্যেই এটি ক্রিয়াশীল। তাই একসময়ে বাংলা হোক বা হিন্দি সব সিনেমা-ই বাবা হিসেবে একজন ব্যক্তিত্বকে সংস্কারী এবং রক্ষণশীল হিসেবে দেখিয়ে এসেছে।নিজেদের শর্তেই সন্তানদের চালনা করতে চেয়েছেন তাঁরা। বাংলায় যেমন ছিলেন কমল মিত্র (দেয়া নেয়া), ছবি বিশ্বাস (সপ্তপদী); হিন্দিতে তেমন অমরেশ পুরী (দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে), পরের দিকে কিছু সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন (মহব্বতে, কভি খুশি কভি গম) প্রমুখ সেই জেদি, গোঁড়া, কঠোর বাবা যাঁরা শেষ পর্যন্তও হাল ছাড়তে নারাজ। এই সময়ে যে ব্যতিক্রম ছিল না এমন নয়- সেক্ষেত্রে পাহাড়ি সান্যাল বা একদিন প্রতিদিন-এর সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অনায়াসেই উঠে আসে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাবাদের চরিত্রের পরিবর্তন এসেছে। আগে যে বাবারা নিজের মেয়েকে আদর দিয়ে মানুষ করলেও সব সময়ই তাঁকে ‘অন্যের সম্পত্তি’ হিসেবেই দেখতেন সেই ছক ভেঙে দিচ্ছেন বর্তমানের পর্দার বাবারা। সে চম্পক বনশালি (আংরেজি মিডিয়াম) হোক বা বাস্তব চরিত্রদের অনুকরণে মহাবীর সিং ফোগাত (দঙ্গল) কিংবা অনুপ সাক্সেনা (গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্যা কার্গিল গার্ল’)। সন্তানের পাশে সবসময় আছেন, সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে খুব সহজাত ভাবেই সন্তানের স্বপ্নকে সমর্থন করেন তাঁরা। তাদের মানবিক গুণ, উদারতা এবং ভালোবাসাতেও খামতি নেই, চিন্তায় নেই কোন লিঙ্গ বৈষম্য। অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বলে ওঠেন 'মারি ছোরিয়াঁ ছোরো সে কম হ্যায় কে'!
তাঁহাদের কথা
এ তো গেল পর্দার কথা। কিন্তু পর্দার বাইরের অতি সাধারণ বাবারা, যাঁদের জীবন আড়াই তিন ঘণ্টার গল্প নয়; প্রতিনিয়ত তাঁরা ত্যাগ, পরিশ্রম, ধৈর্য, দায়িত্ব ,কর্তব্য এবং ভালোবাসার উত্থান -পতনের মধ্যে দিয়ে সন্তানদের লালন করে চলেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে সেইসব বাবাদের সঙ্গে। কথোপকথনে উঠে এসেছে- তাঁদের সঙ্গে একদিকে তাঁদের বাবা অন্যদিকে তাঁদের সন্তানদের সম্পর্কের সমীকরণ; পাশাপাশি একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রজন্মের বাবাদের সন্তান ও সমাজের বিষয়ে চিন্তার পরিসরের বিবর্তিত রূপ।
‘বাবা’ এই শব্দটি শুনলেই প্রত্যেকেরই প্রথমে নিজেদের বাবার কথাই মনে আসে বলে তাঁরা জানান। কারণ এই শব্দটির সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাত যেন জ্ঞানের চোখ খোলার অনেক আগে থেকেই। ফলে স্নায়ুর মধ্যে শব্দটি ঢুকে গিয়েছে। তাই রিফ্লেক্স অ্যাকশনের মতই বাবা শুনলে প্রথমে নিজের বাবার কথাই মাথায় আসে বলে জানান অমিতাভ মিত্র, যিনি প্রায় সদ্য পিতৃত্বের স্বাদ অনুভব করছেন।
অন্যদিকে বছর দশেকের এক কন্যার পিতা অঙ্কন মিত্র তাঁর বাবার প্রসঙ্গে বলেন- “ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি যে, মানুষটা পুলিশের থেকেও রাগী এবং ফিজিক্স ও অঙ্কের একজন তুখোড় মাস্টারমশাই; যিনি রাত দশটার আগে কখনও বাড়ি ফিরতেন না, আর সিগারেট ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতেন না। এই মানুষটিকে যেমন ভীষণ ভয় পেতাম, তেমন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাও ছিল প্রগাঢ়।” একটা সময় পর সেই রাগী মানুষটি হয়ে ওঠেন তার বন্ধু। তাই বাবা চলে যাওয়ার ষোল বছর পর এখনও প্রায়ই মাঝরাতের ঘুম-বাস্তবে আরও ভীষণভাবে অনুভব করেন তাঁর বাবাকে।
পাশাপাশি, তাঁরা যখন নিজেরা সেই পিতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করলেন তখন কেউ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন, কেউ বা আবার তাঁদের বাবাদের পথই অনুসরণ করেছেন।
ষাট বছর বয়স ছুঁয়ে ফেলা এক পিতা সুব্রত মিত্র বলেন- সন্তান পালনের বিষয়ে বাবার প্রদর্শিত পথেই প্রাথমিক ভাবে তিনি হেঁটেছেন। নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি এমন ব্যক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হন যেটা অনেক মা-বাবাদের ভাবনার বাইরে। সেই পরিস্থিতিও ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু তিনি সেই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পিছিয়ে আসেননি বরং সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন, বলেন, “আমি পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি আমার বাবার দেখানো পথ ধরেই এবং এক্ষেত্রে আমার স্ত্রীর ভূমিকাও অগ্রগণ্য।”
অঙ্কন কখনোই চান না যে তাঁর কন্যা কখনও নিজের বাবাকে একজন রাগী-শিক্ষক বাবা হিসেবে পাক। নিজের বাবাকে মেয়ে যেন কখনো যমের মতো ভয় না পায়, সে ব্যাপারে তিনি অধিক মাত্রায় সচেতন। তাঁর কথায়, “আমাদের বাপ আর বেটির মেলামেশাতে, আমি আমার বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের বাঁধনকেও টপকে যেতে চাই অনেকটা।”
অন্যদিকে, অমিতাভ কন্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্র সহ যাবতীয় অবরোধমূলক ক্ষমতাদর্শের বাইরে নিজেদের বের করে আনার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত সচেতন থাকেন।
সময়ের সরণি বেয়ে সিনেমার মতোই বাস্তব সমাজেও বাবাদের সত্তার একটা রদবদল ঘটছে। একটা সময়ে গড়পড়তা একান্নবর্তী বাঙালী পরিবারে বাবারা ছিলেন সন্তানের থেকে বেশ খানিক দূরের মানুষ; কারণ সন্তান পালনের দায়িত্ব শুধু বাবারই ছিল না, বরং তা ভাগ করে নিতেন একই সঙ্গে কাকা, জেঠা, দাদারা। আগে সন্তানাধিক্য বেশি থাকায় বাবারা কারোর প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে অপারগ ছিলেন। শুধু সুষ্ঠু ভাবে পড়াশুনা সম্পন্ন করে ভাল চাকরিটা যাতে পায়, সেদিকে নজর দিতেন। কিন্তু যখন থেকে যৌথ পরিবার ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়িতে বাবা-মা-সন্তান উঠে এলো তখন না-চাইতেও বাবাদের কাঁধেই দায়িত্ব এসে পড়লো। ‘আপনি-আজ্ঞে'র বাবা-রা মায়ের মতই ‘তুমি-তোমরা’য় পরিণত হলেন।
এই বিষয়টি নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলতে বলেছে, কলকাতা পাভলভ হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী শ্রীমতী গীতশ্রী সাহা-র সঙ্গে। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে তাঁর অভিমত – “বাবা ভয়ের মানুষ নন, দূরের মানুষ নন, দেবতাও নন। বাবার সান্নিধ্য যেন সন্তান উপভোগ করতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে সচেতন থাকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাবা হলেন সবচেয়ে আগে বন্ধু আর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেন সেই সম্পর্ক থাকে যেখানে অকপটে সন্তান তার মনকে মেলে ধরতে পারে। বাবা যেন হয়ে ওঠেন সন্তানের আশ্রয়, ভরসা ও নিরাপদের স্থান। আর এই সম্পর্ক তৈরির প্রথম সোপান নির্মাণে বাবাদেরই অগ্রসর হওয়া জরুরি।”
নতুন প্রজন্মের বাবারাও খানিক সেই ভাবনার পথেই হাঁটছেন। “যখন থেকে সন্তানের শিক্ষা, বড় হওয়া প্রতিযোগিতার বাজারে প্রবেশ করলো সেইসময় থেকে সন্তানের সঙ্গে বাবাদের সংযোগও বাড়লো। আগের তুলনায় বাবা-সন্তানের যোগাযোগ এখন অনেক দৃঢ়৷ স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ, যা আগে অনেক সুপ্ত ছিল এখন অনেকটাই প্রকট। কখনো হয়তো ট্রেন্ডের সঙ্গে মিলিয়ে খানিক প্রচার-সর্বস্বও; তবুও সেসব আলোর ঝলকানি পেরিয়ে অপত্য-স্নেহের স্পর্শটুকু হয়তো সবসময় চোখে পড়ে না। কিন্তু সেটা আছে। প্রতিযোগিতার বাজারে পরাজয়ের পরেও আর কেউ না-থাক, বাবা-মায়ের হাত থাকে। ওইটা বদলায়নি” - বিশ্বাস করেন অমিতাভ মিত্র।
অন্যদিকে, অঙ্কন মিত্র মনে করেন পৃথিবীর আদিমতম সম্পর্ক পিতৃত্বকে আরও প্রগতিশীল করে তোলার দায়িত্ব বর্তায় তাদের ওপরও। “প্রায় বছর কুড়ি আগে উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমার বাবা কিন্তু আমার ঘাড়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বোঝা জোর করে চাপিয়ে দেয়নি; বলেছিল, ‘বায়োলজিটাই যখন ভালো লেগেছে, ওটা নিয়েই এগিয়ে যা। আমি তো পাশে আছিই।’ আমিও যেন ভবিষ্যতের বাবাদের প্রতিনিধি হয়ে তেমনই আমার মেয়েকে বলতে পারি, আই নো হোয়াট ইজ এলজিবিটিকিউ। ইয়োর জেন্ডার, ইয়োর চয়েস!"