বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বারান্দায় অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন রাফাত হাসান, পেশায় প্রকৌশলী। তাঁর স্ত্রী অপারেশন থিয়েটারে। ঘন্টাখানেক পর নার্স বেরিয়ে এলেন কাপড়ে মোড়ানো নবজাতক শিশুকে নিয়ে। অপেক্ষারত রাফাত হাসানকে নার্স জানালেন, “আপনার একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে।” তিনি শিশুটিকে কাঁপা হাতে কোলে নিলেন। তাঁর চেহারায় হতবিহ্বল ভাব। এই মূহুর্ত থেকে তিনি একজন কন্যার বাবা। রাফাত এই প্রথম বাবা হলেন। তাঁর হাতে এখন যত্ন করে ধরা এক বিরাট দায়িত্ব, যার নাম ‘সন্তান’। কেমন লাগছে সন্তানকে কোলে নিয়ে, জানতে চাইলে শুধু বললেন, “এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
একটি শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আরো দুটি মানুষের নতুন পরিচয়ের জন্ম হয়। তাঁরা হলেন সন্তানের বাবা ও মা। বাবা শব্দটির মধ্যে রয়েছে আশ্রয় ও নির্ভরতা। একজন সন্তানের শৈশবের সুপারহিরো তার বাবা। শিশুরা মনে করে তার বাবা পৃথিবীর সকল সমস্যার সমাধান করতে পারেন। বাবার চোখ দিয়ে সে পৃথিবী দেখতে শেখে। ঠিক তেমনই একজন পুরুষ ‘বাবা’ পরিচয় লাভ করেন তাঁর সন্তানের মাধ্যমেই। পৃথিবীতে সন্তানের আগমনে তাঁর মনোজগত তাঁকে পিতৃত্বের জানান দিয়ে যায়।
প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি
কথাসাহিত্যিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড: কাজী মোস্তাক গাউসুল হক দুই সন্তানের বাবা। বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, “খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকের জীবনে এ ধরণের মানসিক প্রস্তুতি থাকে যে একদিন তাকেও কেউ না কেউ বাবা ডাকবে। আমি আমার বাবার সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম। আমি বাবার প্রতি যে ভালোবাসা, টান, মমতা অনুভব করেছি এ সবকিছুই অবচেতন মনে আমার সন্তানের কাছ থেকে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। পৃথিবীতে অল্প যে দু’চারটা অনুভূতিকে স্বর্গীয় বলা যায় তার একটি হলো প্রথম বাবা হওয়া। বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার সন্তানের জন্ম হয়। যখন থেকে সে আসবে জানলাম তখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয় এবং সেই ক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অর্থাৎ তখন থেকেই জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে লাগলো। যখন আমার পুত্রসন্তানের জন্ম হলো সেই মূহূর্তের আবগ বা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা ভীষণ কঠিন কাজ, আক্ষরিক অর্থেই সেটি স্বর্গীয় অনুভূতি ছিলো।”
একইরকম অনুভূতি প্রকাশ করলেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা তানভীর হায়দার। সম্প্রতি তিনি বাবা হয়েছেন। বাবা হবেন এ সংবাদটি যেদিন পেয়েছিলেন সেদিনের তারিখটিও তিনি মনে রেখেছেন। বললেন, “দিনটি ছিলো ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২। আমার স্ত্রী প্রথম আমাকে বাবা হওয়ার সংবাদটি দিয়েছিলেন। আমি এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম যে আবেগে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডের পুরো জার্নিতে আমি আমার স্ত্রীর যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল ছিলো সেই কাঙ্খিত দিন। আমার স্ত্রী ওটি-তে। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর একজন সিনিয়র নার্স ফুটফুটে একটি শিশু (পুত্র সন্তান) কোলে করে বাইরে আসলেন। আমার কোলে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আপনার চাঁদের আলো।’ মহান আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলাম। ”
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আনিছুর রহমান লয়েটের সন্তানের বয়স আঠারো মাস। বাবা হবার অনুভূতি তাঁর কাছেও অনন্য। জানালেন, “প্রথম যখন আমার স্ত্রী আমাকে ফোনে জানায় আমাদের সংসারে নতুন কেউ আসছে, সে সময় আমি ডিউটিতে ছিলাম। সেটা ছিলো করোনাকালীন সময়। খবরটা শোনার সাথে সাথেই মনে হয়েছিলো আমার একটা রেসপনসিবিলিটি বাড়লো। অনাগত সন্তানের কথা ভেবে অনেক ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা মাথায় এলো তখন। ভালোও লাগছিলো আবার কিছুটা উদ্বিগ্নও ছিলাম, এটা একটা মিশ্র অনুভূতি। এরপর পুরো নয়টা মাসই আমরা এ বিষয়গুলো ভীষণ উপভোগ করেছি। ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ছেলে না মেয়ে হবে, বাবুর কী নাম রাখব নানান কিছু ভেবেই আমাদের সময়গুলো পার হয়ে গেছে তখন। তারপর আমার কন্যার জন্ম হলো। ওকে যখন প্রথম দেখি তখনকার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ছোট্ট একটা সুন্দর বাবুকে দেখলাম, জানলাম ও আমাদের সন্তান।”
নারীর মতো পুরুষেরও আসে পরিবর্তন
সন্তান গর্ভে আসার পর একজন মায়ের শারীরিক পরিবর্তগুলো খুব সুস্পষ্টভাবেই দেখা যায়। গর্ভধারণ থেকে সন্তান জন্মলাভের পুরো সময়ে একজন নারী শারীরিক, মানসিক অনেক ধাপ অতিক্রম করে মা হন। মায়েদের মতো শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মতো সরাসরি দেখা না গেলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাবা হওয়ার প্রক্রিয়ায় পুরুষদের মধ্যেও আসে পরিবর্তন। বাবারা বেশ কিছু জৈবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান, যা তাদের আচরণগত ও মনস্তাত্বিক পরিবর্তন ঘটায়।
এ বিষয়টি নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইশরাত শাহনাজ (পিএইচডি গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন)। তিনি বলেন, “সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই একজন নারীর শরীরের অন্যতম পরিবর্তন হলো অক্সিটোসিন হরমোনের বৃদ্ধি যা নারীকে তার সন্তান জন্ম দিতে ও জন্মগত সন্তানকে দুধ পান করাতে সাহায্য করে। তেমনি গবেষণায় দেখা গেছে যখন একজন পুরুষ প্রথম বাবা হন তখন তার শরীরের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায় যা তাকে সন্তানের প্রতি মনোযোগ দিতে এবং একজন দায়িত্ববান বাবার ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে।” গবেষণায় আরো একটি যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে সেটি হল, যখন একজন পুরুষ তাঁর গর্ভবতী সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটান তখন তার শরীরের অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং তাকে তার সঙ্গীর আরো নিকটে আসতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয় বাবা হওয়ার পর প্রথম ছয় মাস এই অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে যা একজন পুরুষকে যত্নশীল বাবা হতে সাহায্য করে। একজন বাবা যত বেশি তার সন্তানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটান, যোগাযোগ রাখেন এবং খেলাধুলা করেন তত এই হরমোন চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছায় যা একজন বাবাকে আবেগীয়ভাবে তার সন্তানের কাছাকাছি হতে সাহায্য করে। একজন বাবার শরীরে আরো একটি হরমোনের পরিবর্তন হতে দেখা যায়, সেটি হচ্ছে কর্টিসল হরমোন। যখন একজন নতুন বাবা তার সদ্য জন্মানো সন্তানের কান্না শোনেন, তখন তার শরীরে এই হরমোনটি তৈরি হয় যেটি সাধারণত যে কোনো চাপমুলক পরিস্থিতিতে আমাদের শরীরে তৈরি হয়। এই হরমোনটি একজন বাবাকে খুব দ্রুত তার সন্তানের প্রয়োজনে সাড়া দিতে সাহায্য করে। এবং যখন একজন বাবা তার সন্তানকে কোলে তুলে নেন বা তার সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান করেন তখনই হরমোনটি আস্তে আস্তে কমে যায়।
পিতৃত্বের স্বাদ ও দায়িত্বের চাপ
সন্তানের লালন পালন করতে করতেই পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের পূর্ণ স্বাদ আস্বাদন সম্ভব। বলা হয়, সন্তানের বেড়ে ওঠার সঙ্গেই বাবা-মা-ও বড় হন অর্থাৎ অভিজ্ঞ হন। সন্তান জন্মের পর একদিকে যেমন নতুন বাবা মা হওয়ার আনন্দ খুশি বা উচ্ছলতা থাকে অন্যদিকে একটি নতুন দায়িত্ব পালন করার চাপ উদ্বিগ্ন ভাব বা চিন্তাও শুরু হয়। যেমন তানভীর হায়দার বললেন, “আমি এখন দারণ ঘরমুখো হয়েছি। নবজাতক সন্তানকে নিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন স্বপ্ন বুনছি। সংসারের নানাবিধ কাজ আমি নিমেষেই করে ফেলি। আমি বাবা তাই সংসারের প্রতি আমার কেয়ারিংও এখন আলাদা।”
অধ্যাপক ড. কাজী মোস্তাক বললেন, “আমার ছেলের ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা, প্রথম তার মুখে বাবা ডাক শোনা, তার সঙ্গে খেলা করা, তাকে কাঁধে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া সবকিছুই আমাকে ধীরে ধীরে একজন বাবায় রূপান্তর করেছে। ছোটবেলায় একেবারে খেতে চাইতো না, রাতে ঘুমাতো না, কান্নাকাটি করতো। ঘন্টার পর ঘন্টার চেষ্টায় খাওয়ানো হতো, সারারাত কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হতো, এই সবকিছুর মধ্যেও একটা পরিতৃপ্তি রয়েছে। আবার ছেলের যখন ছয় বছর বয়স তখন আমার কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। কন্যার বাবা হওয়ার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ রয়েছে। আমি মনে করি ঘরে একজন কন্যাসন্তান না থাকলে বাবা হওয়ার আনন্দের পূর্ণতা মেলে না। আমার কখন মনে হলো, একটা পুতুল আমার ঘরে চলে এলো। বাবা হওয়ার বিষয়টাই অতুলনীয় তবে মেয়ের বাবা হওয়ার আনন্দটা যেনো ভিন্ন আমেজের। আমি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করি যে আমি একজন পুত্র ও একজন কন্যার জনক। তাদের দুজনকেই লালনপালন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আনন্দ, আবেগ সবকিছুকে ছাপিয়ে একসময় তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তাতে মগ্ন হয়েছি এবং ধীরে ধীরে ওরা যত বড় হচ্ছে সেই চিন্তাগুলো বাড়ছে, দায়িত্ববোধ বেড়েছে।”
আনিছুর রহমানের কাছেও তাঁর কন্যার প্রথম আধো আধো বুলি. বাবা ডাকা, পা দিয়ে বল ছোড়া, প্রতিটি কাজই ভীষণ ভালো লাগার। আবার সে চোখের আড়াল হলেই কী করছে, কী ধরছে এসব নিয়েও ভীষণ চিন্তা হয় জানালেন। বললেন, “তার এই বেড়ে ওঠা যেমন ভালো লাগায় তেমনি তার ভবিষ্যৎ চিন্তায় আমাকে মগ্ন করে। বড় হবে, স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তার জন্য আর কী কী করবো সেসব কিছু এখন থেকেই চিন্তা করি।”
এই যে ধীরে ধীরে বাবা হয়ে ওঠা, পিতৃত্বের কর্তব্যবোধের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এ বিষয়ে ইশরাত শাহনাজ বলেন, “একজন নারীর মতো একজন পুরুষেরও এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক প্রচেষ্টার দরকার হয়। বাকি সব দায়িত্বের সঙ্গে একটি নতুন দায়িত্ব, ‘সন্তানের দেখাশোনা’— একজন পুরুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। একদিকে যেমন নতুন একটি সামাজিক ভূমিকা পালন বা নতুন পরিচয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় তেমনি পরিবারের নতুন সদস্যের শারীরিক ও আর্থিকভাবে দেখাশোনা করার দায়িত্ব পালন করতে হয়।” ইশরাত মনে করেন, একজন নারীর মতো একজন পুরুষের জন্যও বাবা হওয়া ক্লান্তিকর এবং চাপপূর্ণ। তাই একজন নারীর পাশাপাশি পুরুষেরও বাবা হওয়া পরবর্তী সময়ে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলির প্রতি যত্নশীল হতে হবে।