সন্তানের জন্য মা পারেন না, এমন কোনও কাজ পৃথিবীতে নেই। সন্তানের জন্য মায়ের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকারের নানান উদাহরণ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানের মায়ের লড়াইটা আরও কঠিন। সমাজ, সংসার, সন্তানের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে তাকে বড় করেন তিনি। এরকম কিছু লড়াকু মায়েদের সঙ্গে ভয়েস আমেরিকার পক্ষ থেকে কথা বলি। তাঁরা শুনিয়েছেন তাদের সন্তান ও সন্তানকে নিয়ে সংগ্রামের গল্প।
সুবিধাবঞ্চিত লাকি বেগম ও মেয়ে আয়েশা
“শ্বশুরবাড়ির সবাই বলতো আমি পাপ করেছি। আমার পাপের কারণেই এমন মেয়ের জন্ম হয়েছে। এমনকি মেয়ের বাবাও আমাকে উঠতে বসতে এ কথাই বলতো। সে তার অসুস্থ মেয়ের কোন দায়িত্ব নিতে চায় নাই, তাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”
লাকি বেগমের মেয়ে আয়েশার বয়স এখন ১৭ বছর। যখন তার দুই মাস বয়স, ডাক্তাররা বলেছিলেন আয়েশা অন্য শিশুদের মতো সুস্থ নয়। লাকি তখন কাজ করতেন একটি গার্মেন্টেস কারখানায়। স্বামী কোনো কাজকর্ম করতেন না। বিয়ের এক বছর পরেই মেয়ের জন্ম। জন্মানোর কিছুদিন পরে অসুস্থ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখন বিভিন্ন টেস্ট করে ডাক্তাররা বুঝতে পারেন আয়েশা ডাউন সিনড্রোম শিশু এবং সে সময় আয়েশার হার্টে দুটি ছিদ্র ছিল, হার্টের অপারেশন করতে হবে। একদিকে অসুস্থ শিশু আরেক দিকে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, শারীরিক-মানসিক অত্যাচার নিয়ে তখন দিশেহারা লাকি। বাবার বাড়ি থেকে মানসিক সহায়তা পেলেও অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে এমন অবস্থা ছিলো না। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে তিনি একটি ডাক্তারের টিমের সন্ধান পান, যারা দুঃস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করান। তাঁদের পরামর্শে অপারেশনের জন্য মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করান। এই অবস্থায় তার স্বামী তাদেরকে রেখে বাড়ি যাবার নাম করে পালিয়ে যান। এদিকে গার্মেন্টস কারখানা থেকে জয়েন করার তাগাদা অন্যথায় ছাঁটাই করার হুমকি। অসহায় লাকি বোনকে হাসপাতালে মেয়ের কাছে রেখে কর্মক্ষেত্রে যান। এরমধ্যেই মেয়ের অপারেশন হয় এবং তা সফল হয়। মেয়ের পরবর্তী চিকিৎসা, ওষুধ খরচের জন্য পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য অর্থ-সম্পত্তি বিক্রি করে টাকার যোগান দিয়েছেন লাকি। লাকি বলেন, “তখন ভাই-বোনরা বলেছিলো এই সামান্য জায়গা জমি বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা করবি, তোর পায়ের নিচে তো কিছু থাকলো না। আমি তাদের বলেছিলাম, আমার পায়ের নিচে কিছু থাকার দরকার নাই, আমার মেয়ে যদি আমার বুকে থাকে তাহলেই আমি অনেক কিছু পাবো।”
“তখন ভাই-বোনরা বলেছিলো এই সামান্য জায়গা জমি বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা করবি, তোর পায়ের নিচে তো কিছু থাকলো না। আমি তাদের বলেছিলাম, আমার পায়ের নিচে কিছু থাকার দরকার নাই, আমার মেয়ে যদি আমার বুকে থাকে তাহলেই আমি অনেক কিছু পাবো।”
লাকি বেগমকে কয়েক বছর পর তালাকের চিঠি পাঠিয়ে দেন তাঁর স্বামী। লাকি পরে অন্যত্র বিয়ে করেছেন, সেখানে তার একটি দু বছর বয়সী ছেলে রয়েছে। বর্তমান স্বামী গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন। লাকি এখন বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির রামপুরা-বনশ্রী শাখার স্কুলে নিয়মিত যান লাকি। এর আগে তিনি ঘরেই মেয়েকে নাম, ফোন নাম্বার লিখতে শিখিয়েছেন, টুকটাক পড়াশোনা শিখিয়েছে। আয়েশা অন্যান্য ডাউন সিনড্রোম শিশুদের মতো নাচতে, গাইতে পছন্দ করে। নিজের কাজগুলো এখন নিজেই করতে পারে। লাকির আক্ষেপ, “আমার মেয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে পছন্দ করে। কিন্তু অন্য বাচ্চাদের মায়েরা ওর সাথে মিশতে দেয় না। ও খেলতে গেলে ওকে ঘাড় ধরে সরায় দেয়।”
বাংলাদেশ সিনড্রোম সোসাইটির পরিচালক শাহনাজ পারভীন চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানালেন, আয়েশার পড়াশোনার সকল দায়িত্ব সোসাইটি থেকে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিনড্রোম সোসাইটি আয়েশার মাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেবার পরিকল্পনাও করেছে যাতে তিনি ঘরে বসেই কিছু রোজগার করতে পারেন।
লড়াকু রিজা ও মেয়ে ইয়ানাত
রিজা রহমানের একমাত্র মেয়ে আল আয়মান ইয়ানাত। ইয়ানাত সেরিব্রাল পলসি বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতসহ বহুবিধ প্রতিন্ধকতায় ভুগছে। ২০১২ সালে ইয়ানাতের জন্ম। রিজা তখন সৈয়দপুরে থাকেন। সেখানে গর্ভধারণের সাড়ে ছয় মাসের সময় জটিলতার কারণে ডাক্তাররা নরমাল ডেলিভারি করান। ইয়ানাত প্রিম্যাচিউরড শিশু হিসেবে একেবারেই কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। ডাক্তাররা বলেছিলেন শিশুটিকে বাসায় নিয়ে যেতে কারণ সে চারদিনের বেশি বাঁচবে না। ইয়ানাতের মায়ের দাবি, “ডাক্তার যদি তখন আমাকে বলতেন, রংপুর মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে ইনকিউবিটরে রাখার ব্যবস্থা করতে, তাহলেও আমার সন্তানের এত ক্ষতি হতো না।” চারদিন বয়সে জ্বর ও খিচুনি হওয়ার পর শিশুটিকে রংপুরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং এক মাস ইনকিউবিটরে রাখা হয়, সেখানেও তার কয়েকবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।
ইয়ানাতের সেরিব্রাল পলসি রয়েছে সেটা রিজা বুঝতে পেরেছেন অনেক পরে। সাত মাস বয়সে শিশুর শারীরিক বিকাশ কম মনে হওয়ায় তিনি নিয়মিতই ডাক্তার দেখাতেন। বললেন, “পরে দেখেছি ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের বাম পাশে প্রতিবার CP (সেরিব্রাল পালসি) লিখে দিতেন। কিন্তু এটা কী, তা তখন বুঝতাম না। ডাক্তারও কখনও আমাকে কিছু বলেনি। ওর এই সমস্যা কতটা গুরুতর সেটা আমাকে কোনো ডাক্তাররা বোঝাননি।” রিজা জানালেন রংপুরে এক থেরাপিস্টের কাছে তিনি মেয়ের বিষয়ে প্রথম ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি শুনেন। মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় আসার পরও ডাক্তাররা তাঁকে নিরাশ করেন। কোথায় যাবেন কোনো দিক নির্দেশনা দেন না। এরপর রিজা একাই এ বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরকম শিশুদের বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশি দেশ ভারতে নিয়ে যান। সেখানে ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি শুরু করার পরে ইয়ানাতের অনেক উন্নতি হয়। রিজা জানান, “এর আগে আমার মেয়ে একটা মাটির দলার মতো পড়ে থাকতো। হাত পা নাড়াতে পারতো না। ডাকলে সাড়া দিতো না।” এ পর্যন্ত বেশ কবার তিনি মেয়েকে নিয়ে ভারতে গিয়েছেন। ইয়ানাতের বয়স এখন ১০ বছর। নিয়মিত চিকিৎসার ফলে সে এখন সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতে পারে। রিজা হেসে বললেন, “ইন্ডিয়ার ডাক্তাররা বলেন, এটা আমার ইচ্ছাশক্তির জন্য সম্ভব হয়েছে।”
"ইন্ডিয়ার ডাক্তাররা বলেন, এটা আমার ইচ্ছাশক্তির জন্য সম্ভব হয়েছে।”
রিজার স্বামী আল হেলাল একটি এনজিওতে চাকরি করেন, কর্মসূত্রে তিনি রংপুরের কাউনিয়ায় থাকেন। মেয়ের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল তাই স্বামী দুই ঈদে যা বোনাস পান সেটা খরচ না করে, মাসের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে রিজা মেয়ের চিকিৎসা কাজে ব্যয় করেন। যেহেতু অর্থনৈতিক সাপোর্ট পুরোটাই ইয়ানাতের বাবাকে দিতে হয় এবং চাকুরিজীবি হওয়ায় তিনি বেশিদিন ছুটি কাটাতে পারেন না তাই মেয়েকে নিয়ে মা রিজা রহমানকেই ছুটতে হয়। লাগেজ, মেয়ের হুইলচেয়ার সবকিছু নিয়ে তিনি একাই প্রবল মানসিক শক্তিতে মেয়েকে নিয়ে ছুটে চলেন। এই মেয়ের যত্নের ত্রুটি হবে ভেবে আর কোনো সন্তান নেননি তিনি। এর জন্য আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি এখনও নানান কথা বলে।
মেয়ে ইয়ানাত ঘুরতে পছন্দ করে তাই তাকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন রিজা রহমান। ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সিমলা, মানালি, জম্মু-কাশ্মিরসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। দেশের ভেতরে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন মেয়েকে নিয়ে একা একাই ভ্রমণ করেছেন। সেক্ষেত্রেও লোকের নানান কথা শুনতে হয়েছে। বললেন, সেন্ট মার্টিন যাওয়ার পথে জাহাজে অন্য যাত্রীরা বলছিলেন, “আপনার তো শখ কম না, এমন অসুস্থ মেয়ে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন!” কিন্তু মেয়েকে একটু আনন্দে রাখতেই রিজা মেয়েকে পাহাড়, সমুদ্র সব দেখাতে চান।
সম্প্রতি হুইলচেয়ারসহ মেয়েকে নিয়ে পার্কে ঢুকতে বাধার মুখে পড়েন। গত ২৬ এপ্রিল রংপুরের চিকলি ওয়াটার পার্কের কিডস জোনে হুইলচেয়ারসহ মেয়েকে নিয়ে ঢুকতে গেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অথচ পার্কের কিডস জোনের জন্য টিকেট কাটার সময় তাঁকে এ ব্যাপারে পার্ক কর্তৃপক্ষ কোনো নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়নি। এ ঘটনায় রিজা রহমান অপমানিত বোধ করেন এবং গত ৩ মে একাই মেয়েকে নিয়ে রংপুর প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার প্রতিবাদ জানান। ২৭ এপ্রিল রিজা রহমান রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত চিকলি ওয়াটার পার্ক কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, তাদের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষমা প্রার্থনাও করেনি। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রিজা রহমান জানান, সুপ্রিম কোর্টের দুজন আইনজীবি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁরা রিজা রহমানের পক্ষে পার্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হার না মানা নাফিসা ও ছেলে নাফিজ
নাফিসাতুল মাকসুদা ঢাকার বাইরে একটি জেলা শহরের কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ছেলে নাফিজ উন্মেষ-এর বয়স যখন দুই বছর দুই মাস তখন তার অটিজম শনাক্ত হয়। মাকসুদা জানালেন তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলের কিছু সমস্যা আছে। বললেন, “প্রথমে আমি খেয়াল করলাম নাম ধরে ডাক দিলে ও সাড়া দেয় না। অন্যান্য বাচ্চারা যেমন মাকে অনেকক্ষণ পরে দেখলেই মা’র কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমি কলেজ থেকে আসার পরে ও সেরকম কিছু করতো না। ক্ষুধা লাগলে কান্না করতো না, আমার কাছে আসতে চাইতো না বরং ঘুমিয়ে যেতো। সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতো না। ওর কাজিনরা বাসায় এলে তাদের সাথে খেলতো না। এক কোনায় নিজের মতো চুপচাপ বসে থাকতো। এ বিষয়গুলো তখন আমার চোখে পড়ে।” দেড় বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে নাফিজ স্বাভাবিক শিশুদের মতো একটা-দুটো করে শব্দ, ছোট বাক্য বলতে পারতো। এরপর নাফিসা লক্ষ করেন, ওর শব্দভান্ডার কমতে শুরু করেছে। নতুন কোনো শব্দ শিখছে না বরং কথা বলা কমে আসছে। নাফিসা বিভিন্ন ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। বললেন, “আমি ওকে বড় বড় চাইল্ড স্পেশালিস্টদের কাছে নিয়ে যাই। হিয়ারিং প্রবলেম বা অন্য কোনো প্রবলেম আছে কি না সেটা বোঝার জন্য টেস্ট করাই। পরিবারের সবাই আমাকে বলেছিলো, এসব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বেশি চিন্তা করো। কিন্তু আমার মন মানেনি। ২০০৯ সালে যখন ওর বয়স দুই বছর দুই মাস, তখন আবার একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখাই। তখন তিনি শনাক্ত করেন যে ওর অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) আছে।”
নাফিসা জানালেন এরপর তিনি কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। স্বামীর বদলির চাকরি, তাই তিনিও ট্রান্সফার নিয়ে ঢাকায় চলে আসতে পেরেছিলেন। বললেন, “সে সময় আমি শারীরিক, মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ি। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সে সময় অটিজম সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। আমি কখনওই ধারণা করতে পারিনি, আমার ছেলেটার এত সিভিয়ার ডিসএবিলিটি থাকবে। আমি তখনও জানতাম না যে একসময় ও আর একেবারেই কথা বলবে না। ”
২০১১ সালে ঢাকায় এসে নাফিসা ছেলেকে বিশেষ শিশুদের স্কুলে ভর্তি করান। ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন যে অটিজম একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। নাফিসা এমন চাকরি খুঁজতে থাকেন যা করতে করতেও তিনি সন্তানকে সময় দিতে পারবেন। এরপর অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন, ছেলেকেও একই স্কুলে ভর্তি করেন। এ বিষয়ে শিক্ষকতার জন্য তিনি উচ্চতর পড়াশোনাও করেন। এখন নাফিজ উন্মেষ-এর বয়স ১৬ বছর। মা নাফিসা তাকে ধাপে ধাপে নিজের কাজগুলো শিখিয়েছেন। নাফিজ আট-দশ বছর বয়স থেকে আর কথা বলে না তবে সে ইশারা ও বডি ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে চমৎকারভাবে যোগাযোগ করতে পারে। এখন তার বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে অনেক ধরণের সংবেদনশীলতার সমস্যা (sensory problem) প্রকটভাবে দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরণের থেরাপি ও চিকিৎসার মাধ্যমে তার এই সমস্যাগুলো কমানো হয়েছে বলে জানান নাফিসা। তিনি বললেন, “এখন ও অনেক শান্ত হয়েছে, কাজে মনোযোগ বেড়েছে। কথা বলতে না পারলেও নাফিজ যোগাযোগ করতে পারে, নির্দেশনা বোঝে। অনুকরণ করতে পারে।”
শারীরিক সমস্যার কারণে আর কোনো সন্তান নিতে পারেননি নাফিসা। ছেলে নাফিজ হওয়ার পরপরেই আরো একটি অপারেশন করতে হয়েছিলো। তাই একমাত্র সন্তানকে ঘিরেই জীবনযাপন। খুব কাছের আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কারো বাসায় নাফিজকে নিয়ে তিনি যান না। কারণ অনেকেই নাফিজকে গ্রহণ করতে পারে না, এগুলো মা নাফিসাকে বিব্রত করে।
নাফিসা জানালেন, ছেলে তার মায়ের হাতের দেশি রান্না খেতেই বেশি পছন্দ করে। যেমন: ছোট মাছ চচ্চড়ি, কালোজিরের ভর্তা, মাছের ঝোল। অবসরে মা-ছেলের বেশ গল্প হয়। বাবা-মায়ের অনেক কথাই নাফিজ বুঝতে পারে, কথা শুনে হাসে। ছোট ছোট কাজের নির্দেশ মেনে সেটা করতে পারে। বাসায় মেহমান এলে তাদের সঙ্গেও হাসিমুখে বসে থাকে। আনন্দিত হয়। নানান প্রশিক্ষণ ও মায়ের অক্লান্ত চেষ্টায় নাফিজের বুদ্ধিমত্তার, সামাজিক আচরণের ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটছে।
জয়া ও ছেলে জয়ের জিতে যাবার গল্প
মা হাসিবা হাসান জয়ার একমাত্র ছেলে তামজিদ বিন ইসলাম জয়। ছেলে সম্পর্কে তিনি জানালেন, জয়ের বয়স এখন ২৫ বছর কিন্তু বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা (multiple disabilities) রয়েছে। প্রথমে ওর শুধু শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ওর চোখের সমস্যা, শিখন প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত হয়। জয়া বললেন, “১৯৯৭ সালে আমি যখন কনসিভ করি তখন আমার বয়স মাত্র ২১ বছর। তখন আমি পড়াশোনা করছিলাম পাশাপাশি একটি হাসপাতালে কাজ করছিলাম। গর্ভাবস্থায় আমার হাম হয়। পারিবারিক ডাক্তার রুবেলা টেস্ট দেয়। রুবেলা শনাক্ত হয়। তখন আমি ছয় মাসের গর্ভবতী। পারিবারিক ডাক্তার খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন কারণ এর প্রভাব শিশুর উপর পড়তে পারে। সে সময় আমি প্রতিদিনই মেন্টাল ট্রমার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আট মাসের সময় আমার প্রিম্যাচিউর বেবি হয়ে যায়। অনেক জটিলতার ভেতরে জয়ের জন্ম হয়। শিশুর ওজন, রক্তের হিমোগ্লোবিন কম ছিল। এতকিছুর পরেও আল্লাহর রহমতে ও সারভাইভ করে গেল। আমার মা বললেন, ও জীবনযুদ্ধ করে বেঁচে আছে, তাই ওর নাম জয়।”
মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রিম্যাচিউরড শিশু নিয়ে হাসিবা হাসান জয়াকে ভীষণ লড়াই করতে হয়েছে। তিনি তখন পড়াশোনা করছেন। অন্যান্য শিশুদের তুলনায় ছেলের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ কিছুটা ধীর ছিলো কিন্তু তখনও জয়া বুঝতে পারেননি যে ও কানে শুনছে না। ছেলের নয় মাস বয়সের সময় তিনি লক্ষ করেন যে, ছেলে শব্দ শুনে চমকে ওঠে না, তাকায় না। জোরে শব্দ হলে ঘুম ভেঙে কাঁদে না। ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে, ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরেও সমস্যাটি ধরতে পারে না। পরবর্তীকালে ভারতে নিয়ে যান, সেখানে বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে ধরা পড়ে যে, জয় একেবারেই কানে শুনছে না। হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও সফলতা পাওয়া যায় না। তারপর সিঙ্গাপুরে গিয়ে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করিয়ে আনেন। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা। তবে জয়া জানালেন এ ব্যাপারে তিনি জয়ের বাবার পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য জয়া ও তার ছেলের পিছু ছাড়ছিলো না। জয়ের কানে লাগানো এই মেশিনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। তাই সে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছিলো না। ২০১১ সালে আবার সার্জারি করে মেশিনটা পাল্টাতে হয়। এরপর পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিখন প্রতিবন্ধকতা ধরা পড়লো, যাকে ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) বা রিডিং ডিজর্ডার (Reading disorder) বলে। অক্ষরগুলো অন্যভাবে লিখতো। তখন সে সবকিছু ছবি দিয়ে শিখছিলো। বর্ণ দিয়ে অক্ষর তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছিলো। পরে তার এই সমস্যার জন্য তাকে সাইকোলজিস্টের পরামর্শে শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করানো হয়। এরপর দেখা দেয় ভয়াবহ চোখের সমস্যা। চোখের পাওয়ার এখন মাইনাস নাইন (-৯)। তাই বেশিক্ষণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা জয়ের মানা। এত যুদ্ধের পরেও জয় সামাজিকতা শিখেছে, পড়তে লিখতে শিখেছে। বাসার বাজার ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া, হিসেব নিকেশ করা, উবার কল করে কোথাও যাওয়া এরকম অনেক কাজ সে একাই পারে।
হাসিবা হাসান জয়া পেশায় স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথোলজিস্ট এবং অটিজম ব্যবস্থাপনার কনসালটেন্ট। এছাড়া সোসাইটি অফ দ্যা ডিফ এন্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারস (এসডিএসএল)-এর নির্বাহী পরিচালক তিনি। জয়া বলেন, “আমি আসলে এ ধরণের কাজ শুরু করেছি জয়ের জন্যই। জয়ের মতো অন্যান্য শিশুদের জন্য। আমি এখন শিশুদের মাল্টিপল ডিজওর্ডার নিয়ে কাজ করতে পারি। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে জয় হচ্ছে আমার শিক্ষক। আমি ওর কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখছি।”
শাহনাজ ও ছেলে রাফান
সরদার আব্দুর রাজ্জাক ও শাহনাজ পারভীন চৌধুরী দম্পতির তৃতীয় সন্তান রাফান। রাফান ডাউন সিনড্রোম শিশু। মা শাহনাজ জানালেন, “ও হওয়ার পর ডাউন সিনড্রোম শব্দের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তবে এখন রাফানের মতো সন্তানের মা হতে পেরে আমি খুব গর্ববোধ করি। ও জন্মানোর পর খুব নরম, তুলতুলে ছিলো। তখন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ক্রোমোজোমাল এনালাইসিস দেখার জন্য টেস্ট করা হয়। একুশ দিন পরে এ টেস্টের রিপোর্ট আসে, তাতে দেখা যায় ট্রাইসমিক ২১ লেখা।”
ডাক্তারদের ব্যবহার সম্পর্কে আক্ষেপ করে শাহনাজ বলেন “রাফানের খুব ছোটবেলায় নিউমোনিয়া হয়। তখন আমি তাকে একজন বড় শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাই। তিনি আমার ছেলেকে দেখে বলেন যে, ও তো ডাউন সিনড্রোম বেবি। ও জীবনে কিছুই করতে পারবে না। ওর কাছ থেকে কখনো কিছু আশা করবেন না, ও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। আরো অনেক কথা বলেন যেগুলো শুনে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসি। ডাক্তারের কথায় আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সারারাত আমরা ছেলেকে নিয়ে বসে ছিলাম। পরে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে এ বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে পড়াশোনা করা শুরু করি। ২০১৪ সালে আমরা বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি শুরু করি। এ ধরনের আরও সন্তানদের বাবা-মাকে আমরা এই সোসাইটিতে অন্তর্ভুক্ত করি। এর মধ্যে আমি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার এ মাস্টার্স করেছিলাম। আমার চাকরির জন্য নিয়োগপত্র আসলো সহ সমাজসেবা প্রকল্পতে। কিন্তু আমি যদি চাকরি করি রাফানকে কে দেখবে? সে কারণে আমি সেখানে জয়েন করি নাই। এর আগে আমি বড় দুই বাচ্চার দেখাশোনা করে করেই পড়াশোনা করেছি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই বাচ্চাটাকে আমার বিশেষ যত্ন নিতে হবে তাই আমি সেখানে জয়েন করিনি।” তিনি আরো বলেন, “রাফানের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জানতাম বলে ওর যত্ন নিতে পেরেছি। ফলে ওর স্পিচে কোনো ডিলে হয় নাই। এছাড়া ওর আর কোনো শারীরিক ত্রুটি ছিলো না যা অনেক ডাউন সিনড্রোম শিশুদের ক্ষেত্রেই থাকে।”
রাফান এখন সাধারণ শিশুদের স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি সে ভালো নাচ করে, ভ্লগার। বড় দুই ভাইয়েরও চোখের মনি সে। মায়ের হাতের পোলাও, রোস্ট ওর খুব পছন্দ। রাফানের মা যখন ফোনে এই প্রতিবেদককে ওর পছন্দের কথা জানাচ্ছিলেন, তখন রাফান পাশ থেকে বলল, বার্গার খেতেও সে খুব পছন্দ করে। প্রতিবেদককে আরো বলল, ওর ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে, আর তা যেন প্রতিবেদক তা সাবস্ক্রাইব করেন।